দেশের প্রেস উইংকে কতটুকু ডিজিটাল করা গেছে সেই বিষয়ে কিছু নমুনা হাজির করতে চাই। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তির রাষ্ট্রীয় সফর দিয়েই শুরু করি। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুলগেরিয়ার রাজধানী সোফিয়াতে গ্লোবাল ওমেন্স ফোরামের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে দেশে ফিরেছেন। ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দীক -এর মেয়ে আজলিয়াকে দেখতে প্রধানমন্ত্রী বুলগেরিয়া যাবার পথে লন্ডনে দুই দিনের যাত্রা বিরতি করেছিলেন। দলীয় নেতাকর্মী কিংবা গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাতের পূর্ব নির্ধারিত কোনও কর্মসূচি না থাকায় আমাদেরও তেমন কোনও বাড়তি পরিকল্পনা ছিলো না এই সফর নিয়ে। কারণ প্রেস উইং থেকে বারবার বলা হয়েছে, কোনও মিটিং হবে না, গণমাধ্যমের সঙ্গে কোনও বৈঠকও হবে না। প্রধানমন্ত্রী তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সময় কাটাবেন। তবে প্রধানমন্ত্রী বলে কথা, ব্যক্তিগত সফর হলেও সংবাদ হবে। সরকারি সফর হলেও সংবাদ হবে। তাই আমাদের সব ধরনের সফরেই চোখ কান খোলা রাখতে হয়। প্রধানমন্ত্রী ঢাকা থেকে বিমানে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই লন্ডনে আমাদের অপেক্ষা শুরু হয়, হিথ্রো বিমান বন্দরে নামা থেকেই শুরু হয় সংবাদ। হোটেলে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়ের যেমন গুরুত্ব রয়েছে, তেমনি হোটেলের বাইরে সরকারবিরোধী বিক্ষোভের সংবাদও গুরুত্বপূর্ণ। লন্ডনে চিকিৎসারত লেখক সৈয়দ শামসুল হকের স্বাস্থ্যের খবর নিতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সংবাদের যেমন গুরুত্ব রয়েছে, তেমনি প্রথমবারের মতো বঙ্গবন্ধুর নাতনি টিউলিপের নবজাতককে কোলে নেওয়ার ছবির প্রতিও রয়েছে সাধারণ মানুষের আগ্রহ। আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র থেকে বলা হলো, প্রধানমন্ত্রী কোনও পাবলিক মিটিং-এ বক্তব্য রাখবেন না। লন্ডনের প্রেস উইং বলছে, যেহেতু লন্ডনে প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগত সফর করছেন তাই তেমন কোনও সংবাদ নেই। নাদীম কাদির ভাই (লন্ডনের মিনিস্টার প্রেস) প্রেস রিলিজ দেবেন যথা সময়ে।
আরও পড়তে পারেন: ‘আমি জানি না’
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লন্ডনে এসেছেন আর দলের নেতাকর্মী ও সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠক না করে চলে গেছেন, এমন নজির খুব কম। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি, ১৭মে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের একটি মতবিনিময় সভায় যোগ দিলেন। সেখানেও তাৎক্ষণিকভাবে লন্ডনের ডজন খানেক সাংবাদিককে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হলো। অনেক দর্শনার্থীকে হতাশ করে তাজ হোটেলের ছোট্ট একটি হল রুমে দেড় শতাধিক নেতাকর্মীকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের অনুষ্ঠান করলেন। যদিও প্রধানমন্ত্রী এই অল্প সংখ্যক নেতাকর্মীর মাধ্যমে বাকি সবাইকে শুভেচ্ছা পৌঁছে দিতে বলেছেন, কারণ তাৎক্ষণিকভাবে বড় হল ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি।
আরও পড়তে পারেন: কে হচ্ছেন তালেবানের নতুন নেতা?
প্রসঙ্গে ফিরে আসি, এসএসএফ বললো, কোনও মোবাইল নেওয়া যাবে না, ব্যাগ নেওয়া ও ট্রাইপড (ক্যামেরার স্ট্যান্ড) নেওয়া যাবে না। টিভি সাংবাদিক প্রবেশের অনুমতি থাকলে তার সঙ্গে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেওয়ারও অনুমতি থাকাটাই স্বাভাবিক। ব্যাগ নিতে না দিলে ক্যামেরার প্রয়োজনীয় চার্জার, ক্যামেরার লাইট, ব্যাক আপ ব্যাটারি, বাড়তি ক্যাবল, বুম বা রেকর্ডিং কিট একজন ক্যামেরাপারসন কীভাবে বহন করবেন? নিরাপত্তার খাতিরে মোবাইল ফোন ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা থাকাটা হয়তো যৌক্তিক, কিন্তু নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকে মোবাইল দিয়ে ভিডিও কিংবা অডিও ধারণ এখন স্মার্ট জার্নালিজমের অংশ। ব্রিটিশ সাংবাদিকরা এখন মোবাইল দিয়ে লাইভ নিউজ কভার করেন, স্কাইপ করেন, মাইক্রো ব্লগিং করেন, টুইট করেন, ফেসবুকে ছবি আপলোড করেন। এখনকার ডিজিটাল যুগে সাংবাদিককে মোবাইল ছাড়া প্রবেশ করতে দেওয়া, আর হাত পা বেঁধে বসিয়ে রাখা একই কথা। টেলিভিশন সাংবাদিকদের ছবি ধারণ করার জন্য ক্যামেরা স্ট্যান্ড অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম। ১৭মে অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ৪৫ মিনিট বক্তব্য দিয়েছিলেন, একজন ক্যামেরাপারসনের পক্ষে ৪৫ মিনিট ক্যামেরা হাত দিয়ে ধরে রাখা প্রায় অসম্ভব একটা কাজ। স্ট্যান্ড ছাড়া রেকর্ডিং করে ক্যামেরার কাজের মান বজায় রাখা দুরূহ ব্যাপার। মজার ব্যাপার হলো লন্ডনে আমাদের এসএসএফ ক্যামেরা স্ট্যান্ড ব্যবহার করতে দিলো না বটে, কিন্তু বুলগেরিয়াতে গিয়ে ঠিকই বিদেশি সাংবাদিকদের ক্যামেরা স্ট্যান্ড ব্যবহারে বাধা দেয়নি এসএসএফ! লন্ডনে ট্রাইপড ব্যবহারের অনুমতি ছিলো শুধু বিটিভি’র! এখানেও বৈষম্যমূলক আচরণ ছিলো স্পষ্ট। যদিও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্র নিশ্চিত করেছে ট্রাইপড ব্যবহারে কোনও বাধা নেই, যদি হলে পর্যাপ্ত জায়গা থাকে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকালে আমরা দেখেছি, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর প্রেস টিম বাংলায় স্ট্যাটাস দিয়েছেন, প্রতি ঘণ্টায় মোদির সফর নিয়ে টুইটারে তার ছবি আপলোড করেছে প্রেস টিম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মোদির বাংলাদেশ সফর সম্পর্কে জেনেছে পুরো বিশ্ব! কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওয়েবসাইটে বিদেশ সফর নিয়ে নেই কোনও প্রেস নোট নেই কোনও ফটোফিচার! প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্র বলছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওয়েবসাইটটি প্রধানমন্ত্রীর প্রেস টিমের নিয়ন্ত্রণে নয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওয়েবসাইটে টিমের সঙ্গে যদি প্রধানমন্ত্রীর প্রেস টিমের একটা সমন্বয় করা যায়, তাহলে সহজেই প্রধানমনত্রীর সকল সফরসূচি ও প্রেস নোট ওয়েবসাইট থেকে পেতে পারে গণমাধ্যম কর্মীরা।
২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লন্ডন সফরের সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের সঙ্গে একটি বৈঠক হয়েছিলো। এ্যালিস্টার ক্যাম্পবেল তখন ১০নং ডাউনিং স্ট্রিটের প্রেস কর্মকতা, এ্যালিস্টার ঠিকই বৈঠকের আগের দিন ই-মেইল করে আমাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ও শেখ হাসিনার আলোচনার বিষয়বস্তু কী এবং সেখানে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য কী হবে। এ্যালিস্টার অবশ্য এই সংবাদ প্রচারের একটা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দিয়েছিলেন, বৈঠক শেষ হবার আগে এটি প্রচার করা যাবে না। গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর ওই সফর সম্পর্কে একটু রিসার্চ করার সময় আমরা পেয়েছিলাম। অন্যদিকে বাংলাদেশ হাই কমিশন একই সফরে নিরাপত্তার অজুহাতে প্রধানমন্ত্রী কখন ডাউনিং স্ট্রিটে যাবেন, সে বিষয়ে গণমাধ্যমকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিলো! সেই সফরে ঢাকা থেকে আসা একাধিক গণমাধ্যম কর্মী ডাউনিং স্ট্রিটে প্রবেশ করতে পারেননি আগে থেকে নাম নিবন্ধন না করার কারণে। ঢাকা থেকে লন্ডনে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সংগ্রহ করতে এসে বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকদের বিটিভির ফুটেজ শেয়ার করে নিউজ করতে হয়েছিলো।
অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফোকাস বাংলার ফটোগ্রাফার ইয়াসির কবির জয়কে সাধুবাদ না দিয়ে পারছিনা, তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে তার নিজস্ব ফেসবুক পেজে যথাসাধ্য চেষ্টা করেন প্রয়োজনীয় ছবি আপলোড করতে। অথচ এমন আপডেট থাকা প্রয়োজন ছিলো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে। লন্ডনের মূলধারার কোনও সাংবাদিক যদি প্রধানমন্ত্রীর লন্ডন ও বুলগেরিয়া সফর সম্পর্কে কিছু জানতে চান তিনি প্রথমেই গুগলে সার্চ দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রবেশ করবেন, অথবা বাংলাদেশ হাই কমিশন লন্ডনের ওয়েবসাইটে যাবেন। প্রধানমন্ত্রীর ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে দেখবেন প্রধামন্ত্রীর লন্ডন কিংবা বুলগেরিয়া সফরের কোনও তথ্যই নেই! গ্লোবাল ওমেন্স লিডার্স ফোরামে প্রধান বক্তা হিসেবে প্রধানমনন্ত্রী কী বলেছেন এ বিষয়েও নেই কোনও টুইট! কারণ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কোনও ফেসবুক ও টুইটার আইডি নেই!
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক, বাংলা ট্রিবিউনের বিশেষ প্রতিনিধি ও একাত্তর টেলিভিশনের লন্ডন প্রতিনিধি