লোকাল গার্মেন্টস ব্র্যান্ডের বিক্রি বাড়লেও টিকে থাকা কঠিন

২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল— এই চার মাসে দেশীয় রেডিমেড গার্মেন্টস (আরএমজি) ব্র্যান্ডগুলোর বিক্রিতে গড়পড়তা ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে। ডিজাইন, টেকসই ফ্যাশন এবং ক্রেতাদের স্থানীয় পণ্যের প্রতি ঝোঁক— সব মিলিয়ে দৃশ্যপটে এসেছে এক ধরনের উজ্জ্বলতা। তবে বাস্তবতা বলছে, এই খাতে এখনও টিকে থাকা কঠিন। ব্র্যান্ড টিকে থাকছে, কিন্তু বড় হচ্ছে না। লভ্যাংশ কম, আস্থা ঝুঁকিপূর্ণ, আর উদ্যোক্তারা আছেন দোটানায়।

তুলনামূলক সময়ের বিক্রি বিশ্লেষণ

গত তিন বছরে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল সময়ে পোশাক বিক্রির প্রবণতা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ১০ শতাংশ। ২০২৪ সালে তা দাঁড়ায় প্রায় ১৩ শতাংশে। আর চলতি বছর ২০২৫ সালে একই সময়ে প্রবৃদ্ধির হার ১৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে বলে উদ্যোক্তারা দাবি করেছেন।

অপরদিকে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত উৎসব মৌসুমে বিক্রির হার ছিল আরও বেশি। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, বছরের শুরুতে বিক্রি বাড়লেও তা সব ব্র্যান্ডের জন্য নয়—বেশিরভাগ বিক্রি হচ্ছে ৮-১০টি প্রধান ব্র্যান্ডকে ঘিরে।

২০২৩ সালে প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ১০ শতাংশ। ২০২৪ সালে তা দাঁড়ায় প্রায় ১৩ শতাংশে

প্রতি বছরই রোজার ঈদে জমজমাট বেচাকেনা

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঢাকায় মূল বেচাকেনা হয় রোজার শেষ সপ্তাহে। সামগ্রিকভাবে দেশের পোশাক খাতে ভালো ব্যবসা করে বেশ কিছু শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড। তাদের মধ্যে কারও বিক্রি গত বছরের তুলনায় এবার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।

ঈদের বাজারে ব্র্যান্ডের দাপট

দেশের পোশাক বাজারে এখন আড়ং, সেইলর, লা রিভ, টুয়েলভ, ইয়েলো, সারা লাইফস্টাইল, ক্যাটস আই, এসটাসি, রিচ ম্যান, লুবনান, জেন্টল পার্ক, ক্লাব হাউজ, ইজি ফ্যাশনের মতো ব্র্যান্ডের আধিপত্য রয়েছে। দেশি পোশাকের জন্য জনপ্রিয় ফ্যাশন হাউজগুলোর মধ্যে আছে— রঙ বাংলাদেশ, বিবিয়ানা, যাত্রা, সাদাকালো, নিপুণ, দেশাল ও ক্রে ক্র্যাফট।

রঙ বাংলাদেশের স্বত্বাধিকারী সৌমিক দাশ জানান, রমজানের শুরুর দিকে ভিড় কম থাকলেও শেষের দিকে তা বাড়ে। তিনি বলেন, ‘বিক্রি কিছুটা বাড়লেও প্রবৃদ্ধি এখনও সীমিত।’

তৈরি পোশাক রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান ইপিলিয়ন গ্রুপের ব্র্যান্ড সেইলরের এবারের ব্যবসা বেশ ভালো হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) রেজাউল কবীর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সারা দেশে আমাদের ২৩টি বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। গতবারের তুলনায় এবার রোজায় মোট বিক্রি ৪০ শতাংশ বেড়েছে। নতুন দুটি আউটলেট বাদ দিলে প্রবৃদ্ধি ৩২ শতাংশের মতো।’

সামগ্রিকভাবে দেশের পোশাক খাতে ভালো ব্যবসা করে বেশ কিছু শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড

লা রিভের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মন্নুজান নার্গিস জানান, উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব থাকলেও বিক্রি সন্তোষজনক। তিনি বলেন, ‘গতবারের তুলনায় প্রবৃদ্ধি ১০-১৫ শতাংশ হয়েছে। তবে বড় বিল (এক ক্রেতার কাছে বড় অঙ্কের বিক্রি) কিছুটা কমেছে। যারা আগে দুই-তিনটি পোশাক কিনতেন, এবার একটি নিয়েই সন্তুষ্ট থেকেছেন।’

টোয়েলভ ব্র্যান্ডের ব্যবসা গতবারের তুলনায় ৮ শতাংশ বেড়েছে।

সারা লাইফস্টাইলের হেড অব অপারেশন মতিউর রহমান বলেন, ‘আমাদের ১৫টি আউটলেটের মধ্যে বেশিরভাগেই ভালো সাড়া পেয়েছি। মূলত ম্যানস, লেডিস ও গার্লস তিন শ্রেণির পোশাকই ভালো বিক্রি হয়েছে।’ গতবারের তুলনায় তাদের এবার প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ, স্থায়ী আউটলেট হিসাবে ৭ শতাংশ।

তবে ব্যতিক্রম হিসেবে ইজি ফ্যাশনের ব্যবসা গতবারের তুলনায় কমেছে প্রায় ১০ শতাংশ। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক তৌহিদ চৌধুরী বলেন, ‘গত বছর ব্যবসা অনেক ভালো হয়েছিল। এবার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রভাব পড়েছে। তারপরও যতটা খারাপ হওয়ার আশঙ্কা ছিল, তার চেয়ে ভালো হয়েছে।’

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, সামগ্রিক অর্থনৈতিক চাপ ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মাঝেও ভোক্তাদের চাহিদা ধরে রাখতে পেরেছে ব্র্যান্ডগুলো। মান, নকশা ও আউটলেট সম্প্রসারণে যেসব প্রতিষ্ঠান আগেই প্রস্তুত ছিল, তারাই এবার বেশি সুফল পেয়েছে। আর যাদের প্রস্তুতি দুর্বল ছিল, তারা শেষ সময়ে মূল্যছাড়ের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হচ্ছে।

ভোক্তার অভিজ্ঞতা: দাম বাড়লেও মানে খুশি

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী মোহাম্মদ আবিদ হাসান বলেন, ‘‘স্থানীয় ব্র্যান্ডের কাপড় মানে এখন আর সস্তা কাপড় না। আমি ‘আরএফটি’ থেকে শার্ট নিয়েছি ১৪৯০ টাকায়, যা আগে ৯৫০ টাকায় পেতাম। তবে ফিনিশিং, ফেব্রিক ও কাটিং ভালো হওয়ায় মানিয়ে নিই।”

পূর্ব রাজাবাজারের শিক্ষার্থী তাসনুভা জান্নাত বলেন, “আমি অনলাইনে ‘টেক্সমার্ট’ থেকে কিনি। আগে ৮০০ টাকায় কুর্তি পেতাম, এখন সেটা কিনতে ১২০০ টাকা লাগে। তবে ডিজাইনগুলো অনেক আপডেট, সাইজ-ফিট ভালো হয়।”

ঈদের আগে শপিংমলে ক্রেতার ভিড়

উদ্যোক্তাদের দৃষ্টিভঙ্গি: বিক্রি আছে, লাভ নেই

টেক্সমার্টের প্রতিষ্ঠাতা মো. রাজিব হোসেন বলেন, ‘২০২৫ সালের প্রথম চার মাসে আমাদের বিক্রি ২০ শতাংশ বেড়েছে। পাশাপাশি প্রোডাকশন কস্ট বেড়েছে ১৮ শতাংশ। কাপড়, সুতা, শ্রম, এমনকি কুরিয়ার খরচও বেড়েছে। তাই লাভ আগের মতো থাকছে না।’

আরএফটি-র অপারেশন ম্যানেজার সজীব রহমান বলেন, ‘অনলাইনে অর্ডার ভালো যাচ্ছে। কিন্তু খুচরা দোকানের রেন্ট, স্টাফ স্যালারি, ইনভেন্টরি কস্ট মিলে ব্যবসাটা কষ্টকর হয়ে পড়ছে।’

দোকানিদের অভিজ্ঞতা: কিছু ব্র্যান্ড চলে, বাকিরা দাঁড়াতে পারে না

মতিঝিল এলাকার পোশাক দোকানি আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘‘আমরা কিছু লোকাল ব্র্যান্ডের পোশাক তুলে রাখি— ‘ডিফাইন’, ‘ফ্যাশনট্র্যাক’, ‘ড্রেসম্যান’ চলতো। এখন ‘রানার’ বা ‘টেক্সমার্ট’ বেশি চলে। নতুন অনেক ব্র্যান্ড বাজারে আসে, ৬ মাসেই উঠে যায়। ক্রেতা পুরনো চেনা ব্র্যান্ডই খোঁজে।”

সম্ভাবনার পথে সংকটের ছায়া

সব মিলিয়ে বলা যায়, দেশের অভ্যন্তরীণ পোশাক খাতে সম্ভাবনার জায়গা তৈরি হয়েছে, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও শহুরে তরুণ-তরুণীদের ওপর ভিত্তি করে। তবে সুশৃঙ্খল সরবরাহ চেইন, স্কেলআপ করার সক্ষমতা, ডিজিটাল ব্র্যান্ডিং এবং প্রতিযোগিতামূলক মূল্য নির্ধারণ ছাড়া এই প্রবৃদ্ধি টেকসই হবে না।

স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলো এখন ‘বিক্রি হচ্ছে’ ধাপ অতিক্রম করে ‘ ব্র্যান্ড হিসেবে টিকে থাকা’— এই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। আগামী কয়েক বছরেই নির্ধারণ হবে— এই খাত বাংলাদেশের ফ্যাশন শিল্পে কী ধরনের অবস্থান নিতে পারবে।