চাঙা হয়ে উঠেছে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ তিন সূচক

বৈশ্বিক সংকটের মধ্যেও পোশাক রফতানিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রধান বাজারগুলোতে আবারও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বাংলাদেশ। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি বেড়েছে ৪৫ শতাংশ। এছাড়া এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক পণ্যের রফতানি বৃদ্ধি পেয়েছে ৬০ দশমিক ৩০ শতাংশ। শুধু ইউরোপ-আমেরিকা নয়, সার্বিকভাবে বাংলাদেশ থেকে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রফতানি বেড়েছে ১৪ দশমিক ৭২ শতাংশ। আর জুনে রফতানি প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৭ দশমিক ১৯ শতাংশ।

অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক কেবল রফতানিতেই নয়, অর্থনীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক প্রবাসী আয়েও গতি বেড়েছে। জুলাইয়ের পর চলতি আগস্টেও ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আগস্টের প্রথম ২৯ দিনে ১৯০ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। বাকি দুই দিনে আরও অন্তত ১০ কোটি ডলারের বেশি আসবে বলে ধারণা করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। এদিকে অর্থনীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি তরতর করে বাড়ছে। গত জুলাইয়ে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ। গত জুন শেষে যা ছিল ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, নতুন করে কিছু বিনিয়োগসহ বিভিন্ন কারণে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে।

রেমিট্যান্স প্রবাহে জোয়ার

অতীতের মতো আবারও দেশের সংকটের সময় বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়ে অর্থনীতির চাকা সচল রাখছেন প্রবাসীরা। বৈশ্বিক সংকট ও দেশের অভ্যন্তরে নানা উদ্বেগ- উৎকণ্ঠার মধ্যেও তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিতে স্বস্তির বার্তা দিচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে জুলাইয়ের পর দ্বিতীয় মাস আগস্টেও ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। চলতি আগস্ট মাসের ২৯ দিনে ১৯০ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। বাকি দুই দিনে আরও অন্তত ১০ কোটি ডলার আসবে বলে ধারণা করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আশা করছি, গত জুলাই মাসের মতো চলতি আগস্ট মাসেও দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স আসবে।’ তিনি বলেন, ‘চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই রেমিট্যান্সের ইতিবাচক ধারা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আশা করছি, বছরের বাকি ১০ মাসেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ‘গত বছরের পুরো আগস্ট মাসে ১৮১ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই মাসে ২০৯ কোটি ৬৯ লাখ ১০ হাজার ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল গত ১৪ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আর গত বছরের জুলাই মাসের চেয়ে বেশি ছিল ১২ শতাংশ।’

যদিও ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবাসী আয়ে মন্দা দেখা দেয়। পুরো অর্থবছরে ২ হাজার ১০৩ কোটি (২১.০৩ বিলিয়ন) ডলার আসে। আর প্রবাসী আয়ে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় উল্লম্ফন ঘটে ২০২০-২১ অর্থবছরে। সে সময় ২ হাজার ৪৭৮ কোটি (২৪.৭৮ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা।

 

বাড়ছে রফতানি আয়

চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি বেড়েছে ৪৫ শতাংশ। এছাড়া এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক পণ্যের রফতানি বৃদ্ধি পেয়েছে ৬০ দশমিক ৩০ শতাংশ।

বাংলাদেশ থেকে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৩৯৮ কোটি ৪৮ লাখ ২০ হাজার ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় যা বেড়েছে ১৪ দশমিক ৭২ শতাংশ। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২১-২২ অর্থবছর প্রথমবারের মতো ৫০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক পেরিয়ে ৫২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করে দেশ।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রবৃদ্ধিতে বরাবরের মতোই অবদান বেশি রেখেছে তৈরি পোশাক পণ্য। গত মাসে এ খাতে রফতানি হয়েছে ৩৩৬ কোটি ৬৯ লাখ ১০ হাজার ডলারের। এ হিসেবে মোট রফতানির ৮৪ দশমিক ৪৯ শতাংশই পোশাক পণ্য। আর গত অর্থবছরের জুলাইয়ের তুলনায় এ পণ্যটির রফতানি বেড়েছে ১৬ দশমিক ৬১ শতাংশ।

এদিকে ইউরোপীয় পরিসংখ্যান সংস্থা ইউরোস্ট্যাট এর তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পোশাক পণ্য আমদানি ৪৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ বেড়েছে। এ সময় পর্যন্ত আমদানি হয়েছে ৯৫৮ কোটি ডলারের পোশাক। এতে বৈশ্বিক পোশাক আমদানি বাড়ে ২৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ।

এদিকে এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক পণ্যের রফতানি ৬০ দশমিক ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশটিতে ৫০১ কোটি ৯০ লাখ ৭ হাজার ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ পরিচালক মো. মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের আমদানির পরিসংখ্যান ইইউ বাজারে বাংলাদেশের পোশাকের ভালো অবস্থান নির্দেশ করে।’

 

বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, অনেকেই নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। আবার অনেকে উৎপাদনক্ষমতা বাড়াচ্ছেন। সুদের হার কম হওয়ায় চলতি বছর আবাসন, গাড়ি ও ব্যক্তিগত ঋণও বেড়েছে। এছাড়া গত চার মাসে ডলারের দাম ২০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। ফলে আমদানিকারকদের ঋণপত্রের মূল্য বেড়ে গেছে। এতে ঋণও বাড়ছে। সব মিলিয়ে  জুলাই শেষে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বেসরকারি খাতের ঋণ বেড়ে হয়েছে ১৩ লাখ ৫২ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা।

যদিও ঘোষিত মুদ্রানীতিতে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতের ঋণে প্রবৃদ্ধি ধরা রয়েছে ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ। ফলে মুদ্রানীতির ঋণ প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্য, সেটি এরই মধ্যে ছাড়িয়ে গেছে। এতো মূল্যস্ফীতির পরও গ্রাহকেরা বেশি ঋণ নিচ্ছেন। কারণ, ঋণের সুদহার এখনও ৯ শতাংশের মধ্যে রয়েছে।

ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, করোনা-পরবর্তী বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধির মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে অধিকাংশ পণ্যের দর বেড়েছে। যে কারণে এখন সব পর্যায়ে খরচ বেড়েছে। এ সময়ে নতুন করে অনেকে বিনিয়োগও করছেন। সাধারণভাবে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কের ঘরে থাকলেও ২০১৯ সালের নভেম্বরে প্রথমবারের মতো তা নেমে আসে ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশে। করোনাভাইরাসের প্রভাব শুরুর পর ব্যাপক কমে ২০২০ সালের মে শেষে প্রবৃদ্ধি নামে ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে। তবে পরের মাস জুন থেকে একটু করে বাড়তে থাকে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১ সালের জুলাই থেকে গত জুলাই পর্যন্ত বেসরকারি খাতে সর্বোচ্চ ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এ সময়ে ঋণ বিতরণ হয়েছে ১ লাখ ৬৫ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা। আগের দুই বছরে গড়ে ৯০ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল।