কতটা বড় হলো ঈদ অর্থনীতি

বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা, এখন আর শুধু ধর্মীয় অনুভূতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়—এটি হয়ে উঠেছে এক বিশাল মৌসুমি অর্থনীতির চাকা। অর্থনীতিবিদদের ভাষায়, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ ‘ঈদ ইকোনমি’— যা দেশের কৃষি, পশুপালন, চামড়া শিল্প, পরিবহন, খুচরা বিপণন, নগরভিত্তিক ভোগব্যয় এবং আন্তর্জাতিক রেমিট্যান্সের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ঈদুল আজহাকে ঘিরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মিলিয়ে অন্তত এক লাখ কোটি টাকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ঘটে, যার অভিঘাত পড়ে মফস্বলের গরুর খামার থেকে শুরু করে রাজধানীর ফ্যাশন স্টোর পর্যন্ত। ঘরমুখো মানুষের স্রোত, গরু-ছাগল কেনাবেচা, মসলা ও খাবারের বাজার, পোশাক ও উপহার কেনাকাটা— সব মিলিয়ে ঈদ ঘিরে দেশের অর্থনীতিতে প্রবাহিত হয় হাজার হাজার কোটি টাকা।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন এ প্রসঙ্গে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঈদের অর্থনীতির প্রকৃত আকার নির্ধারণ কঠিন হলেও স্পষ্টতই বলা যায়, এবারের ঈদে ঢাকা ছাড়া মানুষের সংখ্যা আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে বেশি হতে পারে। বেশ ভালো পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেই মানুষ গ্রামে যাচ্ছে। কারণ, গত রোজার ঈদে যাতায়াতে তেমন ভোগান্তি হয়নি, যা মানুষকে আবারও উৎসাহিত করেছে।’

তিনি বলেন, ‘ঈদে সরকারি-বেসরকারি খাতের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বোনাস পান, যা সরাসরি ভোক্তা ব্যয়ে চলে যায়। পোশাক শ্রমিকরাও বোনাসের টাকা খরচ করেন নতুন পোশাক, উপহার বা যাত্রা খাতে। এছাড়া, পশু কেনাবেচা, কোরবানির সরঞ্জাম যেমন- দা, ছুরি, চাপাতি এবং মশলা কেনাকাটার হার বেড়ে যায়। ফলে পুরো বাজারেই একটা উত্তেজনা তৈরি হয়।’

ড. জাহিদ হোসেন আরও বলেন, ‘ঈদ সামনে রেখে রেমিট্যান্স প্রবাহও বেড়ে যায়। প্রবাসীরা গ্রামে থাকা স্বজনদের খরচের জন্য অতিরিক্ত অর্থ পাঠান। এটি রিজার্ভ বৃদ্ধিতেও সহায়ক ভূমিকা রাখে।’

এদিকে, ঈদের সময় পশু পরিবহন এবং মানুষের যাতায়াত— এই দুই মিলিয়ে পরিবহন খাতে ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। একদিকে ট্রেন, বাস, লঞ্চ, প্রাইভেট যানবাহনে বাড়তি ভাড়া, অপরদিকে পশু পরিবহনে খরচ যুক্ত হয়ে মোট লেনদেনের অঙ্ক দাঁড়ায় হাজার কোটি টাকায়।

৪০ হাজার কোটি টাকার গবাদিপশুর বাজার

২০২৫ সালের ঈদে কোরবানির জন্য দেশের ৬৪ জেলায় মজুত পশুর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৫ লাখ। এর মধ্যে গরু ও মহিষ ৪৫ লাখ, ছাগল ও ভেড়া ৫৫ লাখ, অন্যান্য ৫ লাখ। গড়ে একটি গরুর মূল্য ধরা হচ্ছে ৭৫ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা এবং ছাগল-ভেড়ার মূল্য ১২-১৫ হাজার টাকা— এই হিসাবে কেবল পশু বিক্রি থেকেই ৩৫ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হওয়ার সম্ভাবনা। এতে প্রায় ৮০ লাখ মানুষ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে যুক্ত। যেমন- খামারি, পশু খাদ্য বিক্রেতা, প্রাণি চিকিৎসক, পরিবহন শ্রমিক, হাট ইজারাদার ও কৃষিজ শ্রমিক।

ঈদের আগাম বার্তা

গ্রামের পশু খামার, শহরের হাট, ট্রান্সপোর্ট নেটওয়ার্ক, মোবাইল ব্যাংকিং, চামড়া শিল্প এবং শহুরে ভোগবিলাস— সবকিছু মিলিয়ে ঈদুল আজহা ঘিরে তৈরি হয় একটি একীভূত বাজার ব্যবস্থা। এই বাজারে কেবল একটি জিনিস বিক্রি হয় না, আর সেই জিনিসটি হচ্ছে সম্ভাবনার শৃঙ্খলিত ব্যবহার।

পশুখাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবা খাতে ঈদে বাড়তি ২-৩ হাজার কোটি টাকার বাজার

কোরবানির ঈদকে ঘিরে গরু-ছাগল মোটাতাজাকরণ ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় দেশের পশুপালন খাতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে হাজার হাজার কোটি টাকার বাজার। বছরের অন্য সময়েও খামারিরা পশুর পরিচর্যায় ব্যস্ত থাকেন, তবে ঈদের সময় এই খাতের ব্যয় বহুগুণ বেড়ে যায়। পশুর খাবার, ওষুধ, ভ্যাকসিন এবং খামার সহকারী বা শ্রমিকদের পারিশ্রমিক— সব মিলিয়ে তৈরি হয় একটি বিশাল অর্থনৈতিক চক্র।

বিশেষজ্ঞ ও খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পশুখাদ্য ও পশুস্বাস্থ্যসেবা খাতে এবার ঈদকে কেন্দ্র করে প্রায় ২ থেকে ৩ হাজার কোটি টাকার বাজার গড়ে উঠেছে।

একটি গরুর জন্য মাসে ৫ হাজার টাকার খাবার

খামারিরা বলছেন, কোরবানির জন্য উপযুক্ত গরু তৈরি করতে সাধারণত ৬ মাস থেকে ১ বছর সময় ধরে লালন-পালন করতে হয়। এই সময় প্রতিটি গরুর জন্য প্রতি মাসে গড়ে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হয় শুধু খাবারের পেছনে। খাদ্য তালিকায় থাকে ভুষি, খৈল, খড়, খৈল-ভুট্টার মিশ্রণ, ঘাস ও প্রাকৃতিক খাবার।

কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার  খামারি সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘একটা গরুকে কোরবানির উপযোগী করতে হলে ভালো খাবার দিতে হয়। এখন ভুষি, খৈলের দাম অনেক বেড়েছে। একেকটা গরুর পেছনে মাসে প্রায় ৪-৫ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে।’

চিকিৎসা, ভ্যাকসিন ও সহায়ক খরচও কম নয়

খাবারের পাশাপাশি পশুর স্বাস্থ্যের দিকেও খামারিদের নজর দিতে হয়। নিয়মিত ভ্যাকসিন, অ্যান্টিবায়োটিক ও হেলথ চেকআপ করতে হয় পশুচিকিৎসকের মাধ্যমে। এসব চিকিৎসা ও ওষুধ বাবদ প্রতি পশুর পেছনে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। অনেক সময় বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বা উপজেলা প্রাণিসম্পদ দফতরের সহায়তাও নিতে হয়।

বিশ্লেষকরা বলছেন, কোরবানির ঈদের পশুবাজারকে ঘিরে শুধু বিক্রিই নয়, পশু প্রস্তুত ও পরিচর্যার পেছনেও একটা বিশাল বাজার গড়ে ওঠে। এতে ভেটেরিনারি ওষুধ কোম্পানি, গো-খাদ্য উৎপাদক, খামার যন্ত্রপাতি বিক্রেতা, ট্রাকচালক ও শ্রমিক—সবারই সরাসরি অংশগ্রহণ থাকে। এ ছাড়া খামারে হেলপার, দুধদার ও পরিচর্যাকারী শ্রমিকদের মজুরি, যাতায়াত ও আনুষঙ্গিক খরচ মিলিয়ে খামার প্রতি গড়ে মাসে আরও ৮-১০ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হয়ে যায়। দেশের হাজারো খামারে এ ধরনের ব্যয় একত্রে ২-৩ হাজার কোটি টাকার একটি সক্রিয় বাজার তৈরি করে।

চামড়া শিল্পের বাণিজ্য

কোরবানির ঈদে দেশের মোট কাঁচা চামড়ার প্রায় ৬০ শতাংশ সংগ্রহ হয়। প্রতি বছর সংগৃহীত চামড়া পরিমাণ ২২ কোটি বর্গফুট। এরমধ্যে শুধু ঈদেই আসে ১০ কোটি বর্গফুট।

চামড়া শিল্পে এই সময়ে কমপক্ষে ১ হাজার কোটি টাকার বাজার গড়ে ওঠে, যেখানে লক্ষাধিক মানুষের মৌসুমি কর্মসংস্থান হয়। তবে বাজারে ন্যায্য দাম না পাওয়া, সংরক্ষণ সমস্যাসহ নানা কারণে চামড়া শিল্প সংকটে পড়ে। ২০২৪ সালে মাঠপর্যায়ে ছাগলের চামড়ার দাম ১০-১৫ টাকায়ও নেমে গিয়েছিল, যেখানে সরকারি মূল্য ছিল ১৮-২০ টাকা।

সরকার এ বছর চামড়া সংগ্রহে মোবাইল ইউনিট, ঠান্ডা সংরক্ষণাগার ও র‍্যাপিড মনিটরিং টিম গঠনের ঘোষণা দিয়েছে, কিন্তু বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।

বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ

কোরবানির ঈদ ঘিরে প্রবাসীরা বেশি বেশি রেমিট্যান্স পাঠান। আবার চামড়া ও চামড়াজাত শিল্পের উদ্যোক্তারা ঈদকে উপলক্ষ করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেন।

চামড়াজাত পণ্য রফতানি

কোরবানির ঈদ ঘিরে মৌসুমি চাহিদার বাইরে বাংলাদেশে যে খাতটি টিকে আছে বছরের পর বছর ধরে, সেটি হলো চামড়া ও চামড়াজাত শিল্প। দেশের রফতানিমুখী খাতগুলোর মধ্যে তৈরি পোশাকের পরই অবস্থান চামড়া শিল্পের। প্রতি বছর এই খাত থেকে বাংলাদেশ আয় করছে গড়ে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার। আর এই শিল্পে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত অন্তত ৬ লাখ মানুষ।

বিশেষ করে কোরবানির ঈদে দেশের মোট কাঁচা চামড়ার প্রায় ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ সংগ্রহ করা হয়। এরপর এগুলোকে প্রক্রিয়াজাত করে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিশ্বের নানা দেশে রফতানি করা হয় জুতা, ব্যাগ, বেল্ট, ওয়ালেটসহ নানা চামড়াজাত পণ্য।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ), লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, চামড়াজাত পণ্য রফতানি খাতে দেশের আয় প্রতিবছরই ৯০ থেকে ১১০ কোটি ডলারের মধ্যে ওঠানামা করে।

চামড়া শিল্প খাত দেশের অন্যতম বৃহৎ শ্রমঘন শিল্প। শুধু ট্যানারি বা কারখানা পর্যায়ে নয়, কাঁচা চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিবহন, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা, ডিজাইনার ও রফতানিকারক— সব মিলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৬ লাখের বেশি মানুষের জীবিকা এই শিল্পনির্ভর।

বিশ্লেষকদের মতে, কোরবানির ঈদে সংগৃহীত কাঁচা চামড়াকে যদি ঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণ করা যায়, তাহলে সারা বছরের চাহিদা মিটিয়ে আরও বড় রফতানি বাজার তৈরি করা যাবে।

রেমিট্যান্স প্রবাহে ঈদের উল্লাস, তিন দিনে এসেছে ৬০৪ মিলিয়ন ডলার

ঈদের উৎসব শুধু দেশে নয়, আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে দেশের বাইরে থাকা প্রবাসীদের মাঝেও। আর সেই আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটে রেমিট্যান্সের মাধ্যমে। চলতি জুন মাসের প্রথম তিন দিনেই বাংলাদেশে এসেছে ৬০৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১১১ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যে দেখা গেছে, ১ থেকে ৩ জুন পর্যন্ত এই তিন দিনে প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন ৬০৪.৪৭ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে শুধুমাত্র ৩ জুনেই এসেছে ১৬৫ মিলিয়ন ডলার— যা এক দিনের হিসাবে গত এক বছরের মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ।

চলতি অর্থবছর ২০২৪–২৫ (১ জুলাই ২০২৪ থেকে ৩ জুন ২০২৫) পর্যন্ত মোট রেমিট্যান্স প্রবাহ দাঁড়িয়েছে ২৮ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলারে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি।

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, ঈদ কিংবা উৎসবকেন্দ্রিক রেমিট্যান্স প্রবাহ সাধারণত মৌসুমি হলেও,গত কয়েক মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে রেমিট্যান্স বেড়েছে।

ঈদ যাতায়াতে ৫ হাজার কোটি টাকার লেনদেন

প্রতি ঈদে রাজধানী ঢাকা যেন একদিনেই অর্ধশূন্য হয়ে পড়ে। ঈদুল আজহা সামনে রেখে এবারও ঢাকাবাসীর বড় একটি অংশ পরিবারের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করতে ছুটে গেছেন গ্রামে। তবে এই যাতায়াত শুধু আবেগের নয়, এর পেছনে রয়েছে বিশাল অর্থনৈতিক বিনিয়োগও। কোটি মানুষের এই যাত্রা ঘিরে যাত্রী পরিবহন খাতে ঘুরে বেড়ায় হাজার কোটি টাকার লেনদেন।

পরিবহন বিশ্লেষক এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. হাদীউজ্জামানের ২০২৩ সালের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ঈদের আগের চার দিনে ঢাকা ছাড়েন অন্তত ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ। প্রতি বছরই এই সংখ্যার আশপাশেই থাকে যাত্রী প্রবাহ।

এত বিপুল সংখ্যক মানুষের ঢাকা ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তাঘাটে, বাস-লঞ্চ-ট্রেন টার্মিনালে সৃষ্টি হয় যাত্রার ঢল। লাখ লাখ মানুষ বাস, ট্রেন, লঞ্চ, মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল ও অন্যান্য যানবাহনে করে নিজ নিজ গন্তব্যে পৌঁছান। এই যাত্রায় গড়ে প্রতিজন মানুষ পরিবহন ভাড়ার পেছনে খরচ করেন কয়েক শ’ থেকে কয়েক হাজার টাকা পর্যন্ত, গন্তব্য ও মাধ্যম অনুযায়ী।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ঈদে পরিবহন খাতে (পশু পরিবহন প্লাস ঘরমুখো মানুষের যাত্রা) ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়। শুধু যাতায়াত ভাড়া বাবদই ঈদের আগে-পরে  কয়েক হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। এছাড়া যাত্রাপথে খাবার, যাত্রীসেবা, হোটেল-মোটেল ও নানা খরচ ধরলে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের এই পরিধি আরও বিস্তৃত।

ঈদের পর রাজধানী ফেরত মানুষের একইভাবে বিপুল অঙ্কের অর্থ পরিবহন খাতে ব্যয় হয়। ফলে ঈদের আগে ও পরে এই দুই সপ্তাহে আন্তঃজেলা পরিবহন খাত হয়ে ওঠে এক বিশাল আর্থিক চক্রের কেন্দ্রবিন্দু।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই যাতায়াত শুধু মানুষের গন্তব্য বদলের নয়, এটি দেশের অভ্যন্তরীণ ভোক্তা অর্থনীতিতেও বড় অবদান রাখে। তাই ঈদকে ঘিরে যে ‘মানবস্রোত’ ঢাকায় ও ঢাকার বাইরে যায়, তা একইসঙ্গে আবেগের এবং অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ।

ঈদে রান্নার ধুমে চাঙ্গা মশলার বাজার, খুচরা বিক্রিতে সরবতা

ঈদ মানেই জমজমাট রান্নাবান্না আর অতিথি আপ্যায়নের ধুম। কোরবানির ঈদের সেই উৎসবকে কেন্দ্র করে সরব হয়ে উঠেছে দেশের মশলার বাজার। এলাচ, দারুচিনি, লবঙ্গ, জায়ফল, জিরা, ধনেসহ প্রায় সব ধরনের মশলার চাহিদা বেড়েছে কয়েকগুণ। বাড়তি চাহিদার সুযোগে বেড়েছে দামও। একইসঙ্গে গতি এসেছে ভোজ্য তেল, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, টমেটোসহ রান্নার অপরিহার্য উপকরণগুলোর বাজারেও।

ক্রেতা-বিক্রেতা ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে রাজধানীসহ সারা দেশের খুচরা বাজার ও সুপারশপগুলোতে বেড়েছে বিক্রি। নানা অফার ও প্যাকেজে বিক্রি হচ্ছে ঈদের প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী। এর ফলে খুচরা বিক্রেতা ও আধুনিক দোকানগুলোতে বিক্রির পরিমাণ গড়ে ২৫-৩০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।

কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে  বড়সড় বাজার করার কারণে এক একজন গ্রাহক ২-৩ হাজার টাকার বাজার করছেন। ফলে প্রান্তিক পর্যায়ের খুচরা দোকান থেকে শুরু করে বড় সুপারশপগুলো পর্যন্ত ক্রেতার ভিড় বেড়েছে।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘ঈদকে কেন্দ্র করে মানুষের খরচ বাড়ে। ফলে খুচরা বাজারে একটা স্বাভাবিক সরবতা দেখা দেয়।’

 প্রাণ পায় গ্রামীণ অর্থনীতি

কোরবানির ঈদ ঘিরে রাজধানীসহ শহরাঞ্চল থেকে গ্রামমুখী অর্থপ্রবাহ জোরদার হয়। শহরের মানুষ গরু কেনেন, সেই টাকা যায় খামারিদের হাতে। এরপর ওই অর্থ খরচ হয় স্কুল-কলেজে ভর্তি, জমি উন্নয়ন, ক্ষুদ্র ব্যবসার পুঁজি, চিকিৎসা ও খাদ্য খাতে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি এক ধরনের ‘ঈদিক অর্থচক্র’ তৈরি করে— যা কৃষিনির্ভর না হলেও পুরোপুরি গ্রাম-নির্ভর।

পাবনার খামারি আবুল কালাম বলেন, ‘গরু বিক্রির টাকা দিয়ে ছেলের কলেজে ভর্তি করিয়েছি, ঘর মেরামত করছি, কিছু টাকা দোকানে বিনিয়োগ করবো।’

ঈদের সময় নগদ অর্থপ্রবাহ ৩০-৪০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এই মৌসুমি উৎসব গ্রামীণ অর্থনীতিতে স্বল্পমেয়াদি হলেও শক্তিশালী প্রভাব ফেলে।

নগরজীবনে ভোগব্যয়ের হিড়িক

ঈদকেন্দ্রিক কেনাকাটায় নগরভিত্তিক অর্থনীতিতে বিশাল মুভমেন্ট তৈরি হয়। ফ্যাশন হাউজ, সুপারশপ, রেস্টুরেন্ট, প্রসাধন সামগ্রী, অনলাইন মার্কেটপ্লেস ও হোম ডেলিভারি -সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো কয়েকগুণ বেশি বিক্রি করে।

টেকনোডার্ট কনসালটিং- এর এক জরিপে বলা হয়েছে, ঢাকার মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো ঈদের সময় গড়ে ১৫-২৫ হাজার টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করে, যার ৪০ শতাংশ যায় খাদ্য, ৩০ শতাংশ পোশাক এবং বাকি অংশ উপহার, বাসনপত্র ইত্যাদিতে ব্যয় হয়।

মোবাইল ব্যাংকিংয়ে কোটি কোটি টাকার লেনদেন

বিকাশ, নগদ, রকেটসহ মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসে ঈদ সামনে রেখে কয়েক গুণ লেনদেন বেড়ে যায়। ২০২৪ সালে ঈদের আগের সপ্তাহে দৈনিক গড় লেনদেন ছিল ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। ই-কমার্স ও হোম ডেলিভারি: ফুড, কসমেটিকস, গিফট— সবমিলিয়ে অন্তত ২০০০ কোটি টাকার বাজার। পরিবহন ব্যয় (পশু পরিবহন + ঘরমুখো মানুষের যাত্রা): ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।

ঈদের উৎসব হোক সম্ভাবনার ভিত্তি

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যখন আমদানি চাপ, রফতানিতে অস্থিরতা ও ডলারের সংকট চলছে— তখন এই ধরনের মৌসুমি উৎসব হতে পারে দেশজ উৎপাদন-নির্ভর প্রবৃদ্ধির উদাহরণ। সুশাসন ও পলিসি সমন্বয়ের মাধ্যমে এই অর্থনীতিকে আরও টেকসই ও জনমুখী করা সম্ভব।