ব্যাংক পরিচালনায় আসছে বড় পরিবর্তন, ঝুঁকিভিত্তিক তদারকিতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

ব্যাংক খাতে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর অংশ হিসেবে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদে অন্তত ৫০ শতাংশ ‘স্বতন্ত্র পরিচালক’ নিয়োগ বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। একইসঙ্গে ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি ব্যবস্থা পুরোপুরি চালুর প্রস্তুতি নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

সোমবার (৭ জুলাই) বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। এ সময় ডেপুটি গভর্নরসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।

পরিচালনা পর্ষদে বাড়ছে স্বতন্ত্র পরিচালক

গভর্নর বলেন, “ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন ২০২৩ অনুযায়ী বর্তমানে এক পরিবারের সর্বোচ্চ তিনজন সদস্য পরিচালনা পর্ষদে থাকতে পারেন। তবে নতুন আইনে তা আরও সীমিত করা হচ্ছে। পাশাপাশি পর্ষদের অর্ধেক সদস্য স্বতন্ত্র পরিচালক হতে হবে।”

স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি প্যানেল তৈরি করবে। প্যানেলের বাইরে থেকে নিয়োগ দিতে চাইলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশাগত অভিজ্ঞতা ও ব্যাংকিং জ্ঞান যাচাই করে অনুমোদন দিতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে।

ঝুঁকিভিত্তিক তদারকির রূপান্তর

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দেশের ব্যাংক খাতকে আরও জবাবদিহিমূলক, তথ্যনির্ভর ও টেকসই করতে রিস্ক-বেইজড সুপারভিশন (আরবিএস) পদ্ধতি পুরোপুরি চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে কয়েকটি ব্যাংকে পরীক্ষামূলকভাবে এ পদ্ধতি চালু করে ইতিবাচক ফল পাওয়া গেছে।

নতুন কাঠামো অনুযায়ী, প্রতিটি ব্যাংকের আর্থিক, বাজার, পরিচালনাগত, আইনগত এবং কৌশলগত ঝুঁকি আরও নিখুঁতভাবে বিশ্লেষণ করা সম্ভব হবে। এতে ব্যাংকের ঝুঁকিপূর্ণ খাত চিহ্নিত করে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া যাবে, যা আর্থিক স্থিতিশীলতায় বড় ভূমিকা রাখবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকেও বড় রদবদল

এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব তদারকি কাঠামোতেও বড় পরিবর্তন আসছে। নতুন করে গঠন করা হচ্ছে— তদারকি নীতিমালা ও সমন্বয় বিভাগ, তথ্য বিশ্লেষণ ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ, প্রযুক্তি ও ডিজিটাল ব্যাংকিং তদারকি বিভাগ, অর্থপাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন রোধবিষয়ক ঝুঁকি তদারকি বিভাগ। এছাড়া প্রতিটি তফসিলি ব্যাংকের জন্য থাকবে আলাদা তদারকি দল।

প্রশিক্ষণ ও তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্তে গুরুত্ব

তদারকির সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থার কারিগরি সহায়তায় তফসিলি ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তাদেরও প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হচ্ছে।

একইসঙ্গে গড়ে তোলা হচ্ছে একটি কেন্দ্রীয় তথ্য প্ল্যাটফর্ম, যার মাধ্যমে দেশের যেকোনও ব্যাংকের ঝুঁকি চিত্র সহজেই বিশ্লেষণযোগ্য হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, “এ পরিবর্তনগুলো ব্যাংকিং খাতের জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং ঝুঁকি সচেতন সংস্কৃতির বিকাশের মাধ্যমে এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ভিত্তি আরও মজবুত করবে।”

কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই রূপান্তর বাস্তবায়নে ব্যাংক মালিক, পরিচালক, নির্বাহী ও অংশীজনদের সক্রিয় অংশগ্রহণ কামনা করেছে।

এর মাধ্যমে একটি আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর, টেকসই ও ঝুঁকিসচেতন ব্যাংক ব্যবস্থা গড়ে উঠবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।