হরেক রকম বাংলাদেশ

তসলিমা নাসরিনএক বাংলাদেশের ভেতর হরেক রকম বাংলাদেশ বাস করে। একটি  গরিব বাংলাদেশ। অভাব, অশিক্ষা আর  অসুখে ভোগে। আরেকটি ধনী বাংলাদেশ। ধনদৌলতের ওপর বসে আরাম করে। এভাবে ভাগ না করে অন্যভাবে ভাগ করা যায়। এক বাংলাদেশ আতংকে তটস্থ। অন্য বাংলাদেশ রিলাক্সড।  হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ধর্মগুরুরা কোপ খেয়ে মরছে। ইসলাম নিয়ে প্রশ্ন করলে বা ইসলামি মৌলবাদ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করলেই সে যেই হোক আততায়ীরা তাকে কুপিয়ে মেরে ফেলছে। কবিতা ভালোবাসো, সেতার বাজাও, সমকামীর অধিকার মানো, কেউ জানে না কার ঘাড়ে কখন কোপ পড়বে। প্রগতির পক্ষে কোনও বই প্রকাশ করলেও চাপাতি খেয়ে মরতে হবে। ভয়ংকর বীভৎস জল্লাদদের হাত থেকে দেশকে এবং নিজেদেরকে বাঁচাতে চেষ্টা করছে সুস্থ সচেতন মানুষ। এই বাংলাদেশ প্যানিক। আরেক বাংলাদেশ রিলাক্সড। মোটেও চিন্তিত নয় খুনখারাবি  নিয়ে। তারা চমৎকার বেঁচে আছে। নাচছে, গাইছে, হল্লা করছে, আনন্দ করছে। নিজেদের আরাম আয়েশ, সাজগোজ, পয়সাকড়ি নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। তারা মনে করে তাদের ঘাবড়ানোর কিছু নেই। কারণ তারা খাঁটি মুসলমান, তারা বিশ্বাস করে ইসলাম শান্তির ধর্ম।

আরও পড়তে পারেন: নিজামীর ফাঁসি: ইউরোপের নীরবতার সমালোচনায় এরদোয়ান
ধর্মগুরুদের কুপিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে। খ্রিস্টান ফাদারকে মারা হলো, এরপর এক হিন্দু পুরোহিতকে মারা হলো, সেদিন মারা হলো এক বৌদ্ধ ভিক্ষুকে। এর পেছনে কারণ একটিই, এরা মুসলমান নয় এবং এদের মাথায় কোপ বসালে এদের শিষ্যবৃন্দ ভয়ে দেশ ছেড়ে পালাবে। নারায়ণগঞ্জের এক স্কুলের প্রধান-শিক্ষককে সেদিন উত্তেজিত জনতা পেটালো, চুড়ান্ত অসম্মান করলো। চাকরিটাও নাকি গেছে। ষড়যন্ত্রটা মূলত করেছে স্কুল পরিচালনা কমিটি। প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত ইসলাম নিয়ে কটুক্তি করেছেন, গুজবটি কমিটিই ছড়িয়েছে। এ নিয়ে  গণ্ডগোল বাঁধলে এলাকার সংসদ সদস্য নাকি স্কুলে গিয়ে প্রধান শিক্ষককে আরেক দফা শাস্তি দিয়েছেন। সংসদ সদস্য বলেছেন উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করার জন্য উনি ওই ওঠবসের শাস্তিটা দিয়েছেন শ্যামল কান্তিকে। স্কুল পরিচালনা কমিটির কে নাকি তাঁর আত্মীয়কে প্রধান শিক্ষকের পদে বসাতে চান। সুতরাং বর্তমান প্রধান শিক্ষককে সরাতে হলে একটিই অস্ত্র সবচেয়ে ভালো কাজ করবে। গুজব ছড়িয়ে দাও এই শিক্ষক ইসলাম নিয়ে কটুক্তি করে ছাত্রদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত করেছেন। ধর্মানুভূতিতে আঘাত করার চেয়ে বড় অপরাধ বর্তমান বাংলাদেশে আর কিছু নেই। তোমাকে আমার পছন্দ নয়, তুমি খুন হয়ে যাও আমি চাই, সারা জীবন নরকে যাপন করো চাই, তাহলে আমার একটিই উপায়, আমি বলে বেড়াবো তুমি ইসলাম নিয়ে কটুক্তি করেছো, তুমি মুসলমানের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছো। এরপর আর পেছনে তাকাতে হবে না। অশিক্ষিত জনতাই তোমার বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেবে, ওরাই তোমাকে গুষ্ঠিসুদ্ধ কুপিয়ে মারবে। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ইত্যাদি ধর্ম নিয়ে কটুক্তি করলে কারও ধর্মানুভূতিতে আঘাত লেগেছে বলে শুনিনি বাংলাদেশে। ধর্মানুভূতির রাজনীতি পাকিস্তানে বেশ হয়। হিন্দু খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা মুসলিম মৌলবাদীদের। মাঝে মাঝেই তারা খবর ছড়িয়ে দেয় যে ওই খ্রিস্টান বা ওই হিন্দু মুসলমানের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছে। মনে আছে আসিয়া বিবির কথা? আসিয়া বিবি আজও জেলে। কলের পানি আনতে গিয়েই প্রতিবেশি মেয়েদের মধ্যে ঝগড়া লেগেছিল। আসিয়া বিবি ওখানেই ছিল। আসিয়া বিবির বিরুদ্ধে কেউ একজন ছড়িয়ে দিল গুজব, আসিয়া বিবি নাকি ধর্ম নিয়ে কী বাজে কথা বলেছে, কী বাজে কথা কেউ ভালো করে বলতেও পারেনি। ব্যস, আসিয়া বিবির ফাঁসি চেয়ে বসলো ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। ধর্মানুভূতিতে আঘাত করার অপরাধে এখন খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসী আসিয়া বিবি জেলে। জেলে আছে বলেই বেঁচে আছে। বেরোলেই মানুষ তাকে খুন করবে। কী বলেছিল না জেনেই খুন করবে। মুসলমানের ধর্মানুভূতিতে আঘাত করে কেউ কোথাও বেঁচে থাকতে পারে না। আঘাত করার দরকারও পড়ে না, আঘাত করেছে এরকম গুজব ছড়ালেই যথেষ্ট। আমাকে যখন বাংলাদেশের সব ধর্মপ্রাণ মুসলমান দোষ দিতে শুরু করেছিল আমি তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছি, তারা কিন্তু বলতে পারেনি ঠিক কী বলেছি আমি।

আরও পড়তে পারেন: প্লিজ এই ভালোবাসাকে শাস্তি দেবেন না

মানুষের অনুভূতি সারাদিন নানা কারণে আঘাত প্রাপ্ত হচ্ছে। আমরা যথেষ্ট মনোবল রাখি অনুভূতির আঘাতগুলো মোকাবেলা করে বেঁচে থাকতে। কেউ তোমাকে বলতে পারে, পরীক্ষায় ফেল করা তোমার উচিত হয়নি বা তোমার ব্যবহারটা শালীন নয় বা কাজটা ভালো করে করতে পারোনি। এসব কথা শুনে তোমার অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে। সে কারণে তুমি সমালোচকদের সমালোচনা করবে, কিন্তু কারও মাথায় কিন্তু কোপ মারবে না। কারণ প্রশংসা শুনে আমরা যেমন অভ্যস্ত, সমালোচনা শুনেও অভ্যস্ত। মানুষ শুধু ভালোটাই শুনবে, খারাপটা শুনবে না—এ-ই যদি বিধান হতো, তাহলে চিরকালের জন্য সমাজ এক জায়গায় থেমে থাকতো। খারাপটা আমরা আঙুল তুলে দেখিয়ে দিই বলে খারাপটা আমরা নির্মূল করতে পারি। সমাজ বিবর্তিত হতে পারে।

শ্যামল কান্তি হয়তো আত্মহত্যা করবেন অপমানে। অথবা খুন হবেন সন্ত্রাসীদের হাতে। অথবা দেশ ছেড়ে পালাবেন। কিছু একটা হয়তো হবে। এরকম অনেকে বলছেন। শ্যামল কান্তির অসহায় মুখটি কেবল দেখেছি এবং অনুমান করার চেষ্টা করেছি কতটুকু কষ্ট তার হচ্ছে। যে স্কুলে তিনি ২২ বছর শিক্ষকতা করেছেন, সেই স্কুলের আঙিনায় তাকে এমনই চূড়ান্ত অসম্মান করা হলো। কী হাড়কাঁপানো প্রাপ্তি! শিউরে উঠি এসব দেখে। শ্যামল কান্তি হিন্দু না হয়ে মুসলমান হলেও এভাবে অসম্মানিত হতেন। তবে হিন্দু হলে, লক্ষ্য করেছি, ঘৃণাটা বেশি ছোড়া হয়। 

আমি চাই বাংলাদেশ বাংলাদেশ রয়ে যাক, দুটি তিনটি নয়, বাংলাদেশ একটিই থাকুক। একটি বাংলাদেশই দেশের মতো দেশ হোক। ধনী দরিদ্রের পার্থক্য ঘুচে যাক। সকলেই খেয়ে পরে বাঁচুক। শিক্ষা স্বাস্থ্য পেয়ে বাঁচুক। বদ্ধ বুদ্ধির মুক্তি আসুক। অনুভূতির রাজনীতি শেষ হোক। মানুষ হত্যা বন্ধ হোক। সংখ্যালঘু নির্যাতনের অবসান হোক। মানুষ মানবিক হোক আরও। আমি চাইলেই সব হবে না। হওয়াতে গেলে প্রথম যে কাজটা করতে হবে সেটা হলো সবাইকে চাইতে হবে। অবশ্য শুধু চাইলেই চলবে না। ভালো সমাজ গড়তে হলে ভালো কাজও  করতে হবে। সরকারের ওপর নির্ভর করে বসে থাকলে চলবে না। মানুষই সব বদলাতে পারে। এত মানুষ বাংলাদেশে। সবাই তো এখনও নষ্ট হয়ে যায়নি। 

লেখক: কলামিস্ট