X
বুধবার, ১৮ জুন ২০২৫
৪ আষাঢ় ১৪৩২

কে এদের বলে মানুষ কোপাতে?

তসলিমা নাসরিন
০৪ মার্চ ২০১৮, ১৭:৪৬আপডেট : ০৪ মার্চ ২০১৮, ১৭:৫০

তসলিমা নাসরিন ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল যখন মঞ্চে বসেছিলেন, তার পেছনে দাঁড়িয়েছিল তার আততায়ী, আর দূরে দাঁড়িয়ে মোবাইল টিপছিল তার নিরাপত্তা বাহিনীর দু’জন সদস্য, আর একজন উদাস তাকিয়েছিল অন্য কোথাও। নিরাপত্তা রক্ষীদের কারও চোখ মুহম্মদ জাফর ইকবালকে লক্ষ্য করছিল না, যাকে নিরাপত্তা দিতে তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। দৃশ্যটিই বলে দেয় বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী আলস্য কতটা উপভোগ করে। এবং তারা যে মোটেও নিষ্ঠ নয় কাজে, তা তো আততায়ীর ছুরি বের করে মুহম্মদ জাফর ইকবালকে একাধিক আঘাত করাই প্রমাণ করে। আততায়ীকে হাতে নাতে ধরে ফেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা, নিরাপত্তা রক্ষী নয়। কী করে ধরবে, তারা তো মোবাইলে ব্যস্ত। মনে পড়ছে ১৯৯৩/১৯৯৪ সালে আমাকে দু’জন নিরাপত্তা রক্ষী দিয়েছিল সরকার। ওরা আমার ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো, আসলে রাইফেলকে বালিশ বানিয়ে দিন রাতই ঘুমোতো। একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, এখানে কী কারণে আপনাদের পাঠানো হয়েছে? ওরা বলেছিল, এই বাসার দরজার সামনে বসে থাকার ডিউটি আমাদের। জিজ্ঞেস করেছি, বসে থেকে কী করবেন? কাউকে নিরাপত্তা দেবেন? কেউ আসছে যাচ্ছে কিনা দেখবেন? ওরা বলেছে, বসে থাকা ছাড়া আর কোনও কিছু করার জন্য থানা থেকে ওদের বলে দেওয়া হয়নি। সুতরাং বসে বসে ঘুমোনো ছাড়া আর কোনও কাজ ওদের ছিল না।  

ফয়জুর রহমান নামের আততায়ীর বাড়ি থেকে যে জিনিসপত্র পুলিশ নিয়ে গেছে, সেগুলোর মধ্যে ছিল জিহাদি বই। ফয়জুর জিহাদি হওয়ার ট্রেনিং নিয়েছে। যেরকম দেশের হাজারো যুবক নিয়েছে। তারা জিহাদ করবে, তারা শর্টকাটে বেহেস্তে যাবে। জিহাদ করলে বেহেস্তে যাওয়ার জন্য দিনে পাঁচ বেলা নামাজ পড়ার, সারা মাস রোজা রাখার, ঈদ এলে যাকাত দেওয়ার, বছর বছর হজ করার দরকার পড়ে না। তা ছাড়া আল্লাহর আদেশ নিষেধ মেনে চললেও বেহেস্ত নিশ্চিত কিনা কেউ জানে না, কিন্তু জিহাদ করলে বেহেস্ত নিশ্চিত। পুলসেরাতও পার হতে হবে না, দাঁড়িপাল্লায় কাউকে দাঁড়াতেও হবে না, আখেরাতের মাঠে আর সবার পাপ পূণ্যের বিচার হলেও তাদের হবে না, তারা বিনা বিচারে সোজা বেহেস্তের খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে যাবে ভেতরে, যেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে মুক্তোর মতো গোলাপি হুর। অসংখ্য কুমারী হুর, যাদের কেউ স্পর্শ করেনি আগে। যুবকদের এরকমই শেখায় জিহাদি গড়ার কারিগরেরা। কী করে জিহাদ করতে হয়? যা তাদের শেখানো হয়েছে, তা হলো, খুন করতে হয়, জবাই করতে হয়। কাকে? মানুষকে। যে মানুষই, তারা যা বিশ্বাস করে, সেই বিশ্বাসের বিপরীত কোনও বাক্যও উচ্চারণ করবে, তাকেই। এতে যদি মৃত্যু হয় তোমার, তাতে ক্ষতি নেই। শহীদ হবে তুমি।  

বেহেস্তের জন্য ক্ষেপে উঠেছে তরুণ সমাজ। ওই ফ্যান্টাসির জীবন যদি দুটো মানুষকে কুপিয়ে যাওয়া যায়, তবে যাবে না কেন?

মস্তিস্কে কোনও সারবস্তু না থাকলে সম্ভবত এই হয়, যা লোকে বলে, তাই বিশ্বাস করে, মোটেই বিচার বিবেচনা না করে। যুব সমাজই দেশের ভবিষ্যৎ। দেশকে গড়ে তারাই। আর তাদেরই যদি অলৌকিক রূপকথার মধ্যে ডুবিয়ে পাগল বানানো হয়, তাহলে দেশখানার ভবিষ্যৎ কী, তা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারি। ইসলাম যে কথাই বলুক, কোরানের কোন পাতায় জিহাদ নিয়ে যা-ই লেখা থাকুক,–  চিরকাল মুসলমানেরা বিশ্বাস করেছে, ভালো কাজ করলে ভাগ্যে বেহেস্ত, আর মন্দ কাজ করলে দোযখ। ভালো কাজ মানে মিথ্যে কথা না বলা, অন্যের উপকার করা, অন্যকে বিপদ আপদ থেকে বাঁচানো, অন্যকে না ঠকানো। আশ্চর্য, এখন যে ‘ভালো’ কাজটি  করে বেহেস্ত নিশ্চিত করা যায়, তা মানুষ মারার কাজ। ইসলাম বদলে গেছে নাকি মুসলমানরা বদলে গেছে?

‘জাফর ইকবাল ইসলামের শত্রু, সুতরাং তাকে মেরেছি’, ফয়জুর বলেছে। কে ইসলামের শত্রু, কে ইসলামের বন্ধু – তা বিচার করবে ফয়জুর, চব্বিশ বছরের একটি পথভ্রষ্ট লোক। ফয়জুরদের কেউ সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিতে চায় না মানুষের বিচারের ভার। আল্লাহর ওপর তাদের মনে হয় আস্থা নেই। দুনিয়াকেই আখেরাত বানাতে চায়, দুনিয়াতেই মানুষের বিচার করে ফেলতে চায়। যদি তারা মনে করে দুনিয়াকে শুধু ইসলামের দুনিয়া বানাবে, তাহলে তো কিছু মুক্তচিন্তক আর কিছু প্রগতিশীল লেখক সাহিত্যিক মেরে সেই স্বপ্ন সফল হবে না। ইসলামের নামে একের পর এক নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ফলে বরং যা হবে, তা হলো, মুসলমানদেরও ইসলাম নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হবে, শান্তিপ্রিয় মুসলমানরাও ধীরে ধীরে ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধা হারাবে।

মুশকিল হলো, বাংলাদেশে জঙ্গি মারা হয়েছে প্রচুর, তারপরও জঙ্গি সংখ্যা কমেনি। কমেনি, কারণ জঙ্গিবাদের বীজবপন হয়ে গেছে বাংলাদেশে। যখন ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার জন্য কামড়াকামড়ি করছে, তখনই বপন করা হয়েছে বীজ। রাজনীতিকরা দেখেও তা দেখেননি। উলটে মদত দিয়েছেন। কে কার চেয়ে বেশি ধার্মিক তা যদি রাজনীতিকদেরই জনসমক্ষে দেখাতে হয়, তাহলে সাধারণ মানুষরা তা করবে না কেন? রাজনীতিকরা ধর্মকে ব্যবহার করলে ভোট পান, সাধারণ মানুষরা করলে সম্মান পান। যুক্তিবুদ্ধি কী করে কবে থেকে লোপ পেয়েছে আমার জানা নেই। মানুষ এখন আর মানুষ নেই। কবর থেকে উঠে আসা কংকালের মতো, চিতা থেকে নেমে আসা কয়লার মতো। করোটিতে শুধু হিংসে, ঘৃণা আর লোভ দলা পাকিয়ে আছে।

ফিরে পেতে হবে যুক্তিবুদ্ধি, বিবেক। ফিরে পেতে হবে ভাবনা চিন্তার স্বাধীনতা। শুধু জঙ্গিদের থাকবে কথা বলার আর হত্যা করার অধিকার। আর বাকিরা শুধু বসে বসে মুখ বুজে দেখবো, আর মার খাবো। তা আর কতদিন! সবার এইবার প্রতিরোধ গড়ে তোলার সময়। এখনও সময় আছে, জঙ্গিবাদের যত চারা বপন করা হয়েছে, সব উপড়ে ফেলতে হবে। এ ছাড়া দেশকে বাঁচানো যাবে না, মানুষকেও না।    

লেখক: কলামিস্ট

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইরানের ফরদো পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র?
ইরানের ফরদো পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র?
বিএনপি নেতাকে কুমিল্লায় এনসিপির প্রধান সমন্বয়কারী ঘোষণা নিয়ে যা ঘটছে
বিএনপি নেতাকে কুমিল্লায় এনসিপির প্রধান সমন্বয়কারী ঘোষণা নিয়ে যা ঘটছে
বেনাপোলে রাস্তার ওপর ‘পড়ে ছিল’ ৩৪টি ভারতীয় স্মার্টফোন
বেনাপোলে রাস্তার ওপর ‘পড়ে ছিল’ ৩৪টি ভারতীয় স্মার্টফোন
ডেঙ্গুতে একদিনে হাসপাতালে ভর্তি ২১২, অর্ধেকই বরিশালে
ডেঙ্গুতে একদিনে হাসপাতালে ভর্তি ২১২, অর্ধেকই বরিশালে
সর্বশেষসর্বাধিক