পরিবেশবান্ধব কারখানায় বাংলাদেশ এখন বিশ্বে রোল মডেল

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে যুক্ত হলো নতুন এক গৌরবময় অধ্যায়। গাজীপুরের কাশিমপুরে অবস্থিত তাসনিয়া ফেব্রিক্স লিমিটেডের অ্যাডমিন ভবন অর্জন করেছে বিশ্বের সর্বোচ্চ রেটের লিড সনদপ্রাপ্ত ভবনের মর্যাদা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি) প্রদত্ত এই সনদ অনুযায়ী ভবনটি লিড ভি৪ রেটিং সিস্টেমে পেয়েছে ১০৭ পয়েন্ট, যা এখনও পর্যন্ত বিশ্বে সর্বোচ্চ।

এর আগে এস.এম সোরসিং ১০৬ পয়েন্ট পেয়ে শীর্ষে ছিল। এবার সেই রেকর্ড ভেঙে নতুন দিগন্তে পৌঁছেছে তাসনিয়া ফেব্রিক্স।

সম্প্রতি আরও দুটি কারখানা লিড সার্টিফায়েড তালিকায় যুক্ত হয়েছে— তাসনিয়া ফেব্রিক্সের নিজস্ব আরএমজি বিল্ডিং (১০৬ পয়েন্ট) এবং টাঙ্গাইলের গরইয়ে অবস্থিত কমফিট গোল্ডেন লিফ (৮০ পয়েন্ট)। তিনটি কারখানাই প্লাটিনাম স্তরের সনদ পেয়েছে।

এর ফলে দেশে লিড সার্টিফায়েড পোশাক কারখানার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৪৩টিতে। এর মধ্যে ১০১টি প্লাটিনাম এবং ১২৮টি গোল্ড সার্টিফায়েড। শুধু তাই নয়, বিশ্বের শীর্ষ ১০০ সবুজ কারখানার মধ্যে ৬৮টিই এখন বাংলাদেশের। এটি দেশের পরিবেশবান্ধব শিল্পায়নের এক অনন্য মাইলফলক।

বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিবেশবান্ধব কারখানা স্থাপনায় বাংলাদেশ এখন বৈশ্বিক রোল মডেল। একের পর এক গ্রিন ফ্যাক্টরি গড়ে তোলা ও সর্বোচ্চ মান রক্ষার মাধ্যমে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পে পরিবেশবান্ধব রূপান্তরের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

সবুজ কারখানার অর্থনৈতিক সুবিধাও চোখে পড়ার মতো

শিল্প উদ্যোক্তারা জানান, পরিবেশবান্ধব কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের গায়ে ‘গ্রিন ট্যাগ’ যুক্ত থাকে, যা বিদেশি ক্রেতাদের কাছে বাড়তি আস্থা তৈরি করে। ফলে এসব পণ্য দরকষাকষিতে সুবিধা পায় এবং দেশের ব্র্যান্ড ইমেজও সমৃদ্ধ হয়।

মূলত, বিশ্বের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান পরিবেশবান্ধব স্থাপনার সনদ দিয়ে থাকে। তাদের মধ্যে একটি যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল-ইউএসজিবিসি। তারা ‘লিড’ নামে পরিবেশবান্ধব স্থাপনার সনদ দিয়ে থাকে। লিড হলো লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন।

সাধারণ কারখানা বা স্থাপনার তুলনায় পরিবেশবান্ধব স্থাপনায় গড়ে ৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি ব্যয় হয়। এছাড়া লিড সনদ পেতে একটি ভবনকে নির্মাণের প্রতিটি স্তরে অন্তত ৯টি কঠোর পরিবেশগত শর্ত পূরণ করতে হয়। এ ধরনের সনদ শুধু নতুন ভবনের ক্ষেত্রেই নয়, পুরনো ভবন সংস্কারের পরও অর্জন করা যায়।

১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ইউএসজিবিসি বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত একটি প্রতিষ্ঠান, যারা নির্মাণকাজে পরিবেশ ও জ্বালানির টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করে ‘সবুজ ভবনের’ মান নির্ধারণ করে। তাদের তত্ত্বাবধানে নির্মাণ, কার্যক্রম ও রক্ষণাবেক্ষণ পর্যায়ে সর্বোচ্চ মান রক্ষা করলেই এই সনদ মেলে।

সবুজ কারখানার স্বীকৃতিপ্রাপ্ত একটি গার্মেন্টস কারখানা, ছবি: সংগৃহীতরফতানিতে ইতিবাচক প্রভাব

গার্মেন্টস খাতের একাধিক উদ্যোক্তা জানান, বাংলাদেশে গ্রিন ফ্যাক্টরির স্বীকৃতি বাড়ার কারণে  প্রচলিত বাজার তথা ইউরোপ ও আমেরিকার বাইরে নতুন বাজারগুলো থেকে বাড়তি অর্ডার আসছে। এতে সার্বিকভাবে রফতানি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। আর এই পোশাক রফতানির ওপর ভর করে দেশের অর্থনীতিও জোর কদমে এগিয়ে চলেছে।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, গার্মেন্ট খাতে বহুমুখী সমস্যা থাকার পরও চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) দেশের সামগ্রিক রফতানি খাতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ইপিবির তথ্য বলছে, জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে নিট পোশাক রফতানি বেড়েছে ১০ দশমিক ৭৪ শতাংশ (১৭ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার) এবং ওভেন পোশাক বেড়েছে ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ (১৫ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার)। শুধু তাই নয়, চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত রফতানি আয় ছিল ঈর্ষণীয়।

ইপিবির তথ্য বলছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মার্চ মাসে বাংলাদেশের পণ্য রফতানি আয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪.২৫ বিলিয়ন ডলারে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১১.৪৪ শতাংশ বেশি। তৈরি পোশাক খাতের ধারাবাহিক শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির ফলে এই অর্জন সম্ভব হয়েছে বলে জানিয়েছে  ইপিবি।

ইপিবির সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জুলাই-মার্চ সময়কালে মোট রফতানি আয় দাঁড়িয়েছে ৩৭.১৯ বিলিয়ন ডলারে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের ৩৩.৬১ বিলিয়নের তুলনায় ১০.৬৩ শতাংশ বেশি।

এই ৯ মাসে তৈরি পোশাক খাত এককভাবে ৩০.২৫ বিলিয়ন ডলারের রফতানি আয় করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১০.৮৪ শতাংশ বেশি। মার্চ মাসেই খাতটি ১২.৪০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, এতে আয় হয়েছে ৩.৪৫ বিলিয়ন ডলার। আগের বছরের মার্চে এর পরিমাণ ছিল ৩.০৭ বিলিয়ন ডলার।

সবুজায়নে বিশ্বে স্বীকৃত বিজিএমইএ

সবুজ কারখানায় বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)। ২০২১ সালে সবুজায়নে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ইউএসজিবিসির পক্ষ থেকে ‘লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড’ অর্জন করে বিজিএমইএ। বৈশ্বিক পোশাক শিল্পে এ ধরনের স্বীকৃতি এটাই প্রথম এবং বিজিএমইএ-ই একমাত্র সংগঠন, যারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে এমন সম্মান পেয়েছে।

বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব কারখানার সূচনা ২০১২ সালে

বাংলাদেশে সবুজ কারখানার পথচলা শুরু হয় ২০১২ সালের মে মাসে পাবনার ঈশ্বরদী ইপিজেডে। সে বছরই উদ্যোক্তা সাজ্জাদুর রহমান মৃধার প্রতিষ্ঠিত ‘ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও’ বিশ্বের প্রথম এলইইডি প্লাটিনাম সার্টিফায়েড পোশাক কারখানার স্বীকৃতি পায়। এই কারখানাকে ঘিরেই দেশে পরিবেশবান্ধব শিল্প স্থাপনার নতুন ধারা সূচিত হয়।

রানা প্লাজার ধস ও টার্নিং পয়েন্ট

২০১৩ সালে সাভারে রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় ১ হাজার ১৩৪ জন শ্রমিক নিহত ও কয়েক হাজার আহত হওয়ার পর শিল্পে নিরাপত্তা ও পরিবেশ সচেতনতা নাটকীয়ভাবে বাড়ে। সে সময় থেকে উদ্যোক্তারা নিরাপদ, কর্মবান্ধব ও পরিবেশবান্ধব শিল্প গড়ে তুলতে ব্যাপক বিনিয়োগ শুরু করেন।

ক্রমবর্ধমান সবুজ কারখানার সংখ্যা

২০১৪ সালে দেশে লিড সনদপ্রাপ্ত সবুজ কারখানার সংখ্যা ছিল মাত্র ৩টি। ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১টিতে। এরপর ধারাবাহিকভাবে—২০১৬ সালে ১৬টি, ২০১৭ সালে ১৮টি, ২০১৮ সালে ২৪টি, ২০১৯ সালে ২৮টি, ২০২০ ও ২০২১ সালে প্রতি বছর ২৪টি করে মোট ৪৮টি কারখানা গড়ে তোলা হয়।

এই ধারাবাহিক অগ্রগতির ফলে ২০২৫ সালের শুরুতে দেশে এলইইডি সনদপ্রাপ্ত সবুজ পোশাক কারখানার সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪৩টি, যার মধ্যে ১০১টি প্লাটিনাম ও ১২৮টি গোল্ড সার্টিফায়েড।

ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের দেওয়া সনদের বিভিন্ন ক্যাটাগরি, ছবি: সংগৃহীত‘সবুজ কারখানাই টেকসই প্রবৃদ্ধির দিকনির্দেশনা’

শিল্প উদ্যোক্তারা জানান, পরিবেশবান্ধব (সবুজ) কারখানা মানে বিশ্ববাজারে ক্রেতার কাছে আলাদা কদর পাওয়া। সবুজ কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের গায়ে ‘গ্রিন ট্যাগ’ যুক্ত থাকে। অর্থাৎ পণ্যটি সবুজ কারখানায় উৎপাদিত হওয়ায় বিদেশি ব্র্যান্ড এবং ক্রেতার কাছে আস্থা তৈরি হয়। আবার এসব কারখানায় উৎপাদিত পণ্য নিয়ে ক্রেতার সঙ্গে দরকষাকষিও করা যায়। এসব কারখানা দেশ ও পোশাক খাতের ব্র্যান্ড ইমেজ বাড়াতে সহায়তা করে।

এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক ও ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের অ্যাডিশনাল এমডি মহিউদ্দিন রুবেল বাংলা ট্রিবিউনের বলেন, ‘এটি একটি ঐতিহাসিক অর্জন, যা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের পরিবেশবান্ধব রূপান্তরের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এটি কেবল টেকসই প্রবৃদ্ধির পথ দেখায় না, বরং বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল করে এবং নতুন বাজার ও মূল্য সংযোজনের সুযোগ তৈরি করে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা যে উদ্ভাবন ও দূরদর্শিতার পথে এগিয়ে চলেছেন, এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি তারই বাস্তব প্রতিফলন।’

বিশ্বব্যাপী যখন ইএসজি মানদণ্ড—অর্থাৎ পরিবেশ, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও সুশাসনকে ক্রমেই অধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, তখন এমন অর্জন বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতকে বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনে আরও গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ভরযোগ্য অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

রুবেল বলেন, ‘এটি কেবল একটি রেটিং বা সনদ নয়, বরং সবুজ শিল্পায়নের পথে বাংলাদেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে, তার একটি শক্তিশালী দিকনির্দেশনা ও প্রতিশ্রুতি।’

তিনি উল্লেখ করেন, একসময় অনেকে ভাবতেন এত খরচ করে লিড সার্টিফিকেট নেওয়ার প্রয়োজন কী। এখন সবাই বুঝতে পারছেন, সাসটেইনেবল হতে গেলে এর কোনও বিকল্প নেই। তিনি বলেন, ‘সারা বিশ্ব যখন টেকসই উন্নয়ন, পরিবেশ সুরক্ষা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার দিকে মনোযোগী, তখন বাংলাদেশ তৈরি পোশাক খাত পরিবেশবান্ধব রূপান্তরের মাধ্যমে শুধু নিজেকে নয়, গোটা শিল্প খাতকেই বিশ্বদরবারে একটি আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। লিড সনদপ্রাপ্ত কারখানার সংখ্যায় এগিয়ে থাকা বাংলাদেশ এখন নির্দ্বিধায় বলা যায় সবুজ কারখানার গর্বিত রোল মডেল।’