ধর্মীয় বিদ্বেষ বা বৈষম্যের পাশাপাশি অভিভাবকরা অর্থনৈতিক-সামাজিক বিদ্বেষ, বৈষম্যের অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছে সন্তানদের মধ্যে। সন্তানকে বলে দেওয়া হচ্ছে অপেক্ষাকৃত অসচ্ছ্বল পরিবারের সহপাঠীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব না করতে। এমনকি কে কোন এলাকা থেকে স্কুলে আসছে, বন্ধুত্ব করার বেলাতে, স্কুলের পড়া নিয়ে আলোচনার বিষয়ে সেখানেও অভিভাবকদের দিক থেকে নিষেধের দেয়াল তুলে দেওয়া হচ্ছে। অভিভাবকরা নিজেরাও অন্য অভিভাবকদের সঙ্গে সখ্যতা তৈরির বেলাতে এই দিকগুলো বিবেচনায় রাখছেন। সঙ্গত কারণে সন্তানদের ওপর সেই প্রভাব পড়ছে। সন্তানরা স্কুলে কোন সহপাঠীকে বেছে নেবে সেই ক্ষেত্রে এখন পোশাককে মাপকাঠি হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন অভিভাবকরা। স্কুলে-কলেজে যারা হিজাব পড়ছেন বন্ধুত্ব তাদের মধ্যে সীমিত নির্দেশ দিচ্ছেন একপক্ষ। আরেক পক্ষ বলছেন- হিজাব পড়ছে যারা তাদের এড়িয়ে চলতে। বিভক্তির আরও জায়গা তৈরি করা হয়েছে। বিশেষ করে স্কুলে যে ছেলে বা মেয়েটিকে দেখা যায় গান-নাচ-পাঠ্য বইয়ের বাইরের বই পড়া নিয়ে ব্যস্ত, তাকে এড়িয়ে চলার নির্দেশ দেন কোনও কোনও অভিভাবক। কারণ তারা মনে করেন এমন সহপাঠীকে বন্ধু করলে তার সন্তানের পড়ালেখায় বিঘ্ন ঘটবে।
উপরের তথ্যগুলো থেকে স্পষ্ট, আমাদের সন্তানদের সুন্দর হয়ে বড় হওয়ার পেছনে প্রধান বাধা অভিভাবক হিসেবে আমরা নিজেরাই। আমরাই সন্তানদের মধ্যে বিদ্বেষ ও বৈষম্যের সূত্র শিখিয়ে দিচ্ছি। সাম্যতা, অন্যের ধর্মের প্রতি সহনশীলতা, সহিষ্ণুতা এবং উদার-খোলা মন নিয়ে তাদের বড় হতে দিচ্ছিনা। মুক্তচিন্তা করতে না দিয়ে সন্তানের ভাবনার জমিনে সংকীর্ণতার দেয়াল তুলে দিচ্ছি। অভিভাবক হিসেবে এই অপরাধের সঙ্গে নতুন করে আমরা যুক্ত হইনি। অনেক আগে থেকেই এই অপরাধ আমরা প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্যে করে যাচ্ছি। কিন্তু তার ফলাফল যে আমাদেরকেই পাল্টা আঘাত করবে সেই বোধ ছিল না। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র একপ্রকার অপরাধ অভিভাবকত্বের অপরাধ প্রবণতায় অবচেতনই ছিল। গুলশান ট্র্যাজেডি সেই অবচেতনতায় আঘাত হানলো। আমরা দেখলাম আমাদের উত্তরাধিকাররা সাংস্কৃতিক ভাবে, চিন্তা বা আদর্শের জায়গাতে কোন অবস্থানে আছে। গুলশান ট্র্যাজেডি সমাজের, রাষ্ট্রের বৈষম্যেরই ফলাফল। আমরা শিশুদের মধ্যে স্কুল থেকেই বৈষম্যের যে ‘ছবক’ দিয়ে দিচ্ছি, তা সমাজে বৈষম্যের দেয়ালকে কেবল উঁচু প্রাচীরেই রূপ দিচ্ছি।
এই দেয়াল ভাঙতে হলে আমাদের সন্তানদের কাছেই ফিরে যেতে হবে। তাদের জানাতে হবে বন্ধুত্বে ধর্মের কোনও অবস্থান নেই। সকল ধর্মই সুন্দর ও সহিষ্ণুতার কথা বলে। কোনও ধর্মই বন্ধুকে আঘাত করতে বলেনি। অর্থের দাঁড়িপাল্লা দিয়ে বন্ধুত্ব গড়া যায় না। যে বন্ধুর ভাবনায়, জীবনের অভ্যাসে সাংস্কৃতিক বীজ রোপিত আছে, সেই বন্ধুই অপর বন্ধুর যে প্রয়োজনে পাশে গিয়ে দাঁড়াতে জানে। তার ভাবনার আকাশ অনেক উদার ও বিস্তৃত। সর্বোপরি আমরা আমাদের পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে কেমন দেখতে চাই- সেটা আসলে নির্ভর করছে অভিভাবক হিসেবে নিজে কতোটা সহজ ও সহিষ্ণু। সুতরাং নিজের কাছেই নিজের প্রশ্ন রাখা দরকার- এই আমি কেমন অভিভাবক?
লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি
আরও খবর: গোয়েন্দা নজরদারিতে সারাদেশের মেস