চাপের মুখে তৈরি পোশাক শিল্প: প্রবৃদ্ধির ধারা কতটা টেকসই?

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত পড়েছে এক বহুমুখী সংকটে। আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতা, উৎপাদন ব্যয়ের চাপ এবং ভূ-রাজনৈতিক জটিলতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক, ইউরোপের চাহিদা হ্রাস ও ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক উত্তেজনা। এতে দেশের সবচেয়ে বড় রফতানি খাত ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান উৎসটি এক গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রফতানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পে ২০২৪ সালের শেষ প্রান্তিকে— শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির ইঙ্গিত মিললেও ২০২৫ সালের শুরুতেই দেখা দিয়েছে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের প্রথম চার মাসে তৈরি পোশাক রফতানি থেকে আয় ছিল ১৫ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার। পরের বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে তা কমে ১২ দশমিক ৭৪ বিলিয়নে নেমে আসে— যা ছিল প্রায় ১৮ শতাংশের মতো হ্রাস। তবে ২০২৫ সালের প্রথম চার মাসে আয় বেড়ে ১২ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় সামান্য হলেও ইতিবাচক (১ দশমিক ৪৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি)। যদিও এটি এখনও ২০২৩ সালের তুলনায় প্রায় ২ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার কম।

২০২৫ সালের প্রাপ্তি কী বলছে?

জানুয়ারিতে ৩ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার আয় (৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি), ফেব্রুয়ারিতে ৩ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার আয় (১ দশমিক ৬৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি), মার্চে ৩ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার (১২ দশমিক ৪০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি), এপ্রিলে ২ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার (মাত্র ০ দশমিক ৪৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি) আয় হয়েছে। মার্চের প্রবৃদ্ধি তুলনামূলক ভালো হলেও এপ্রিলের চিত্র কিছুটা হতাশাজনক, যেখানে ওভেন পোশাক রফতানিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা যায় (মাইনাস ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ)।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এপ্রিলের রফতানির এই হঠাৎ পতন শিল্পের জন্য একটি সতর্ক সংকেত। এই ধসের পেছনে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কনীতির প্রভাব, ইউরোপে মুদ্রাস্ফীতির নেতিবাচক প্রভাব এবং বৈশ্বিক চাহিদার মন্দাভাব।

বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল এ বিষয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তৈরি পোশাক শিল্প বর্তমানে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নানা চ্যালেঞ্জে জর্জরিত। যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক, ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল, উচ্চ সুদহার, শ্রমিক মজুরি বৃদ্ধি এবং গ্যাস-বিদ্যুতের বারবার দাম বাড়ার কারণে শিল্পটি চাপের মুখে রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘২০২৬ সালে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের পর পরিস্থিতি আরও কঠিন হবে। তখন রফতানিতে প্রাপ্ত শুল্কমুক্ত সুবিধা (যেমন- জিএসপি) হারিয়ে যাবে, যা প্রতিযোগিতার সক্ষমতায় বড় আঘাত হানবে।’ এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) হিসাব অনুযায়ী, এই উত্তরণের ফলে রফতানি ৫ দশমিক ৫ থেকে ১৪ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে।

রুবেলের মতে, তৈরি পোশাক খাত যেহেতু রফতানির ৮৪ শতাংশ বহন করে, তাই এ খাতই সবচেয়ে বেশি চাপে পড়বে। এখন থেকেই দীর্ঘমেয়াদি কৌশল ও বাজার বৈচিত্র্যকরণের প্রস্তুতি না নিলে ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চিত হয়ে উঠবে।

২০২৪ সালের শেষভাগে প্রবৃদ্ধির ঝলক

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তৈরি পোশাক রফতানিতে একটানা চার মাস প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে।

সেপ্টেম্বর ২০২৪: ২ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার (৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি)। অক্টোবর: ৪ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার (২০ দশমিক ৬ শতাংশ)। নভেম্বর: ৪ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার (১৬ দশমিক ২৩ শতাংশ)। ডিসেম্বর: ৩ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার (১৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ)।

এই সময়টাতে পশ্চিমা ক্রেতাদের শীতকালীন এবং ছুটির মৌসুমের অর্ডারের প্রভাবে রফতানি আয় উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছিল। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাজারে কিছুটা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসায় রফতানিকারকরা অর্ডার বাড়ার আশায় বুক বেঁধেছিলেন।

২০২৩ সালে ছিল মিশ্র প্রবণতা

তুলনামূলকভাবে, ২০২৩ সালের প্রথম চার মাসে রফতানিতে দেখা গিয়েছিল মিশ্র চিত্র।

জানুয়ারি ২০২৩: ৪ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার (৮ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি)। ফেব্রুয়ারি: ৩ দশমিক ৯৯৪ বিলিয়ন ডলার (১২ দশমিক ৩১ শতাংশ)। মার্চ: ৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার (১ দশমিক ০৪ শতাংশ হ্রাস)। এপ্রিল: ৩ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার (১৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ হ্রাস)।

২০২৩ সালের মার্চ ও এপ্রিল থেকে রফতানিতে নেতিবাচক ধারা শুরু হয়েছিল, যা ২০২৪ সালের মাঝামাঝি থেকে ঘুরে দাঁড়ালেও ২০২৫ সালের শুরুতে আবার ধাক্কা খায়।

বিশ্লেষণ ও শঙ্কা

এই রফতানি পতনের কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ নিচে তুলে ধরা হলো:

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়াশীল শুল্কনীতি: ২০২৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কিছু পণ্যে পাল্টা শুল্ক আরোপ করায় অর্ডার কমে গেছে।

মূল্যছাড়ের চাপ: ক্রেতারা চাহিদা কমে যাওয়ার সুযোগে কম দামে পণ্য নিতে চাইছেন, ফলে রফতানি আয় কমেছে।

কাঁচামালের মূল্য ও ডলারের দামে অস্থিরতা: আন্তর্জাতিক বাজারে তুলা ও অন্যান্য কাঁচামালের দামের ওঠানামা এবং টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময় হারের অস্থিরতাও আয়ের ওপর প্রভাব ফেলছে।

টেকসই উৎপাদনে ব্যয় বৃদ্ধি: শ্রমিক মজুরি ও পরিবেশবান্ধব উৎপাদন খরচ বাড়ায় প্রতিযোগিতামূলক বাজারে পিছিয়ে পড়ছে অনেক কারখানা।

যুক্তরাষ্ট্রে শুল্ক: সবচেয়ে বড় ধাক্কা

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক কার্যকর হওয়ার পর বাংলাদেশের পণ্য— বিশেষ করে তৈরি পোশাকের রফতানি কমে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। তবে গত এপ্রিল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শীর্ষ পাঁচ তৈরি পোশাক রফতানিকারক দেশের মধ্যে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধিই সবচেয়ে বেশি। এপ্রিল মাসেও রফতানি হয়েছে আগের দুই মাসের চেয়ে বেশি।

এই বাজারে গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ৪ মাসে বাংলাদেশ থেকে ২৯৮ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি হয়েছে। এই রফতানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ বেশি। গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ৪ মাসে যথাক্রমে ৮০, ৭০, ৭২ ও ৭৬ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি করেছেন বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা।

এখন পর্যন্ত তৈরি পোশাক রফতানিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধি থাকলেও বাংলাদেশের একাধিক রফতানিকারক বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আরোপ করা ন্যূনতম ১০ শতাংশ পাল্টা শুল্কের প্রভাব বাংলাদেশের রফতানিকারকদের ওপর পড়তে শুরু করেছে। অনেক মার্কিন ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বাড়তি শুল্কের অর্ধেকটা রফতানিকারকদের কাছ থেকে কেটে নিচ্ছেন। কোনও কোনও ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্কের পুরোটা নেওয়ার ঘটনাও আছে।

রফতানিকারকেরা আরও বলছেন, পাল্টা শুল্ক কমিয়ে আনতে ভিয়েতনাম, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। আগামী মাসের মধ্যে তারা মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন করে ফেলতে পারে। সেটি হলে তারা এগিয়ে যাবে। কারণ, এখনও পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের দর-কষাকষিতে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক

রফতানিতে বড় আঘাত ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নিয়ে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশের পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করেন, যা তৈরি পোশাকে গড়ে ৩৭ শতাংশ। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি কমেছে, অর্ডার বাতিল হয়েছে এবং ক্রেতারা বড় ডিসকাউন্ট দাবি করছেন।

ভারতের সঙ্গে টানাপোড়েন

বাণিজ্যিক উত্তেজনায় কাঁচামাল আমদানি ও ভারতের বাজারে রফতানিতে বিঘ্ন ঘটছে। সীমিত হয়েছে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধাও। এটি দক্ষিণ এশীয় বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

ইউরোপীয় বাজারেও সংকোচন

ইউরোপে অর্ডার কমেছে ১০-১২ শতাংশ। ইউক্রেন যুদ্ধ, জ্বালানি সংকট এবং মন্দার কারণে ব্র্যান্ডগুলো নতুন অর্ডার না দিয়ে মজুত পণ্যের ওপর নির্ভর করছে।

উৎপাদন ব্যয়ের চাপ

নতুন ন্যূনতম মজুরি, জ্বালানি, পরিবহন ও ডলার সংকটজনিত খরচ বাড়ায় উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ১৫-১৮ শতাংশ। কিন্তু ক্রেতারা দাম বাড়াতে নারাজ, বরং ছাড় দাবি করছে।

স্থানীয় বাজারেও বিক্রি দুর্বল

২০২৫ সালের ঈদুল ফিতরের মৌসুমেও স্থানীয় বাজারে বিক্রি আশানুরূপ হয়নি। দ্রব্যমূল্যের চাপে মধ্যবিত্ত শ্রেণি কেনাকাটায় কৃপণতা দেখিয়েছে। অর্থাৎ, অভ্যন্তরীণ বাজারও পোশাক খাতকে খুব একটা ভরসা দিতে পারছে না।

কোথায় দাঁড়িয়ে আছে তৈরি পোশাক খাত?

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ধীরে ধীরে প্রবৃদ্ধি ফিরে এলেও এপ্রিল মাসে তা স্থবির হয়ে পড়ে। বিশেষ করে ওভেন পোশাকে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি রফতানির ভারসাম্যে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে।

তবে আশার কথা হলো, ২০২৪ সালের শেষ চার মাসে শক্তিশালী রফতানির ধারাবাহিকতা এখনও পুরোপুরি থেমে যায়নি। বিশ্লেষকদের মতে, এই গতি ধরে রাখতে হলে জরুরি ভিত্তিতে কতগুলো বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। এরমধ্যে অন্যতম হলো:

পথ খোঁজার সময় এখনই: রফতানি বাজারে এই অস্থিরতা সামাল দিতে এখনই সময় নীতি সহায়তা, নতুন বাজার অনুসন্ধান ও কৌশলগত উদ্যোগের।

নতুন বাজার: চীন, রাশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকার কিছু উদীয়মান বাজারে প্রবেশ জরুরি।

নগদ সহায়তা ও প্রণোদনা: ক্ষতিগ্রস্ত কারখানাগুলোর জন্য নগদ সহায়তা ও রফতানিতে নতুন প্রণোদনা প্যাকেজের দাবি উঠেছে।

ব্র্যান্ড বাংলাদেশ পুনরুদ্ধার: পরিবেশবান্ধব ও সামাজিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থা ফেরানো দরকার।

সাময়িক ঘুরে দাঁড়ানো, কিন্তু হুমকি এখনও বর্তমান: গত তিন বছরের তুলনায় ২০২৫ সালে তৈরি পোশাক খাতে সামান্য আশার আলো দেখা যাচ্ছে। তবে এটি টেকসই কিনা, তা নির্ভর করবে নীতিগত সহায়তা, আন্তর্জাতিক চাহিদা ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার ওপর। এখনই আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই, বরং রফতানি বাজারের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে হলে খাতটিকে আরও গতিশীল ও উদ্ভাবনী করে তুলতে হবে।

বিকল্প বাজার সম্ভাবনার খোঁজে

তবে এই সংকটের মধ্যেও কিছু ইতিবাচক দিক আছে। বাংলাদেশ এখন জাপান, সৌদি আরব, ব্রাজিল, ভারত ও মেক্সিকোতে রফতানি বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া দেশের ১৯০টির বেশি গ্রিন ফ্যাক্টরি রয়েছে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ।

প্রসঙ্গত, পোশাক খাত বাংলাদেশের রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশ জোগান দেয়। এই খাতে ধাক্কা মানেই দেশের অর্থনীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং কর্মসংস্থানে বড় চ্যালেঞ্জ। তাই বিষয়টিকে সংকট নয়, বরং পুনর্গঠন ও কৌশল পুনর্বিবেচনার সময় হিসেবে বিবেচনা করাই হবে সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ।