ধান উৎপাদনে রেকর্ড, তবুও অস্থির চালের বাজার

দেশে এ বছর রেকর্ড পরিমাণ বোরো ধান উৎপাদন হয়েছে। তবে কৃষক ও ভোক্তা কেউই এর সুফল পাচ্ছেন না। বোরোর উৎপাদনের সঙ্গে বাজার পরিস্থিতির মিল নাই। বোরোর এই ভরা মৌসুমেও বাজারে বাড়ছে চালের দাম। সরকারের পক্ষ থেকে নজরদারির অভাবের সুযোগ নিয়ে মোকামে সব ধরনের চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে মিলাররা। এর ফলে আড়ত থেকে শুরু করে খুচরা বাজার পর্যন্ত সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। চাল আমদানি ও অভ্যন্তরীণ ফলন ভালো হলেও বাজারে দাম বাড়তি। সরকার চালের বাড়তি দর নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে বলা হলেও ব্যর্থ হয়েছে। বাজার ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে।

জানা যায়, যখন কৃষকের হাতে বা গোলায় ধান থাকে তখন বাজারে ধানের দাম কম থাকে। ব্যবসায়ীদের হাতে যাওয়ার পর চালের দাম বাড়িয়ে তোলা হয়। মিলারদের কারসাজির মাধ্যমে বাজারে ধানের দাম কমিয়ে রাখা হয়। আর কৃষকের হাত থেকে ধান চলে গেলেই দাম বাড়ে চালের। এ বিষয়টি সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে বলে মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ক্যাবের হিসার মতে, গত এক বছরে বাজারে গড়ে চালের দাম বেড়েছে ১৫ শতাংশ। এর মধ্যে গত এক মাসে চিকন চালের দাম বেড়েছে ৫ শতাংশ, আর মাঝারি ও মোটা চালের দাম বেড়েছে ৯ শতাংশ। অভিযোগ রয়েছে, চালের মোকামগুলোয় মিলাররা কারসাজি করে চালের বাজারকে অস্থির করে তুলেছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট চালের প্রায় ৫৫ শতাংশ বোরো মৌসুমে উৎপাদন হয়। ফলন ভালো হলে সরবরাহ বাড়ে, আর বাজারে দাম কমে। এ বছর বোরোতে রেকর্ড ২ কোটি ১৪ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়েছে। তথ্য মতে, ২০১৯-২০ অর্থবছর দেশে বোরোর উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ৯৫ লাখ টন। ২০২০-২১ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৯৩ লাখ টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ কোটি টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২ কোটি ৫ লাখ টন। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছর বোরোর উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) তাদের বাজার দরের প্রতিবেদনে চালের দাম বৃদ্ধির তথ্য তুলে ধরেছে। টিসিবির তথ্য বলছে, গত এক মাসের ব্যবধানে নাজিরশাইল ও মিনিকেটের দাম ৫ দশমিক ২৬ শতাংশ, পাইজাম ও লতার দাম ৮ দশমিক ৭০ শতাংশ এবং ইরি ও স্বর্ণার দাম ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ বেড়েছে। বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, দাম বেড়েছে আরও বেশি। খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, এখন বাজারে চালের দাম বাড়ার কোনও কারণ নেই। এছাড়া, সরকারের গুদামেও যথেষ্ট পরিমাণে চাল মজুত আছে। চলতি অর্থবছরের শুরুতে সরকারের গুদামে চাল ও গমের মজুত রয়েছে ১৭ দশমিক ৬৪ লাখ মেট্রিক টন, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩ লাখ টন বেশি।

এদিকে চালের দাম বাড়তি প্রসঙ্গে রাজধানীর বাদামতলী ও বাবুবাজার চাল আড়ত মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিজামউদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দেশের ধান, চালের বাজার এখন অটো রাইচ মিল ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর দখলে। তারা বাজার থেকে প্রতিযোগিতা করে ধান কেনে। ফলে ধানের বাজার বাড়তি। এছাড়া বর্তমান আবহাওয়াও চাল উৎপাদনের জন্য উপযোগী নয়। এরও বিরূপ প্রভাব পড়েছে চালের বাজারে। তাই দাম বেড়েছে সব প্রকার চালের।’

তবে এর সঙ্গে দ্বিমত করেছেন ধান উৎপাদনকারী কৃষকরা। তাদের বক্তব্য, যদি প্রতিযোগিতা করে কেউ ধান কেনে তাহলে তো কৃষকদের লাভবান হওয়ার কথা। এ বছর কৃষক বোরো ধান উৎপাদন করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি ঠিক, কিন্ত অধিক মুনাফা তো পায়নি। 

রাজধানীর বিভিন্ন পাড়া মহল্লার খুচরা ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, দেশের প্রত্যন্ত এলাকার মোকামগুলোতেই চালের দাম বেড়েছে। সেখানে চালকল মালিকরা ঈদের পর কারবার চাঙা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দাম বাড়িয়েছেন, যে কারণে চালের দাম এখন বেশি। কোরবানির ঈদের পর প্রতি বস্তা চালের দাম সর্বোচ্চ বেড়েছে ৪০০ টাকা পর্যন্ত। ঈদের আগের তুলনায় বর্তমানে প্রতিকেজি চাল মানভেদে ২ থেকে ৮ টাকা টাকা বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। এখন খুচরায় প্রতি কেজি মোটা চাল বিআর-২৮, পারিজা মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ৫৮ থেকে ৬৫ টাকা দরে। সরু চালের মধ্যে জিরাশাইলের কেজি ৭৪ থেকে ৮০ টাকা এবং মিনিকেট ৭৬ থেকে ৮৪ টাকা। কাটারিভোগ বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৬ টাকা কেজি দরে।

কৃষকরা জানিয়েছেন, ভরা মৌসুমে যখন চালের দাম কমে যাওয়ার কথা, তখনই চালের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। রাজধানীসহ সারা দেশের বাজারে হঠাৎ কেজিপ্রতি ৪ থেকে ৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে বিভিন্ন জাতের চালের দাম। এতে সাধারণ ভোক্তারা যেমন চাপের মুখে পড়েছেন, তেমনি হতাশ কৃষকরাও। এখন চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখী দেখে অনেক কৃষক মনে করছেন তারা ঠকেছেন।

এ পরিস্থিতিতে চালের বাজার ‘সিন্ডিকেট’ ও ‘করপোরেট দখল’ এমন অভিযোগ তুলে জয়পুরহাটের ব্যবসায়ী, চালকল মালিকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ অটো, মেজর ও হাস্কিং মিল মালিক সমিতি’র সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী বলেন, ‘বাজারে ধানের দাম বেশি। এ কারণে চালের দাম বাড়ছে। গত তিন সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতিকেজি চালে পাঁচ থেকে ছয় টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।’

তিনি বলেন, ‘বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতা করে বাজার থেকে হাজার হাজার মণ ধান কিনেছে। সরকার তাদের কিছুই বলে না। অথচ সাধারণ মিলাররা ৫০০ মণ ধান কিনলেই সরকার ব্যবস্থা নেয়। বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে সাধারণ মিলাররা চাল ব্যবসা ছেড়ে দিচ্ছেন। হাটবাজারগুলোতে এখন ধানের সরবরাহ কমে গেছে। দামও বেশি। তাই চালের দাম কমার সম্ভাবনা কম। তবে সরকারি-বেসরকারিভাবে চাল আমদানি করলে বাজার স্থিতিশীল থাকবে বলে আশা করি।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাটোরের কৃষক তোফাজ্জেল হোসেন টেলিফোনে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চালের বাজারে অস্থিরতা নিরসনে সরকার কিছু উদ্যোগ নিলেও ফল এখনও দৃশ্যমান নয়। প্রতিনিয়তই চালের দাম বাড়ছে। এখানে কৃষকদের কোনও হাত নাই। মোকামে ধানের দাম বেশি বলে শুনেছি। ধানের দাম বেশি হলে চালের দাম বাড়তি থাকবে এটাই স্বাভাবিক।’

জানতে চাইলে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির বলেন, ‘সবই মিলারদের সাজানো কারসাজি। তারাই চালের বাজারকে নিজেদের সুবিধামতো অস্থির করে তোলে। কৃষকের হাতে যখন ফসল থাকে তখন দাম কমিয়ে রাখা হয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষক। আবার যখন কৃষকের হাত থেকে পণ্য চলে যায় তখন দাম বাড়িয়ে ভোক্তাকে ক্ষতির মুখে ফেলা হয়। সরকার এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।’

এ প্রসঙ্গে কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘চাল আমদানি ও অভ্যন্তরীণ ফলন ভালো হলেও বাজারে দাম বাড়তি। সরকার চালের বাড়তি দর নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে। গত বছরের তুলনায় এবার বোরো উৎপাদন ১৫ লাখ টন বেশি হয়েছে। তবু বাজারে চালের দাম বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি।’

তিনি আরও বলেন, ‘কৃষকের ফসল মধ্যস্বত্বভোগীদের হাত থেকে রক্ষায় এবার সরকার কৃষকদের কাছ থেকে ফসল কেনার নির্ধারিত সময় ১৫ দিন এগিয়ে এনেছে। তবে আমাদের সমস্যা হচ্ছে দুর্নীতি। এটা রোধ করা গেলে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব।’

শুক্রবার (৪ জুলাই) রাজধানীর খুচরা বাজারে মানভেদে প্রতিকেজি মোটা চাল; ইরি বা স্বর্ণা ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, মাঝারি মানের চাল পাইজাম বা লতা ৬০ থেকে ৬৭ টাকা এবং সরু চাল নাজিরশাইল বা মিনিকেট ৭৫ থেকে ৮৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। যা সপ্তাহের ব্যবধানে মানভেদে কেজিতে তিন থেকে পাঁচ টাকা বেশি।