‘আ-কা’ বন্ধুদের অনেকেই এখন পত্রিকার সঙ্গে নেই। কেউ ব্যাংকার, কেউ এনজিও কর্তা, কেউ বিদেশে, কেউবা আবার সংস্কৃতির অন্য শাখায় ব্যস্ত। বেশ ভালো অবস্থানে আছেন প্রায় সবাই। তবুও সবার মনে একটাই শূন্যতা।
আমাদের অবস্থা অনেকটা স্কুল জীবনের বন্ধুদের মতোই।
ফেসবুকে ‘কাগজের আড্ডা’ নামে ২৪ সদস্যের আমাদের একটা গ্রুপ আছে। যেখানে আমরা প্রতিনিয়ত নিজেদের সম্পর্কটাকে ঝালাই করে চলেছি অতীত আনন্দ টেনেটুনে। প্রত্যেকেই সেখানে মনে মনে খুঁজে ফিরি আজকের কাগজের সেই ফিচার বিভাগটিকে। যে বিভাগটি আমাদের শিখিয়েছে অফিসকে কেমন করে সংসারে পরিণত করা যায়।
আমি আজকের কাগজ ছেড়ে টানা নয় বছর রাজার হালে ছিলাম দৈনিক মানবজমিন-এর বিনোদন বিভাগে। তারও আগে চার বছর ছিলাম পাক্ষিক তারকালোক-এ। তারও আগে প্রদায়ক হিসেবে কাজ করেছি ইনকিলাব, পূর্ণিমা, যুগান্তর এবং ভোরের কাগজ-এ। কই আর কারও সঙ্গে তো আমার কিংবা আমাদের তেমন কোনও হৃদয়ঘটিত যোগাযোগ নেই। বড়জোর ‘হাই হ্যালো’তেই থেমে থাকি আমরা।
বাংলা ট্রিবিউন-এ আমার বয়স মাত্র এক বছর। সত্যি বলতে এখানে যোগ দেওয়ার পেছনেও বড় ভূমিকা রেখেছে আজকের কাগজ পরিবারের সেই হৃদ্যতা।
বাংলা ট্রিবিউনে এখন যিনি প্রধান, আমাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জুলফিকার রাসেল ভাই। যিনি আজকের কাগজের সাবেক তারকা রিপোর্টার। যতদূর মনে পড়ে তিনি তখন বিমানখাত দেখতেন। সঙ্গে তার অবাক সুন্দর কথায় তারকাবহুল গানের অ্যালবাম প্রকাশ পেত নিয়মিত। উনি গানের মানুষ বলেই তার সঙ্গে বাড়তি যোগাযোগ ছিল আমাদের ফিচার বিভাগের সঙ্গে।
সেই রাসেল ভাই যখন প্রায় দশ বছর পর আমাকে তার দফতরে ডাকলেন, তখন আমি একরকম সাত-পাঁচ না ভেবেই দৌঁড়ে আসি। কারণ একটাই, আজকের কাগজের পারিবারিক শিক্ষা। আমার বিশ্বাস ছিল, আজকের কাগজের সেই পারিবারিক সম্পর্ক আর রুচিবোধের প্রতিফলন ঘটবে রাসেল ভাইর নেতৃত্বে। মনে পড়ে এই প্রতিষ্ঠানে যোগ দেওয়ার প্রথম মাসে রাসেল ভাই খুব কৌশলে আমার কাছে একটা বিষয় জানতে চাইতেন বেশ কৌতূহল নিয়ে। সেটি হলো এমন- কী মানজুর কেমন লাগছে অফিস? অফিসের পরিবেশ অনেক ফ্রেন্ডলি না? এমন প্রশ্নের একটাই কারণ, তিনি জানতে চাইছিলেন- তার অফিসটি আসলেই পারিবারিক কী না।
অফিস কেমন ফ্রেন্ডলি তার নমুনা দেখুন। আমার ক্লান্ত লাগছে। তাই টেবিলের ওপরে মাথা রেখে চোখ বুঝলাম। ব্যস- কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে একদল সহকর্মী আমার পেছনে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলে ফেললো। টেবিল থেকে মাথা তুলে দেখি সেই ছবি ফেসবুকেও আপলোড হয়ে গেছে।
অফিসের এই হৃদয়কাড়া ভলান্টিয়ারি কাজের বেলায় আবার সবচেয়ে এগিয়ে থাকেন বিনোদন বিভাগের প্রধান সেনাপতি ওয়ালিউল মুক্তা। মুড়ি ভর্তার এন্তেজাম থেকে শুরু করে কোনও অফিস কলিগের প্রেমঘটিত জটিলতা নিরসনের জন্য তার হস্তক্ষেপের জুড়ি নেই।
অন্যরাও অনন্য। একটা বিনোদন নিউজের ভেতরে দুইটা ভুল পেয়েছে নিউজ ডেস্কের কোনও আপা কিংবা ভাই। সঙ্গে সঙ্গে টু-শব্দ না করে ইনবক্সে নক করে বলবেন, বস দেখার আগে দ্রুত ঠিক করেন। যা নিয়তই আমাকে নিয়ে যায় ফেলে আসা আজকের কাগজের শৈশব স্বর্ণালী দিনগুলোতে। আর মনে করিয়ে দেয় ‘সংসার সুখের হয় সহকর্মীর গুণে’।
এই অফিসে যোগ দেওয়ার পর একটাই নির্মম ঘটনা ঘটেছে। একটি কথোপকথন দিয়ে সেটি শেষ করছি।
: কোথাও তোমার অফার আছে?
-অফার মানে ভাই?
: না, বলছি, কোনও পত্রিকা টিভি থেকে কোনও চাকরির অফার আছে নাকি তোমার?
- না! নাই তো! কেন?
: আসলে কী বলবো? বুঝতে পারছি না। তবে অফার থাকলে জয়েন করে ফেল।
-(এবার তো আমার পেটে কামড় দিল। হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল।) আবারও বললাম, কোনও অফার নাই তো ভাই।
: (অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে) আসলে আমার খুব খারাপ লাগছে বলতে। কিন্তু কিছু করা নেই। দুই মাস সময় আছে এখনও। তুমি এর মধ্যে অন্য কোথাও চেষ্টা কর। সরি মানজুর।
- (আমার অবস্থা তখন ‘ধ্রুবকের’মতো)
: আসলে আমি অনেক চেষ্টা করেছি তোমাকে রাখার। কিন্তু পারিনি। এই নাও, কাগজটা পড়ে সাইন করে আমাকে দাও। আমি আবারও বলছি- সরি। নাও, সাইন করো।
- হাতে নিতেই বললেন, আগে পড়। তারপর স্বাক্ষর দাও।
আমি কাগজটি পড়লাম। আবারও নির্বাক হলাম। রাসেল ভাইর দিকে তাকালাম। দেখলাম, তার চোখে-মুখে রাজ্যের মুগ্ধতা খেলা করছে। তিনি হো-হো করে হেসে উঠলেন। এতক্ষণ এই চাকরিচ্যুতির অভিনয় করে আমাকে শতভাগ বোকা বানিয়ে বস নিজেই মুগ্ধ।
সেদিন আমার হাতে দেওয়া সেই ‘পদত্যাগ পত্র’ নামক কাগজটি ছিল, আমার চাকুরির কনফার্মেশন লেটার এবং সঙ্গে সন্তোষজনক একটি ইনক্রিমেন্ট!
এই ঘটনাটি বলার কারণ আমাদের অফিসের শীর্ষ ব্যক্তি থেকে শুরু করে সবার মধ্যে বিরাজমান পারিবারিক বন্ধন এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের বিষয়টি অনুভব করানো।
এই যে বাংলা ট্রিবিউন তর তর করে এগিয়ে চলছে। নির্ভরযোগ্য পোর্টাল হিসেবে ছড়িয়ে পড়ছে অন্তর্জাল বিশ্বে। তার পুরোটাই সম্ভব হচ্ছে একে অপরের প্রতি আন্তরিকতা এবং বিশ্বাসের দৌলতে। আর কিছুই না।
লেখক: ইনচার্জ, এন্টারটেইনমেন্ট