ইলেকট্রনিক্স ব্যবসায় মন্দা, নেপথ্যের কারণ কী

দেশে ইলেকট্রনিক্স ব্যবসা স্থবির হয়ে পড়েছে। এক বছরে বেচাকেনা নেমেছে অর্ধেকে। দিনের পর দিন লোকসানে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন অনেকেই। সুদিনের অপেক্ষায় কোনোমতে টিকে রয়েছেন কেউ কেউ। এর জন্য রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও উদ্যোক্তা তৈরি না হওয়াকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা।

মূলত ২০২৪ সালে জুলাই আন্দোলনের সময় থেকেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে—যা এখনও স্বাভাবিক হয়নি। বিশেষ করে সরকারি ও করপোরেট পর্যায়ের কেনাকাটা দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকসান এখন দৃশ্যমান।

রাজধানীর গুলিস্তানের স্টেডিয়াম মার্কেট, এলিফ্যান্ট রোড, মিরপুর-১ ও রামপুরাসহ বেশ কয়েকটি মার্কেট ঘুরে জানা গেছে এসব তথ্য। বিক্রেতারা বলছেন—গত বছরের জুলাইয়ের আগে থেকে এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বেচাকেনায় ভাটা পড়েছে।

দাম বাড়েনি তারপরও বিক্রিতে ভাটা

ঢাকা স্টেডিয়ামের সনি ব্রেবিয়া সেলস অ্যান্ড সার্ভিসিংয়ের স্বত্বাধিকারী কামরুল ইসলাম বলেন, গত এক বছরে ইলেকট্রনিক্স পণ্যের দাম খুব একটা বাড়েনি। দুই-একটিতে বাড়লেও তা একেবারেই কম। তিনি জানান, গত বছরের এই সময়ে ওয়াশিং মেশিনের দাম ছিল ১ লাখ ২৭ হাজার টাকা। এখনও সেই দামেই বিক্রি হচ্ছে। এক টনের এসির দাম ছিল ৮৫ হাজার টাকা। এবার ৫ হাজার টাকা বেড়ে হয়েছে ৯০ হাজার। হিটাচির ৪০৩ লিটারের রেফ্রিজারেটরের দাম আগের মতোই ১ লাখ সাড়ে ৪১ হাজার টাকা আছে। ৬৫ ইঞ্চি এলইডি টিভি গত বছর ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা ছিল। এর দাম আগের মতোই। অন্যান্য পণ্য, যেমন- মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ব্লেন্ডার, রাইস কুকারও একই দামে বিক্রি হচ্ছে। তিনি মনে করেন, মানুষের মধ্যে এক ধরনের শঙ্কা কাজ করছে। দামের সামান্য তারতম্যের কারণে চাহিদা এতটা কমার কথা নয়। অবশ্য চলতি বাজেটে ইলেকট্রনিক্স পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ কর নির্ধারণ করা হয়েছে। আগামীতে এ ব্যবসার ভবিষ্যৎ কী  দাঁড়াবে, সেটার জন্য আরও দিন অপেক্ষা করতে হবে বলে জানান কোনও  কোনও ব্যবসায়ী।

গুলিস্তানে স্টেডিয়াম মার্কেটে ইলেকট্রিক দোকান (ছবি: প্রতিবেদক)

দাম না বাড়লেও বিক্রি কমে যাওয়ার নেপথ্যে ব্যক্তিগত, সরকারি ও বেসরকারিসহ একাধিক কারণ চিহ্নিত করেছেন ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রভাব

ব্যবসায়ীদের মতে, ইলেকট্রনিক পণ্য বিক্রির মন্দা হঠাৎ করে নয়। প্রায় এক বছর আগে থেকে এ পরিস্থিতি শুরু। কারণ এ ব্যবসার সঙ্গে সরকার পরিবর্তনের বিষয়টিও কাজ করছে।  বিশেষ করে দরপত্রের মাধ্যমে সরকারি অফিসের জন্য কেনাকাটা করা হয়। এতে ব্র্যান্ড ও নামিদামি প্রতিষ্ঠানগুলো একসঙ্গে অনেক টাকা লাভ করতে পারে। জুলাই আন্দোলনের পর থেকে এখন পর্যন্ত সরকারি অফিসের কেনাকাটা বন্ধ রয়েছে।

গুলিস্তানের স্টেডিয়াম মার্কেটের এক বিক্রেতা নাম প্রকাশ না করে বলেন, অনেক ব্যবসায়ীর রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে। সুতরাং, তাদের কাছ থেকে পণ্য কিনলে বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে। সরকার হয়তো সেই দৃষ্টিকোণ থেকে কেনাবেচা বন্ধ রেখেছে। আবার অনেক জায়গায় ব্যবসায়ী সমিতিগুলোতে পরিবর্তন এসেছে। ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা এক ধরনের শঙ্কায় আছেন, যা নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে ব্যবসার ওপরে।

রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের অ্যাকুয়ার ইলেকট্রনিক্স লিমিটেডের শোরুম ম্যানেজার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এক বছর আগেও দিনে স্বাভাবিক বিক্রি ছিল ৭-৮ লাখ টাকা।

এখন টেনেটুনে দুই লাখ টাকাও হয় না। এমনকি গেলো ঈদুল আজহায়ও বিক্রি তেমন ছিল না। অথচ অন্য সময় এই মৌসুমে ফ্রিজ, এসিসহ কয়েকটি আইটেম বিক্রিতে ব্যাপক চাপ থাকতো।

তিনি মনে করেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার কারণে এমনটি হচ্ছে। নির্বাচিত সরকার এলে হয়তো পরিস্থিতি বদলাতে পারে।

ঝুঁকি নিতে চাইছে না বেসরকারি প্রতিষ্ঠান

শুধু সরকারি নয়, বর্তমানে কোনও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও ঝুঁকি নিতে চাইছে না। তারাও এক ধরনের অনিশ্চয়তা অনুভব করছে বলে জানা গেছে। কারণ আগামী দিনের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর তাদের অনেকের টিকে থাকা নির্ভর করছে। এসব চিন্তাভাবনা তারাও বড় ধরনের কেনাকাটায় বিরত রয়েছে।

রাজধানীর স্টেডিয়াম মার্কেটের কনকা, গ্রি ও হাইকো লিমিটেডের বিক্রেতা হামিদুল ইসলাম জানান, দেড় যুগ ধরে খুব কাছ থেকে ইলেকট্রনিক্স ব্যবসা দেখে আসছেন। কিন্তু এবারের মতো এত মন্দা আগে কখনও দেখেননি। তিনি বলেন, একসময় সরকারি-বেসরকারি বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্ডার সরবরাহ করতে আমাদের হিমশিম খেতে হতো। আর এখন বেশিরভাগ সময় বসে থাকতে হয়। তার মতে, মানুষের মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা কাজ করছে। তাই কেউই ঝুঁকি নিতে চান না।

নতুন প্রতিষ্ঠান না হওয়ায় বিক্রিতে চাপ নেই

রামপুরার ওয়াপদা রোডের একটি শো-রুমের ডিলার জানান, একসময় নতুন বছর এলেই নানা ধরনের নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতো। তখন ইলেকট্রনিক্স পণ্যের বিক্রি বাড়তো। এ বছর তেমন কোনও নতুন প্রতিষ্ঠান চোখে পড়েনি। তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে ব্যক্তি পর্যায়ে উদ্যোক্তাও তৈরি হচ্ছে না। এসব কারণে ব্যবসাও ভালো যাচ্ছে না। তিনি বলেন, দোকান ভাড়া ও স্টাফদের বেতনসহ আনুষঙ্গিক খরচ মিটিয়ে লোকসানে আছি।

সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন

ঢাকা স্টেডিয়ামের ব্যবসায়ী মালিক সমিতির দফতর সম্পাদক আল মামুন বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, একবছর আগেও প্রতিদিন ইলেকট্রনিক্স পণ্য কেনাকাটায় ট্রাক-পিকআপের লাইন দেখা যেতো। আর এখন কালেভদ্রেও এমনটি দেখা যায় না। ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ কম দামে পণ্য বিক্রি করে দিয়ে অন্যদিকে ঝুঁকছেন। বাকিরা রয়েছেন সুদিনের অপেক্ষায়। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা দেওয়া যায় কিনা, সে বিষয়টি সরকারের ভাবা উচিত।’

অন্যদিকে ওয়ালটন রেফ্রিজারেটরের চিফ বিজনেস অফিসার মো. তাহসিনুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ বছর কোরবানি ঈদের আগে দেশজুড়ে কয়েক দিন টানা বৃষ্টি হওয়ার কারণে ফ্রিজের বিক্রি অন্যান্য বছরের তুলনায় কিছুটা কম হয়েছে। তবে ঈদের আগ মুহূর্তে দেশব্যাপী ওয়ালটন ফ্রিজের বিক্রি বেশ ভালো হয়েছে। তাই এবারের ঈদে ফ্রিজের অভ্যন্তরীণ বাজার কিছুটা কমলেও ওয়ালটন ফ্রিজের বিক্রি কমেনি। গত বছরের মতো এবারের কোরবানি ঈদেও ওয়ালটন ফ্রিজের বিক্রি বেশ সন্তোষজনক। এর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে— দেশের বেশিরভাগ ক্রেতার আস্থা দেশের নম্বর ওয়ান রেফ্রিজারেটর ব্র্যান্ড ওয়ালটনে।’

তিনি বলেন, ‘ঈদে সব শ্রেণি, পেশা ও আয়ের ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও ফিচার সমৃদ্ধ অসংখ্য মডেলের ফ্রিজ বাজারে ছাড়ার মাধ্যমে ওয়ালটন ক্রেতাদের সেই আস্থা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে।’