প্রশ্ন হলো, যে সরকার অতীতের ভয়ঙ্কর অপরাধের বিচার করতে পারে, এত প্রতিকূলতা অতিক্রম করে বিচার করতে পারে, সেই সরকারের সময়ে ‘আইনের শাসনহীনতা’ এমন আতঙ্কিত রূপ ধারণ করবে কেন! যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলেই দেশে রাতারাতি পরিপূর্ণ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে, দেশের মানুষ মোটেই তা প্রত্যাশা করেন না। মানুষ প্রত্যাশা করেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথে দেশ চলছে কিনা। চলছে, এমনটা দৃশ্যমান নয়। চলছে না, এমনটা স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান।
‘আইনের শাসনহীনতা’ প্রতিষ্ঠা করে এমন কিছু গল্প প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চলছে, যা একই সঙ্গে ভয়ঙ্কর এবং হাস্যকর। এসব বিষয় নিয়ে কিছু কথা।
১. ভয়ঙ্কর কেন? গল্পগুলো যদি সত্যি হয়, তবে দেশে গৃহযুদ্ধ চলছে। জঙ্গি ফয়জুল্লাহ ফাহিমকে নিয়ে পুলিশ অন্য জঙ্গিদের ধরতে গেল। দু’টি গাড়ি, ২০ জন পুলিশ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র-গোলাবারুদ। পুলিশ আগে থেকেই জানত যে, ফাহিমের সহযোগী জঙ্গিরা আক্রমণ করতে পারে। এসব ক্ষেত্রে পুলিশের যুদ্ধের প্রস্তুতি থাকে। পুলিশের ওপর প্রত্যাশিত আক্রমণ হয়েছে। ফাহিমের সহযোগীরা গুলি করেছে। পুলিশও গুলি করেছে। স্বাধীন দেশের একটি জেলা শহরে রাতের বেলায় এমন যুদ্ধ চলেছে। ২০ জন পুলিশ ২০টি আধুনিক রাইফেল দিয়ে গুলি করছে, ফাহিমের সহযোগী জঙ্গিরা গুলি করছে। জঙ্গিরা কয়জন বা তাদের কাছে কেমন আধুনিক অস্ত্র আছে, জানা না গেলেও ধারণা করা যায়। পুলিশের কাছে কী অস্ত্র আছে, তা জেনেই জঙ্গিরা যুদ্ধ করে ফাহিমকে ছাড়িয়ে নিতে এসেছিল। এমন যুদ্ধ জেলা শহরগুলোতে চলছে। ঢাকা শহরের আশেপাশে চলছে। এই যুদ্ধের ঘটনা ‘সত্যি’ হলে তা রীতিমতো ‘গৃহযুদ্ধ’। জঙ্গিরা ফাহিমকে ছিনিয়ে নিতে না পারলেও হত্যা করতে পারছে, যাতে তাদের তথ্য প্রকাশিত না হয়। এসব যুদ্ধে সবসময় জঙ্গি বা সন্ত্রাসীরা বিজয়ী হচ্ছে। পরাজিত হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা তাদের গ্রেফতার হওয়া সহযোগীকে হত্যা করে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যাচ্ছে, ভাঙাচোরা দু’একটি অস্ত্র ফেলে। তার মানে বাংলাদেশে গৃহযুদ্ধ চলছে? ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধে’র গল্প সত্যি হলে, অবশ্যই বাংলাদেশে গৃহযুদ্ধ চলছে।
২. বাস্তবে বাংলাদেশে গৃহযুদ্ধ বা কোনও যুদ্ধই চলছে না। কারণ ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধে’র গল্পগুলো সত্যি নয়। এগুলো অত্যন্ত দুর্বল স্ক্রিপ্টের নাটক। ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের নামে ফাহিমদের হত্যা করা হচ্ছে, ঠাণ্ডা মাথায়। ফাহিমদের থেকে যাতে তথ্য প্রকাশিত না হয়, জঙ্গি বা সন্ত্রাসীদের গডফাদার কারা- এসব তথ্যের কোনোটাই যাতে প্রকাশিত না হয়, সে কারণেই এসব হত্যাকাণ্ড।
কারণ বিশ্লেষণের আগে দুর্বল স্ক্রিপ্টের একটি নমুনা।
ক. অভিজিতের হত্যাকারী পরিচিত দিয়ে ‘শরীফ’কে হত্যা করা হলো।
খ. জানা গেল তার নাম শরীফ না, ‘মুকুল রানা’।
গ. কলেজের খাতা, জাতীয় পরিচয়পত্র প্রমাণ করলো শরীফ নয়, মুকুল রানাকে হত্যা করা হয়েছে।
ঘ. শরীফ নাম দিয়ে পুলিশ মুকুল রানার ছবি প্রকাশ করে পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। মুকুল রানা বিষয়ে কোনও তদন্ত করেনি পুলিশ। মুকুল রানার এলাকা সাতক্ষীরায় যায়নি, মুকুল রানার কলেজ, কলেজের শিক্ষক, মুকুল রানার পরিবার, বন্ধু-এলাকাবাসী কারও সঙ্গে কথা বলেনি পুলিশ। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, শরীফ ‘শিবির’ করতো। নিশ্চয়ই পুলিশের থেকে তথ্য পেয়েই প্রধানমন্ত্রী এমন কথা বলেছেন। মুকুল রানা যে ‘শিবির’ করতো, তার কোনও তথ্য দিতে পারেনি পুলিশ। সাতক্ষীরার যে এলাকায় মুকুল রানাদের বাড়ি, তা জামায়াত অধ্যুষিত।
ঙ. এর অর্থ এই নয় যে, এই অঞ্চলের সব মানুষ জামায়াত করে। মুকুল রানার বাবা বলছেন, তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। স্থানীয় আওয়ামী লীগও বলেনি যে, মুকুল রানাদের পরিবার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় বা জামায়াতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। মুকুল রানা শিবির করতো কী করতো না, এমন কথা আমি জোর দিয়ে বলছি না। বলছি শিবির বা জামায়াত বিষয়ক পরিচিতি দিয়ে যেভাবে প্রচারণা চালানো হয়েছে, তার সত্যতা নিয়ে বড় রকমের প্রশ্ন আছে। এবং এই প্রশ্ন পুলিশই তার কাজ দিয়ে তৈরি করেছে।
চ. তথ্য-প্রমাণ ছাড়া, শরীফ নাম দিয়ে মুকুল রানাকে হত্যা করা হলো। আসলে সে জঙ্গি, অভিজিতের হত্যাকারী, অন্যান্যদের হত্যার পরিকল্পনাকারী, নাকি নিরপরাধ, নাকি সন্ত্রাসী, জামায়াত-শিবির-হিজবুত তাহরির, কোনও কিছুই নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
ছ. মুকুল রানার পরিবার বলছে, তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে গত ফেব্রুয়ারি মাসে। থানায় জিডিও করেছে পরিবার। ধরে নিয়ে যাওয়া এবং কিছু দিন বা কয়েক মাস পরে আবিষ্কার হওয়া কাহিনির বিষয়ক অভিযোগ তো এই প্রথম নয়। পাবনার গ্রাম থেকে ধরে নিয়ে যাওয়াদের কয়েকজনকে তো ঢাকায় আবিষ্কার করতে দেখা গেছে। এমন নজির আরও অনেক আছে। পরিবারের এসব অভিযোগের কি কোনোই গুরুত্ব নেই? তদন্তের দাবি রাখে না? ‘শিবির’ বা ‘সন্ত্রাসী’ পরিচয় দেওয়া গেলেই, হত্যাকাণ্ড বৈধ হয়ে যায়!
৩. গ্রেফতার হওয়া অভিযুক্ত জঙ্গি বা সন্ত্রাসীদের থেকে তথ্য বের না করে, হত্যা করার কারণ কী? সরকার কেন তা করবে? এতে সরকারের লাভ কী? তথ্য বের করে, সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলেই তো সরকারের লাভ। সাধারণভাবে তেমনই মনে হয়। বাস্তবে দেখা যায়, সরকারকে যখন জনগণের ওপর নির্ভর করতে হয় না, তখন প্রশাসনের ওপর নির্ভরশীলতা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। সরকারের ভেতরে অনেক শাখা-প্রশাখা তৈরি হয়। এই শাখা-প্রশাখার কাছে সরকার অসহায় হয়ে পড়ে।
জঙ্গি ফাহিমকে জনগণ ধরে পুলিশের কাছে দেয়। তারপর ফাহিমকে নিয়ে প্রশাসনের ভেতরে টানাপোড়েন শুরু হয়। একটি ‘শাখা’ ফাহিমকে বাঁচিয়ে রেখে তথ্য বের করতে চায়। অন্য একটি ‘প্রশাখা’ ‘বন্দুকযুদ্ধে’র আয়োজন করতে চায়। টানাপোড়েন চলে দু’দিন। এর মধ্যে প্রকাশিত হয়ে যায় ফাহিম ‘হিজবুত তাহরির’র সদস্য-ক্যাডার। ‘প্রশাখা’ কোনোভাবেই চাচ্ছিল না ফাহিমের এই পরিচিতি প্রকাশিত হোক।
৪. হিজবুত তাহরির জঙ্গি সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ। স্মরণ করতে অনুরোধ করবো, ২০০৭-০৮ সালের কথা। সব রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ। তখনও প্রকাশ্যে মিছিল করেছে হিজবুত তাহরির। কয়েক মাস আগে হিজবুত তাহরির’র প্রকাশ্যে অনলাইনে তাদের সম্মেলন করেছে। গোয়েন্দারা তা দেখেছেন, পর্যবেক্ষণ করেছেন। বলেছেন, গ্রেফতার বা ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না ‘কৌশলগত’ কারণে। এটা ঠিক কী ধরনের ‘কৌশল’ তা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। পরবর্তীতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তাও বোঝা বা জানা যায়নি।
হিজবুত তাহরির প্রধান নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ’র শিক্ষক গোলাম মাওলাকে সেই সময় গৃহবন্দি করা হয়েছিল। এখন তিনি কোথায় আছেন তা জানা না গেলেও, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেতন-ভাতা-সুবিধা সবই পাচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে আইনগত কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ড. তৌফিক একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি হিজবুত তাহরিরের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ এবং আর্থিক বিষয়গুলো দেখতেন। পরে তিনি বলেছেন, আর হিজবুত তাহরিরের সঙ্গে জড়িত নেই। কিন্তু তার বিষয়ে কোনও অনুসন্ধান করেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সরকার উৎখাতের আহ্বান জানিয়ে ঢাকা শহরে বিশাল আকারের পোস্টার লাগিয়েছে হিজবুত তাহরির। পোস্টারগুলো এত বড় যে কমপক্ষে চারজন ছাড়া একটি পোস্টার দেয়ালে লাগানো সম্ভব নয়। পোস্টার লাগানো হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তা দেখতে পায়নি। সেই পোস্টার নিয়ে পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশিত হলে, সেই পত্রিকার বিরুদ্ধে বিষাদ্গার করতে দেখা গেছে। হিজবুত তাহরিরের ক্যাডাররা মিছিল করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছে। জামিন নিয়ে বের হয়ে গেছে, জঙ্গি হিসেবে তাদের নামে মামলা হয়নি।
৫. ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যাকাণ্ডের দু’জন হত্যাকারীকে ধরে দিয়েছিল তৃতীয় লিঙ্গের কয়েকজন মানুষ। এই দুই জঙ্গি বলেছিল, তাদের ‘হুজুরে’র নির্দেশে তারা হত্যা করেছে। কে সেই ‘হুজুর’ জানা যায়নি। এই দুই জঙ্গির সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের সম্পৃক্ততা আলোচনা হয়েছিল। হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সরকারের সখ্যতা-হৃদ্যতা তৈরি হয়েছে। রেলের জমি উপহার পেয়েছে হেফাজত। জঙ্গি সম্পৃক্ততার তদন্ত হয়নি ।
৬. কাউকে কাউকে জঙ্গি হিসেবে অভিযুক্ত করবো, জঙ্গি হিসেবে অভিযুক্ত কাউকে কাউকে আড়াল করব- এই নীতিতে আর যাই হোক জঙ্গি তৎপরতা হ্রাস বা নির্মূল হবে না। হিজবুত তাহরিরকে সামনে আনা যাবে না, হেফাজতের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী হত্যাকাণ্ড ঘটবে, অথচ তারা অভিযুক্ত হবে না বা তাদের বিষয়ে কোনও তদন্ত হবে না। হত্যাকাণ্ড ঘটবে, আর বলবো জামায়াত-বিএনপি করেছে। এমন হত্যাকাণ্ড ঘটানোর সামর্থ্য এখন বিএনপির আছে বলে মনে হয় না, জামায়াতের আছে। তদন্ত করে ব্যবস্থা না নিয়ে রাজনৈতিক অভিযোগে সমাধান আসবে না। ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধে’র গল্পে কোনও সমাধান নেই। সেই অপারেশন ক্লিনহার্টের ‘হার্ট অ্যাটাক’ থেকে ‘ক্রসফায়ার-বন্দুকযুদ্ধ’ কোনও গল্পই সত্যি বা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এসব হাস্যকর গল্পে জঙ্গিবাদের আতঙ্ক কমছে না, মানুষের নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে, বাড়ছে মানুষের ক্ষুব্ধতা।
লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক
আরও পড়তে পারেন: ধর্মের নামে কোপাকুপি এবং ১০ ফতোয়া