X
সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫
৯ আষাঢ় ১৪৩২

দেশের সম্ভাবনাময় পর্যটন ব্যবসায় অশনিসংকেত

ইমরান আলী
২৩ জুন ২০২৫, ১০:০০আপডেট : ২৩ জুন ২০২৫, ১২:০৮

ভঙ্গুর অবস্থায় পড়েছে দেশের সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্প। গত বছরের ৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে দেশের সম্ভাবনায় এ খাতে নেমে এসেছে স্থবিরতা। পর্যটন এলাকা হিসেবে পরিচিত রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবানে পর্যটনের চিত্র ভয়াবহ। অনেকেই পর্যটকের অভাবে হোটেল-রিসোর্ট বন্ধ করে দিয়েছেন। আর অন্যগুলো খুঁড়িয়ে চলছে। কক্সবাজার ও কুয়াকাটায় সরকারি ছুটির সময়ে পর্যটক গেলেও সংখ্যার বিচারে তা খুব সামান্য। এছাড়া ঢাকার আশপাশের রিপোর্টগুলোও পর্যটকের অভাবে মৃতপ্রায়।

বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, সড়কে এবং পর্যটন এলাকাগুলোতে নিরাপত্তা সঙ্কট ও চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে এমন অবস্থার জন্য দায়ি করছেন পর্যটন খাত সংশ্লিষ্টরা।

তবে ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সাবেক সভাপতি শিবলুল আজম কোরেশী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, নিরাপত্তা সঙ্কটে পড়েছিল এই শিল্প। তবে এখন উত্তরণের পথে। দেশে পর্যটন শিল্পের বিকাশ হচ্ছে। নতুন নতুন স্পট বের হচ্ছে। পর্যটকরাও সেখানে যাচ্ছেন। ওই স্থানগুলোতে হোটেল-রিসোর্ট গড়ে উঠছে।

তিনি বলেন, মাঝখানে সময়টুকু খারাপ হয়ে গেলেও এখন আমি ভালোর দিকে বলবো। কক্সবাজার, কুয়াকাটা কিংবা সুন্দরবন যেটাই বলেন, লোকজন সেখানে যাচ্ছে। আর বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ির কিছু এলাকা রেস্ট্রিকটেড (নিয়ন্ত্রিত চলাচল) করা আছে। তবে সময় যত গড়াবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে। মানুষ বিনোদনের জন্য পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে যাবে।

তিনি আরও বলেন, ট্যুরিস্ট পুলিশ নিরাপত্তায় কাজ করছে। তবে তাদের আরও জনবল বাড়ানো প্রয়োজন। আর এই সিদ্ধান্তটি যেহেতু সরকারের সেহেতু সরকারকে এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। এছাড়াও রাজনৈতিক যে সঙ্কট সেটিও দ্রুত অবসান হবে। 

রাজধানীর অদূরে গাজীপুরের অন্যতম রিসোর্ট ছুটি রিসোর্ট। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগে এই রিসোর্টে বুকিং পেতেই কষ্ট হয়ে যেতো। অন্য সিজন আর অফ সিজন দুই সময়েই রিসোর্টটি ছিল জমজমাট। কিন্তু সবসময়ে ট্যুরিস্টদের কোলাহলে মুখর থাকা রিসোর্টে এখন সুনশান নীরবতা।

কথা হয় রিসোর্টটির হেড অব সেলস মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ব্যবসা খুবই মন্দা। আর এখন তো বৃষ্টি-ঈদ সবমিলিয়ে আরও খারাপ।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেখেন ৫ আগস্টের আগে এই রিসোর্টের অবস্থা কেমন ছিল তা সবাই জানে। কিন্তু বর্তমানে আমরা খুবই সঙ্কটের মধ্যে রয়েছি। কিছু করপোরেট কোম্পানির সভা হয় মাঝে মধ্যে। এগুলো দিয়েই চলছে। আর পর্যটক বা ট্যুরিস্ট একেবারে শূন্যের কোঠায়। কেন এমন অবস্থা এটা সবাই জানে।

একই এলাকার সিকাল্ব রিসোর্টের হেড অব সেলস রোজম্যারি জয়দার বলেন, এই তো চলছে। এর বেশি কিছু বলা আমার পক্ষে সমীচীন হবে না।

পদ্মার পাড় ঘেঁষে মুন্সিগঞ্জে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু রিসোর্ট। তাদের অবস্থাও সঙ্কটময়।

নাম প্রকাশ না শর্তে সেখানকার এক রিসোর্ট মালিক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দেশের শান্তিশৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি যখন ভালো থাকবে, মানুষের হাতে টাকা থাকবে— তখনই তো লোকজন বিনোদনের জন্য বিভিন্ন স্থানে যাবে। বর্তমান দেশের অবস্থা কী ওই পর্যায়ে রয়েছে?

তিনি বলেন, আমাদের তো আর কিছুদিন পর ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হবে। এছাড়া আমাদের উপায় থাকবে না। লোকজন বাসা-বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন না। তারা নিরাপত্তা সঙ্কট দেখছেন। যখন লোকজন নিরাপত্তার সঙ্কট দেখবে তখন কী আর তারা বাইরে ঘুরতে যাওয়ার চিন্তা করবে। কখনোই করবে না। সুতরাং আমরা যারা এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তাদের প্রত্যেকের অবস্থা শোচনীয়।  

আর বাংলাদেশ হোটেল-রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ফিরোজ আলম সুমন বলেন, সবস্থানের হোটেল-রেস্তোরাঁয় একপ্রকার মন্দা চলছে। আগে যেমন গভীর রাত কিংবা সারারাত রেস্টুরেন্ট খোলা থাকতো, এখন কি আর সেটি আছে। নির্দিষ্ট কিছু জায়গা ছাড়া হোটেল-রেস্তোরাঁ রাত ১১টার পর অনেকটাই বন্ধ হয়ে যায়। চলমান এ পরিস্থিতির অবসান না হলে দেশের হোটেল-রেস্তোরাঁ খাত শোচনীয় সঙ্কটের মধ্যে পড়বে।

তিনি বলেন, আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে সাধারণ মানুষের কাছে নিরাপত্তার বিষয়টি গ্রহণযোগ্যতার স্থানে নিয়ে যেতে হবে। তাহলে মানুষ রাত-বিরাতে বের হবে। তারা বিভিন্ন পর‌্যটন এলাকাতে ঘুরতে যাবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছুটির সময়ে কক্সবাজারে কিছু পর‌্যটক হলেও অন্যান্য সময় একেবারে ফাঁকা। আর রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়িতে তো এক প্রকার নিষেধাজ্ঞা চলছে। পাহাড়ে পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় এলাকাগুলোতে পর্যটকরা যেতেও ভয় পাচ্ছেন।  

কক্সবাজার

মৌসুম ছাড়া দেশের প্রধান পর্যটন নগরী কক্সবাজার প্রায় পর্যটকশূন্য হয়ে পড়েছে। ফলে হোটেল-মোটেলে চলছে মন্দাভাব। দুশ্চিন্তায় পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। পর্যটকশূন্যতায় সৈকতসহ বিনোদন কেন্দ্রগুলো খাঁ খাঁ করছে। পর্যটক না থাকায় পর্যটন ব্যবসায় নেমেছে ধস।

রিসোর্ট ব্যবসায় জড়িত আলী আব্বাস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কক্সবাজারের ছোট-বড় ৫ শতাধিক আবাসিক হোটেলে-মোটেলে এক প্রকার সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে। হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোরও একই অবস্থা। পর্যটকশূন্যতার বড় প্রভাব পড়েছে কক্সবাজারের জনজীবনে।

জয়নাল আবেদীন নামে এক রেস্তোরাঁ মালিক জানান, পর্যটক খুবই কম। আর আমাদের ব্যবসাটাই হচ্ছে পর্যটনকেন্দ্রিক। দেশে চলমান পরিস্থিতিতে কক্সবাজারে পর‌্যটক আগের চেয়ে অনেক কম। হোটেল ব্যবসায়ী মো. তারেক জানান, আমাদের হোটেল-মোটেল ব্যবসার অবস্থা খারাপ।

সিলেট

কক্সবাজারের মতো সিলেটের পর্যটন শিল্পেও মন্দাভাব। এই অঞ্চলের পর‌্যটন এলাকাগুলো পর‌্যটক শূন্য। চলমান এই সংকট কাটাতে ব্যবসায়ীরা চান সরকারি প্রণোদনা। সরকারের সহযোগিতা না পেলে এ ব্যবসায় ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

পর্যটনশিল্পকে ঘিরে সিলেটে গড়ে উঠেছে কয়েক শ হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট ও গেস্ট হাউজ। এ ছাড়া পর্যটনের ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে এ অঞ্চলের রেস্টুরেন্ট, ট্রান্সপোর্ট ও কুটিরশিল্পে। পর্যটন কেন্দ্রগুলোকে কেন্দ্র করে স্থানীয় লাখো মানুষের জীবন-জীবিকার চাকা ঘোরে। কেউ নৌকা দিয়ে পর্যটক পরিবহন করে, আবার কেউ পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগে ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু ৫ আগস্টের পর পরিস্থিতির কারণে সিলেটবিমুখ হয়ে পড়েন পর্যটকরা।

রাঙামাটি

পর্যটকশূন্য হয়ে পড়েছে পাহাড়ও। প্রায় সবসময় পর্যটকের পদভারে পাহাড় উৎসবমুখর থাকলেও এবার ভিন্ন চিত্র। পর্যটকের কোনও ভিড় নেই সেখানে। নেই স্থানীয়দের আনাগোনা। তাই একেবারে শূন্য রয়েছে তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের পর্যটন কেন্দ্রগুলো। স্থবির হয়ে পড়েছে পর্যটক সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান। একই অবস্থা বিরাজ করছে রাঙামাটির শপিং মলগুলোতেও।

রাঙামাটি পর্যটন কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপক আলোক বিকাশ চাকমা সাংবাদিকদের বলেন, রাঙামাটি পর্যটন মোটেলে ২০ ভাগও বুকিং নেই। দেশের চলমান পরিস্থিতির জন্য বুকিং প্রায় বাতিল হয়ে গেছে। ঝুলন্ত সেতুতেও তেমন কোনও পর্যটক আসেনি। এক কথায় বলা যায়, ব্যবসা স্থবির।

কলাপাড়া (পটুয়াখালী)

প্রায় পর্যটকশূন্য অবস্থায় রয়েছে কুয়াকাটা। হোটেল ব্যবসায়ী সুমন দেব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আগের অবস্থা নেই আর। যেখানে বছরের প্রতিটা মৌসুমেই পর্যটকের ভিড় থাকতো, এখন নির্দিষ্ট সময় ছাড়া আর পর‌্যটক আসে না।

দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে এমন অবস্থা থাকবে বলেও জানান তিনি।

সার্বিক বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় ট্যুরিস্ট পুলিশ সদর দফতরে। সেখানকার লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া শাখা থেকে বলা হয়, বর্তমানে ট্যুরিস্ট পুলিশের কার্যক্রম দেশের ৪টি বিভাগে ১১টি রিজিয়নের আওতায় ৩২টি জেলায় ৪২টি জোনে পরিচালিত হচ্ছে। ট্যুরিস্ট পুলিশ এসব অঞ্চলের প্রায় ১৩০টি পর্যটন স্পটে নিয়মিতভাবে দায়িত্ব পালন করছে।

জনবল সীমিত হওয়া সত্ত্বেও ট্যুরিস্ট পুলিশের প্রতিটি সদস্য পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সার্বক্ষণিক নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। জনবল বৃদ্ধির বিষয়টি বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

তারা জানান, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ট্যুরিস্ট পুলিশে নতুন লজিস্টিক সহায়তা সংযুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে রেসকিউ ড্রোন ও পার্বত্য অঞ্চলে চলাচল উপযোগী যানবাহন সংগ্রহের জন্য এবং প্রশিক্ষিত জনবল তৈরির জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া আরও আধুনিক ও যুগোপযোগী কার্যকর সেবা প্রদান করার উদ্দেশ্যে ট্যুরিস্ট পুলিশে অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।

এছাড়া যেসব পর্যটন কেন্দ্র স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ বা সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে সেসব স্থানে ভ্রমণ না করার জন্য ট্যুরিস্ট পুলিশের পক্ষ থেকে পর্যটকদের অনুরোধ জানানো হয়েছে।

/এমএস/
সম্পর্কিত
লোকাল গার্মেন্টস ব্র্যান্ডের বিক্রি বাড়লেও টিকে থাকা কঠিন
দেশের অস্থিরতায় স্বস্তি নেই ফার্নিচার শিল্পে
ঝুঁকিতে রেস্তোরাঁ ব্যবসা, বন্ধ হচ্ছে প্রতিষ্ঠান
সর্বশেষ খবর
মাত্র ৩ উপকরণেই বানিয়ে ফেলা যায় ম্যাংগো আইসক্রিম
মাত্র ৩ উপকরণেই বানিয়ে ফেলা যায় ম্যাংগো আইসক্রিম
অবশেষে ডিএসসিসির প্রধান ফটকের তালা খুলে দিলেন ইশরাক সমর্থকরা
অবশেষে ডিএসসিসির প্রধান ফটকের তালা খুলে দিলেন ইশরাক সমর্থকরা
সাবেক সিইসি নুরুল হুদাকে ১০ দিনের রিমান্ডে চায় পুলিশ
সাবেক সিইসি নুরুল হুদাকে ১০ দিনের রিমান্ডে চায় পুলিশ
সালমান-আনিসুল-শাজাহানসহ রিমান্ডে ৫
সালমান-আনিসুল-শাজাহানসহ রিমান্ডে ৫
সর্বাধিক পঠিত
ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র সরবরাহে প্রস্তুত একাধিক দেশ: রাশিয়া
ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র সরবরাহে প্রস্তুত একাধিক দেশ: রাশিয়া
আমরণ অনশনের হুঁশিয়ারি আন্দোলনকারীদের, বৈঠক করবেন আসিফ নজরুল
আমরণ অনশনের হুঁশিয়ারি আন্দোলনকারীদের, বৈঠক করবেন আসিফ নজরুল
কর ফাঁকি: মৌসুমী-ফারিয়া-সাবিলা নূরসহ ২৫ তারকার ব্যাংক হিসাব জব্দ
কর ফাঁকি: মৌসুমী-ফারিয়া-সাবিলা নূরসহ ২৫ তারকার ব্যাংক হিসাব জব্দ
এক্সিম ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত এমডি আখতার হোসেনের পদত্যাগ
এক্সিম ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত এমডি আখতার হোসেনের পদত্যাগ
লালমনিরহাটে মহানবীকে কটূক্তির অভিযোগে সেলুনের কর্মী বাবা-ছেলে আটক
লালমনিরহাটে মহানবীকে কটূক্তির অভিযোগে সেলুনের কর্মী বাবা-ছেলে আটক