X
সোমবার, ০৯ জুন ২০২৫
২৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

নীতি বাস্তবায়ন কেন প্রায়ই ব্যর্থ হচ্ছে?

ড. মোহাম্মদ কামরুল হাসান
০৯ জুন ২০২৫, ১১:১৭আপডেট : ০৯ জুন ২০২৫, ১১:১৭

নীতির ব্যর্থতা কেবল বাংলাদেশের একক সমস্যা নয়, তবে এ দেশের প্রেক্ষিতে এর ধারাবাহিকতা গভীরতর ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার প্রতিফলন। বিপুল সংখ্যক কৌশলগত দলিল, মাস্টারপ্ল্যান ও সংস্কার রূপরেখা থাকা সত্ত্বেও, এর কার্যকর বাস্তবায়ন এখনও খণ্ডিত ও অসম্পূর্ণ। বাস্তবায়নে এই ব্যর্থতা কেবল প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে নয়; এটি রাজনৈতিক, অর্থনীতি, প্রাতিষ্ঠানিক ভঙ্গুরতা এবং নীতি প্রণয়ন এবং প্রকৃত বাস্তবতার ব্যবধানের ফল।   

এখন নীতির বাস্তবায়ন প্রেক্ষাপটের সমস্যাগুলো বিশ্লেষণ করা যাক। নীতি বাস্তবায়ন ব্যর্থতার অন্যতম প্রধান কারণ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও পৃষ্ঠপোষকতার গভীর জাল। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা অনেক সময় উন্নয়ন প্রকল্পকে নির্বাচনি স্বার্থে ব্যবহার করেন, যার ফলে বাছাইকৃত বাস্তবায়ন দেখা যায়। পৃষ্ঠপোষকতার কারণে প্রায়ই প্রকল্প বাছাইয়ে রাজনৈতিক আনুগত্যকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়, প্রয়োজন বা যোগ্যতাকে নয়। প্রকল্পের জনবল নিয়োগ, স্থান নির্বাচন এমনকি সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়াও রাজনীতিকরণে প্রভাবিত হয়, যা প্রাতিষ্ঠানিক নিরপেক্ষতা বিনষ্ট করে এবং জনগণের মধ্যে বিরক্তি ও অবিশ্বাস জন্ম দেয়।

অনেক সমালোচকের মতে, বাস্তবায়নে ব্যর্থতার মূল কারণ হলো অতিরিক্ত কেন্দ্রীকরণ এবং কঠোর আমলাতান্ত্রিক কাঠামো। নীতিগুলো কেন্দ্রীয়ভাবে প্রণীত হয়, অনেক সময়ে স্থানীয় বাস্তবতা বিবেচনায় নেওয়া হয় না। নীতি প্রণয়নের পর তা বহু প্রশাসনিক স্তর অতিক্রম করে, যেখানে সমন্বয়হীনতা ও অদক্ষতা কার্যকারিতা হ্রাস করে। প্রতিটি মন্ত্রণালয় আলাদা নিজস্ব গন্ডির ভেতর কাজ করে ফলে অনেক সময় সমন্বয়হীনতা লক্ষ্য করা যায়। মাঠ-পর্যায়ে কর্মকর্তাদের অনেক সময় যথাযথ ক্ষমতা, প্রশিক্ষণ বা প্রণোদনার অভাব থাকে, ফলে স্থানীয় প্রেক্ষাপটে নীতি অভিযোজনে ব্যর্থতা ঘটে।  

এছাড়াও অনেক নীতিপত্র উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য ও জটিল ভাষায় পূর্ণ হলেও বাস্তব প্রেক্ষাপটে প্রয়োগযোগ্য নয়। বিদেশি দাতাদের কাঠামো বা আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার ভিত্তিতে নীতিনির্ধারণ করার ফলে প্রায়ই সেগুলো দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খায় না। এছাড়াও কার্যকর অংশগ্রহণমূলক নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ার অভাবে প্রকৃত সুবিধাভোগীরাও প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়েন।

বাংলাদেশের উন্নয়ন কৌশলও অনেকাংশে আন্তর্জাতিক দাতাদের প্রভাবাধীন, যাদের অগ্রাধিকার অনেক সময় জাতীয় বা স্থানীয় প্রয়োজনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বৈশ্বিক তথ্য উপাত্ত প্রমাণ করে যে দাতানির্ভর প্রকল্পগুলো সাধারণত সংক্ষিপ্ত সময়ে সাফল্য দেখাতে পারে, তবে টেকসই পরিবর্তন সাধনে ব্যর্থ হয়। মূলত দাতাদের দ্রুত ফলাফল পাওয়ার প্রবণতা দীর্ঘমেয়াদী দক্ষতা ও প্রতিষ্ঠানগত উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।   

এছাড়া, স্থানীয় পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল, অর্থ ও কারিগরি সহায়তার অভাব বিদ্যমান। স্থানীয় সরকারগুলো অনেক সময় নামমাত্র ক্ষমতা পেলেও প্রকৃতভাবে স্বায়ত্তশাসিত নয়। পর্যাপ্ত মানবসম্পদ, পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা ও লজিস্টিক সহায়তা ছাড়া জটিল প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যকর হয় না।

পাশাপাশি, তথ্য-উপাত্তের অভাবও একটি বড় সমস্যা। নির্ভরযোগ্য, সময়োপযোগী ও বিশ্লেষণযোগ্য তথ্য- উপাত্ত না থাকায় বাস্তবায়ন চলাকালীন সময়ে করণীয় সংশোধন অনেক সময়ে সম্ভব হয় না এবং স্বচ্ছতা ব্যাহত হয়।

সেই সাথে, জবাবদিহিতা সফল নীতি বাস্তবায়নের মূল ভিত্তি। কিন্তু বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক নজরদারি ব্যবস্থা তুলনামূলক ভাবে দুর্বল বা পক্ষপাতদুষ্ট। পারফরম্যান্স ভিত্তিক মূল্যায়ন প্রক্রিয়া প্রায় অনুপস্থিত, যার ফলে নীতি বাস্তবায়ন ব্যর্থতা বা অদক্ষতা অধিকাংশ সময়েই কোনও শাস্তির সম্মুখীন হয় না।   

সর্বোপরি, নীতির বাস্তবায়নে সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গিও একটি অন্তরায়। প্রশাসনিক কাঠামো অত্যন্ত কেন্দ্রমুখী  হওয়ায়, মাঠ পর্যায়ে উদ্ভাবন, মতামত বা অভিযোজন নিরুৎসাহিত হয়। ফলে মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তারা কেবল নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুসরণ করেন, স্থানীয় বাস্তবতা উপেক্ষিত হয়।

এই বাস্তবতা অনুধাবনের জন্য আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া জরুরি। যেমন, সিঙ্গাপুরের সফল নীতি বাস্তবায়নের পেছনে একটি পেশাদার প্রশাসনিক কাঠামো, স্পষ্ট দায়িত্ব, কর্মক্ষমতা সূচক এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পরিবেশ কাজ করেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার পারফরম্যান্স মূল্যায়ন কমিটি তথ্য বিশ্লেষণ ও নাগরিক মতামতের মাধ্যমে নীতি বাস্তবায়ন মূল্যায়ন করে। সেই সাথে রুয়ান্ডায় স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সম্পাদিত পারফরম্যান্স চুক্তিগুলো সরাসরি জাতীয় উন্নয়ন লক্ষ্যের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে এবং সেগুলো জনসমক্ষে উন্মুক্ত থাকে। এছাড়া, ব্রাজিলের পোর্তো আলেগ্রে শহরে নাগরিকদের সরাসরি বাজেট প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করে জনসেবা উন্নত ও সরকারের প্রতি আস্থা বৃদ্ধি করেছে। পাশাপাশি, নিউজিল্যান্ডে সহ-নকশা পদ্ধতি ও ‘নীতি ল্যাব’ ব্যবহারের মাধ্যমে নীতিগুলো বাস্তব প্রেক্ষাপটে পরীক্ষিত হয়, যাতে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রাসঙ্গিকতা নিশ্চিত হয়। এমনকি, ইথিওপিয়ার কৃষি রূপান্তর সংস্থা (ATA) সরকারের একটি আধা-স্বায়ত্তশাসিত কারিগরি অঙ্গ হিসেবে কাজ করে, যা নীতি-বাস্তবায়নের ফাঁক পূরণে সহায়তা করে।

এই অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশে প্রয়োজন কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষা দ্বারা প্রশাসনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কমানো জরুরি। পাশাপাশি, অংশগ্রহণমূলক নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়া চালু করে নাগরিকদের, বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করতে হবে। সেই সাথে, ডিজিটাল সরঞ্জামের মাধ্যমে নজরদারি, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ এবং তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া নিশ্চিত করা যায়। স্থানীয় সরকারকে সম্পদের পাশাপাশি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা প্রদান করা যেতে পারে তবে এ ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা ও জবাবদিহিতাও নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি, মাঠপর্যায়ে মানবসম্পদ উন্নয়নে ধারাবাহিক বিনিয়োগও অপরিহার্য।

বাংলাদেশে নীতি প্রণয়ন -নীতি বাস্তবায়ন যাত্রা এখনও প্রতিবন্ধকতাপূর্ণ, কিন্তু আশাব্যঞ্জক। নীতি বাস্তবায়নের ব্যর্থতা যে একটি কাঠামোগত সমস্যা, তা অনুধাবন করাই সংস্কারের প্রথম ধাপ। আন্তর্জাতিক উদাহরণ দেখায়, সাফল্য কাকতালীয় নয় বরং এটি প্রাতিষ্ঠানিক নকশা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও ধারাবাহিক শিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত। কাগুজে পরিকল্পনা থেকে কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশে শুধু সংস্কার নয়, বরং শাসনব্যবস্থার ভাবনা, কাঠামো ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াতেই মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। কারণ, নীতির সাফল্য পরিকল্পনার ভাষণে নয় বরং বাস্তব প্রভাবেই নিহিত।

লেখক: জনপ্রশাসন ও জননীতি বিশ্লেষক।

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বেগুন ভর্তা আগে কখনও এভাবে করেছেন?
বেগুন ভর্তা আগে কখনও এভাবে করেছেন?
ঈদে বন্দিদের জন্য বাড়ির রান্না, স্বজনদের স্বস্তি
ঈদে বন্দিদের জন্য বাড়ির রান্না, স্বজনদের স্বস্তি
কলম্বিয়ায় হত্যাচেষ্টার শিকার সিনেটর আপাতত শঙ্কামুক্ত
কলম্বিয়ায় হত্যাচেষ্টার শিকার সিনেটর আপাতত শঙ্কামুক্ত
দুই বিড়ম্বনায় রাজধানীবাসী
দুই বিড়ম্বনায় রাজধানীবাসী
সর্বশেষসর্বাধিক