সাদুমিয়া লাশটি অন্যত্র সরিয়ে ফেলার পরিকল্পনা করে ব্যর্থ হন। পরে জানাজানি হলে শিশু তানজিলার লাশ উদ্ধার করা হয় সাদুমিয়ার ঘর থেকে। তানজিলাকে হত্যার অভিযোগে পরে থানায় মামলা হয়। সাদুমিয়া (৫০) গ্রেফতার হন। আদালতে হত্যা মামলার আসামি সাদুমিয়া জবানবন্দি দিয়ে এ ঘটনার বিস্তারিত বয়ান দেন।
আরও পড়তে পারেন: আবারও পশ্চিমা চাপে সরকার, ইস্যু আইএস
সাদুমিয়ার তাৎক্ষণিক ক্রোধ এক বড় বিপর্যয় আনে শিশু তানজিলার পরিবারে। সন্তানহারা হন তানজিলার বাবা-মা। সাদুমিয়া নিজেও হত্যা মামলায় জড়িয়ে যান। মামলা ঠিকমতো অগ্রসর হলে শিশুহত্যার সর্বোচ্চ শাস্তিই হয়তো অপেক্ষা করছে সাদুমিয়ার জন্য।
দুই.
সাদুমিয়া প্রান্তিক জনগণের অংশ। গ্রামীণ জনপদের অংশ। তার ক্রোধ তাকে এ বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দিলো। গ্রামের সহজ সরল সাদুমিয়া হয়তো ক্রোধ তাড়িত হয়েই এই নিরপরাধ ফুলের মতো শিশু তানজিলার জীবন সংহারের কাজটি সেরেছেন। হয়তো তিনি শিশুটিকে হত্যা করতেও চাননি। তার অনিয়ন্ত্রিত ক্রোধ তাকে এ বিপর্যয়ে ঠেলে দিয়েছে। কিন্তু সারাদেশে ধর্মের নামে বা রাজনীতির নামে বা মতবাদের নামে একের পর এক যে হত্যাকাণ্ড ঘটছে তার পেছনে তো আছে নিয়ন্ত্রিত উদ্দেশ্য কিংবা আদর্শ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক রেজাউল করিম সিদ্দিক যেভাবে খুন হলেন, তাতে এটা তো অন্তত নিশ্চিত যে এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এর পেছনে উদ্দেশ্য আছে, হয়তো আছে কোনও বড় মতবাদও। অথবা আছে কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থ।
ঢাকার কলাবাগানে ইউএসএইডের কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান আর নাট্যকর্মী তনয় হত্যাকাণ্ডও তো কোনও অপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড নয়। কে কাকে ফাঁসাতে, কে কোন স্বার্থে, কে কোন আদর্শিক বা রাজনৈতিক মতবাদে দীক্ষিত হয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটালো তা সঠিকভাবে জানা যাবে কি না জানি না, কিন্তু এটা তো সত্য এই জোড়া খুন পরিকল্পিত!
কুমিল্লার কলেজ ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর হত্যাকাণ্ডের খবর ঠেকাতে, তার ময়নাতদন্তের রিপোর্টে দিনের আলো দেখতে যে বাধার পাহাড়ের মুখে পড়েছে তাতে এটা তো বোঝা খুব কঠিন নয় যে তনুর হত্যাকারীরা যথেষ্ঠ ক্ষমতাবান।
আমরা এখন গোটা বাংলাদেশকে অজানা ভয় আর সম্ভাব্য খুনের বড় স্পট বানিয়ে ফেলেছি। এর পেছনে নোংরা রাজনীতি আছে, হীন মতাদর্শ আছে, প্রতিহিংসা আছে হয়তো কোনও বড় বিপর্যয়ের আলামতও আছে! কিন্তু এই অন্ধকারের পেছনে আর যাই থাক মানুষের শুভবোধ জাগ্রত নেই। রাজনীতির নামে, ক্ষমতার নামে, ধর্মের নামে আমরা যে হত্যার খেলা খেলছি তার পেছনের কারণ আর যাই হোক মানবিকবোধে প্রাণিত নন।
আরও পড়তে পারেন: সরকার ও আদালতের দিকেই তাকিয়ে জামায়াত
এই ধ্বংস আর হত্যাযজ্ঞ কতকাল চলবে কে জানে! কবে কে আগুয়ান হয়ে শুভবোধে জাগ্রত হয়ে এই অন্ধকার থেকে আলোর দিশা দেখাবে কে জানে? কিন্তু আমরা তো ছুঁয়ে দেখতে পারি মানবিক মূল্যবোধে জারিত-প্রাণিত মুক্তবুদ্ধি আর শুভবুদ্ধির উদার আহ্বানগুলো।
তিন.
ডা. লুৎফর রহমান ছিলেন একজন মানবতাবাদী লেখক। ছিলেন মানবপ্রেমী। তিনি লিখছেন, ‘প্রেমিক ও দরদী হও। তার আগে নিষ্ঠুর প্রাণ নিয়ে হাত পা ধুয়ে উপাসনার ঘরে যেও না। তা হবে নিছক ব্যায়াম। মানুষকে ভালোবাসতে শেখো- তার দুঃখ হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে শেখো। তারপর দান কর। হৃদয়হীন নিষ্ঠুরের শত বৎসরের উপাসনার মূল্য এক কপর্দকও নয়। মানুষের দুর্বলতাকে ক্ষমার চোখে দেখ। এই-ই ঐশ্বরীয় ভাব। মানুষের একটুখানি দুর্বলতার জন্যে কঠোর শাস্তি দিতে বিবেচিত হয়ে যে ঈশ্বরের পূজা করতে চাচ্ছে তিনি মানুষের কত অন্যায় কত দুর্বলতা সহ্য করে যাচ্ছেন, তাকি ভেবে দেখেছ?’
এইরকম মানবতাবাদে দীক্ষিত হতে কি আমরা চাইবো? নাকি প্রচলিত প্রতিহিংসাপ্রবণ রাজনীতির বিষবাষ্পেই আমরা প্রতিনিয়ত নিজেদের মেলাবো। সেই প্রশ্ন এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে বাংলাদেশে। আমরা আমাদের রাষ্ট্রকে ন্যায্যতার পথে যেতে প্রতিদিন একটু একটু করে বাধা দেবো নাকি উল্টো কাজটা করে ন্যায্য রাষ্ট্রের পথে প্রিয় দেশটাকে ঠেলবো সেই বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসে গেছে। যে সহিংসতা, ক্রুরতা, হীনতা, নীচতা আর পরস্পরকে শত্রুজ্ঞান দীক্ষা আমাদের চালিত করছে, তা থেকে যদি আমরা মুক্ত হতে না পারি তবে সত্যি সত্যিই এক বড় বিপদ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। তাই হয়তো কবি নজরুলের এই কবিতাটির মত তরী পারের কাণ্ডারির খোঁজাটাও এখন জরুরি...
‘ দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভূলিতেছে মাঝি পথ,
ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?
কে আছ জোয়ান, হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যৎ।
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার!!’
চার.
বড় দুঃখ আমাদের জীবনকে ঘিরে ধরছে। নানা অপঘাত আর ভীতির কারণে বাংলাদেশের সামগ্রিক ভাবনার কেন্দ্র সরে যাচ্ছে। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ যে অবস্থায় আছে, তার জনমিতি, উন্নয়ন যে জায়গায় আছে, তার সামনে যেসব সুযোগ ও সম্ভাবনা আছে- তাতে তার রাষ্ট্রীক মনোযোগের প্রধানক্ষেত্র এখন কোনও অবস্থাতেই খুন আর নিরাপত্তা হওয়া উচিত নয়। বাংলাদেশের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ তার বিপুল কর্মক্ষম জনসংখ্যাকে কীভাবে সে জনসম্পদে পরিণত করবে, তার নিখুঁত ও কার্যকর মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা।
বাংলাদেশের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ সুশাসনকে কীভাবে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দেওয়া যাবে, সেই পথটা বাতলানো। বাংলাদেশের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত শিক্ষা খাতে কীভাবে আরও বড় বিনিয়োগ ঘটিয়ে মানসম্পন্ন শিক্ষা সে নিশ্চিত করবে তার জনগণের জন্য। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন, যানজট, অপরিকল্পিত নগরায়ন- এসব সমস্যাকে সম্ভাবনায় রূপান্তরিত করে জনগণকে সার্বিক অর্থে সুরক্ষিত করার চ্যালেঞ্জ এখন বাংলাদেশের সামনে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট- এসব মোকাবিলার কার্যকর পথ বের করা বাংলাদেশের জন্য এখন বড় লড়াই।
আরও পড়তে পারেন: যে পথে মন্ত্রী হন বদর নেতা
জনবহুল বাংলাদেশকে সামরিকীকরণের প্রবণতা থেকে বের করে একটা জনকল্যাণধর্মী রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত করার স্বল্প-মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নের পথ বাতলানোই বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের ভাবনার এই গতিপথের মোড়টা ফেরাবে কে?
পাঁচ.
একটা সংগৃহীত পুরনো রাজনৈতিক জোকস দিয়ে লেখাটা শেষ করি।
নরক ভ্রমণে গেছেন তিন ভদ্রলোক। একজন আমেরিকান, একজন সুইজারল্যান্ডের আর শেষজন বাংলাদেশের। বেশ কয়েক দিন নরক ভ্রমণ করে তিনজনই ক্লান্ত। কাহাতক আর নরকবাসীদের দুঃখ-কষ্ট চোখে দেখা যায়। তারা ঠিক করলেন, নিজ নিজ দেশের একটু খোঁজখবর নিবেন। সুতরাং তিনজনই গিয়ে ঢুকলেন নরকের একটি ফোনের দোকানে।
প্রথমে ফোন করলেন আমেরিকান ভদ্রলোক। দুই মিনিটে খবর নিলেন দেশের অর্থনীতির। তার বিল এলো দুইশ’ ডলার। তারপর সুইস ভদ্রলোক এক মিনিটে জেনে নিলেন তার দেশের খবর। মাত্র এক মিনিটের জন্য তাকে দিতে হলো সাড়ে তিনশ’ ডলার।
এবার ফোন করলেন বাংলাদেশের ভদ্রলোক, তিনি টেলিফোনে বিস্তর খোশ-গল্প করলেন, সরকার ও বিরোধী দলের খবর নিলেন, পুঁটি মাছের দাম জানলেন, পাশের বাড়ির রাঙার মা’র খবরও জেনে নিলেন। মোটমাট কথা বললেন কুড়ি মিনিট। অথচ তার বিল এলো মাত্র পাঁচ ডলার। ব্যাপার দেখে আমেরিকান এবং সুইস ভদ্রলোক রেগে কাঁই। বললেন, বাংলাদেশির বিল এত কম হতেই পারে না।
নরকের টেলিফোন অপারেটর হেসে বললেন, ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললেই আপনারা বুঝবেন। এখান থেকে আপনাদের দেশ অনেক দূরে, তাই আই.এস.ডি. কলের বিল নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে কলের ক্ষেত্রে লোকাল কল চার্জ ধরা হয়েছে!
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক