গতি ফিরছে না অর্থনীতিতে, চ্যালেঞ্জে নতুন বাজেটও

গত বছরের জুলাইয়ে গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার প্রায় এক বছর পূর্ণ হতে চললেও অর্থনীতির গতি ফেরেনি। মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগ স্থবিরতা, কর্মসংস্থান সংকট, রফতানি হ্রাস এবং রাজস্ব ঘাটতিতে অর্থনীতি এখনও নানা অনিশ্চয়তায় ঘেরা। এমন এক প্রেক্ষাপটে সামনে এসেছে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট— যার আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা।

অর্থ মন্ত্রণালয় বাজেট প্রস্তুতির আগে চিহ্নিত করেছে আটটি বড় চ্যালেঞ্জ—মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা, সামাজিক সুরক্ষা জোরদার, রাজস্ব আয় বাড়ানো, বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়ন এবং এলডিসি উত্তরণে প্রস্তুতি।

অর্থ বিভাগ জানিয়েছে, নতুন বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ভাতা ও উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনাও রয়েছে।

মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয়

দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। খাদ্য ও জ্বালানি খাতে অস্বাভাবিক দাম বাড়ায় জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে উঠেছে। আসন্ন বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পরিকল্পনা থাকলেও তা সামগ্রিক চাপ থেকে মানুষকে মুক্তি দেবে না—এমনটাই আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের।

বিনিয়োগ স্থবির, বাড়ছে বেকারত্ব

নতুন বিনিয়োগ বন্ধ, পুরনো বিনিয়োগে স্থবিরতা এবং শিল্প উৎপাদনে স্থবিরতা দেশের অর্থনৈতিক গতি রুদ্ধ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানিতে এলসি খোলা ৩০ শতাংশ কমেছে। অর্থাৎ উদ্যোক্তারা নতুন প্রকল্পে আগ্রহ হারাচ্ছেন। অপরদিকে, গত এক বছরে বেকার বেড়েছে সোয়া ৩ লাখ, যার একটি বড় অংশ শিল্প খাতনির্ভর শ্রমিক।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, দেশে বর্তমানে বেকার সংখ্যা ২৭ লাখ ৩০ হাজার—যা এক বছরে বেড়েছে সোয়া তিন লাখ। শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ কমে দাঁড়িয়েছে ৪৮.৪১ শতাংশে। অন্যদিকে, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি এলসি ৩০ শতাংশ এবং নিষ্পত্তি ২৫ শতাংশ কমেছে, যা বিনিয়োগ স্থবিরতার ইঙ্গিত দেয়।

বিদেশে শ্রমিক পাঠানোও হ্রাস পেয়েছে ২২ শতাংশ। ২০২৩ সালে যেখানে ১৩ লাখ কর্মী বিদেশে গিয়েছিল, ২০২৪ সালে তা নেমে এসেছে ১০ লাখ ১১ হাজারে। মালয়েশিয়া, কুয়েত, ইতালির মতো বাজার আংশিকভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়াই এই পতনের বড় কারণ। অবশ্য বিদেশে শ্রমিক পাঠানো কমলেও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে। গত মার্চে রেমিট্যান্স বেড়ে ৩২৯ কোটি ডলারে পৌঁছেছে, যা মাসিক ভিত্তিতে রেকর্ড। পরের মাস এপ্রিলে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৫ শতাংশ বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের এপ্রিলে প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন ২ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। গত বছরের এপ্রিলে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ২ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলার।

বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। অথচ চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে এনবিআর আদায় করেছে মাত্র ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব বাড়াতে শুল্কছাড় ও কর অব্যাহতি হ্রাস, নতুন খাতে কর আরোপ এবং অটোমেশনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

সরকারের ঋণের পরিমাণ বর্তমানে ১৮ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। বাজেট বাস্তবায়নে আরও ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। শুধু সুদ পরিশোধেই ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ২০ হাজার কোটি টাকা বেশি। তবে ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকায় নামানোর পরিকল্পনা রয়েছে, ফলে বাজেট ঘাটতি নেমে আসবে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটিতে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজেটের আকার উচ্চাভিলাষী হলেও বাস্তবায়নে প্রয়োজন বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘বর্তমান বাস্তবতায় বাজেট আরও ছোট হলে তা বাস্তবায়নযোগ্য হতো।’’

সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “ভিত্তি সম্প্রসারণ করে প্রত্যক্ষ কর আদায় বাড়ানো, শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার এবং বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর লক্ষ্যে বাজেট প্রণয়ন করতে হবে।”

বৈদেশিক বাণিজ্যে নতুন ঝুঁকি

যুক্তরাষ্ট্রে পাল্টা শুল্ক, ভারতের পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা এবং বৈশ্বিক বাজারের অনিশ্চয়তা রফতানির ওপর চাপ তৈরি করেছে। আখাউড়া স্থলবন্দরের মতো কিছু সীমান্ত বাণিজ্য পথ কার্যত অচল হয়ে পড়েছে, যেখানে রফতানি ৪০ শতাংশ কমে গেছে।

গত পাঁচ দিনে লোকসান হয়েছে প্রায় ২ কোটি টাকা। আর যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ প্রায় ১০০টি পণ্যে আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারের চিন্তা করছে।

আইনশৃঙ্খলা ও অনিরাপদ বিনিয়োগ পরিবেশ ব্যবসায়ীরা বলছেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, চাঁদাবাজি, প্রতারণা ও সাইবার হুমকি তাদের বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করছে। ঢাকা চেম্বারের ভাষ্য হচ্ছে—বিনিয়োগের আগে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারলে অর্থনীতি চিরতরে নিম্নমুখী হয়ে যেতে পারে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিনিয়োগে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি। চাঁদাবাজি, প্রতারণা ও সাইবার হুমকিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ী নেতারা। জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করেছে।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, ‘চাঁদাবাজি, প্রতারণা ও সাইবার হুমকির কারণে বিনিয়োগকারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। ব্যবসার সুরক্ষায় ফাস্ট-ট্র্যাক অভিযোগ নিষ্পত্তি এবং ই-কমার্স নিরাপত্তা ইউনিট গঠন জরুরি।’

এমন বাস্তবতায় সরকারের লক্ষ্য সংকট নিরসনের বাস্তবভিত্তিক রোডম্যাপ, যার মাধ্যমে বাণিজ্য সম্প্রসারণ, বিনিয়োগ সুরক্ষা, শ্রমবাজার পুনরুদ্ধার ও রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার সম্ভব হবে কিনা, তা নির্ভর করবে কার্যকর বাস্তবায়নের ওপর।