হায় ব্রুটাস, তুমিও!

শুভ কিবরিয়ারোমান রাজনীতিবিদ ও সমরবিদ জুলিয়াস সিজার (১০০- ৪৪ খ্রিষ্টপূর্ব) স্পেনে থাকার সময় একদিন অবসরে মহাবীর আলেকজান্ডারের কথা পড়ছিলেন। আলেকজান্ডার (৩৫৬-৩২৩ খ্রিষ্টপূর্ব)-এর জীবনী পড়তে পড়তে তিনি কেঁদে ফেলেন। এটা দেখে তার বন্ধুরা অবাক হয়ে যান। তার কাছে কান্নার কারণ জানতে চাইলেন। জুলিয়াস সিজার বললেন, ‘তোমরা কি মনে করো আমার কাঁদার কোনও কারণ নেই? আমার বয়সে আলেকজান্ডার কত দেশ জয় করেছেন! আর এই সময়ে আমি তেমন কিছুই করতে পারিনি, যা আমাকে স্মরণীয় করে রাখতে পারে।’
পরবর্তীতে জুলিয়াস সিজার তার অসামান্য রণ নৈপুণ্য দেখান। তিনি অনেক দুর্গম দেশ জয় করেন। অনেক দুরূহ যুদ্ধে জয়লাভ করেন। গলে তাকে দীর্ঘ দশ বছর ধরে যুদ্ধ করতে হয়। এরপর তিনি ঝড়ের বেগে আটশ নগরী অধিকার, তিন শ রাষ্ট্র পদানত, ত্রিশ লক্ষ লোককে পরাভূত, দশ লক্ষ লোককে হত্যা এবং অগণিত লোককে বন্দি করেন।
সৈন্যদের প্রতি জুলিয়াস সিজার ছিলেন দয়ালু ও স্নেহপ্রবণ। সৈন্যরা তাকে ভালোবাসতো প্রাণ দিয়ে। যে সৈন্যরা অন্যান্য যুদ্ধে খুবই সাধারণ ভূমিকা রেখেছে তারাই সিজারের সঙ্গে অভিযানে এসে অসামান্য সাহসের পরিচয় দিয়েছে। যে কোনও বিপদজনক পরিস্থিতির মুখে সুদৃঢ় মনোবল দেখিয়ে বিপক্ষ শক্তিকে মোকাবিলা করেছে।
সিজার নিজেও ছিলেন অকুতোভয় বীরযোদ্ধা। অসম্ভব পরিশ্রম করতে পারতেন। শারীরিকভাবে তিনি ছিলেন কিছুটা রোগা। ছিলেন মৃগী রোগী। কিন্তু শারীরিক দুর্বলতার অজুহাতে তিনি কোনও স্বাচ্ছন্দ্য খোঁজেননি। অভিযানে যাওয়াকেই অসুস্থতা থেকে আরোগ্য লাভের উপায় ভেবেছেন।
দুই.
জুলিয়াস সিজারের বড় কৃতিত্ব হলো গল বিজয়। ৫৮ থেকে ৫০ খ্রিষ্টপূর্বে সময়ে তিনি এই যুদ্ধ জয় করেন। গল হলো আজকের প্রায় সম্পূর্ণ পশ্চিম ইউরোপ। খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫ এবং ৫৪ সময়ে ব্রিটেনেও দুবার যুদ্ধাভিযান করেন সিজার। এই যোদ্ধা এশিয়ায় এসে প্রতিপক্ষকে ক্ষিপ্রতা ও দ্রুততার সঙ্গে পরাজিত করেন। জুলিয়াস সিজারের বিখ্যাত উক্তি- ‘এলাম, দেখলাম ও জয় করলাম’। এই উক্তি বিশ্বশ্রুত হয়ে আছে।

এই সিজার পরবর্তীতে রোমে এসে স্বৈরশাসকের রূপ ধরেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত রোমান সাম্রাজ্য গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। তার বিরুদ্ধে শুরু হয় ষড়যন্ত্র। একদিকে একদল যেমন তাকে দেবতার আসনে বসাতে চাইলেন অন্যদিকে তিনি যাদেরকে নানা রকম সুবিধা ও ক্ষমতা দিয়ে নিজের স্বৈরশাসন পোক্ত করতে চাইলেন তাদের মধ্য থেকেই শুরু হলো চক্রান্ত। এই চক্রান্তের অন্যতম হোতা ছিলেন মার্কাস ব্রুটাস। ব্রুটাসকে জুলিয়াস সিজার নানা সময়ে ক্ষমা ও দয়া করেছেন, দিয়েছেন ক্ষমতাধর পদ। সিজারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত গড়ে ওঠার পর ব্রুটাস সম্পর্কে তাকে গুপ্তচররা অবহিত করলেও তিনি এতে আদৌ কর্ণপাত করেন নাই। কথিত আছে সিজার ওই গুপ্তচরকে নিজের দেহে হাত রেখে বলেছেন, ‘ব্রুটাস আমার দেহের এই চামড়ার জন্য অপেক্ষা করবে।’ এ কথার তাৎপর্য ছিল, সিজার মনে করেন সিজারের পর শাসন করার মতো ক্ষমতা একমাত্র ব্রুটাসের আছে। কিন্তু এই ক্ষমতা ব্রুটাস স্বীয় ক্ষমতাবলে অর্জন করবে- এজন্য তিনি কখনও নিচ বা অকৃতজ্ঞ হবেন না।

ব্রুটাস সম্পর্কে সিজারের এই ধারণা পরবর্তীতে মিথ্যে প্রমাণিত হয়। সিজারকে হত্যাকারীদের মধ্যে ছিলেন ব্রুটাস নিজে। বরং বলা যায় সিজার হত্যাকারীদের পালের গোদা ছিলেন এই ব্রুটাস। কথিত আছে  ২৩ বার অস্ত্রের আঘাতে সিজারকে হত্যা করা হয়। সিনেট হাউজে সিজারকে হত্যার সময় হত্যাকারীদের মধ্যে ব্রুটাসকে দেখে সিজার আত্মস্বরে উচ্চারণ করেন, Et tu Brute অর্থাৎ ব্রুটাস তুমিও!

মৃত্যুর সময় হত্যাকারীদের দলে নিজের প্রিয়ভাজন ব্রুটাসকে দেখে জুলিয়াস সিজারের এই উক্তিটি বিখ্যাত হয়ে গেছে। পৃথিবীর তাবৎ স্বৈরাচার, কর্তৃত্বপরায়ণ শাসকদের হতাশাজনক পতনের পর, প্রিয়ভাজনদের হাতে হেনস্তা কিংবা হত্যার পর এই উক্তি করা এখন প্রায় নিয়মসিদ্ধ হয়ে ওঠেছে।

তিন.

হালে তুরস্কে সামরিক ক্যু ব্যর্থ হওয়ার পর কর্তত্বপরায়ণ শাসক এরদোয়ান তার রাজনৈতিক বিরোধীদের নির্মূলে আরও কঠোর হয়ে ওঠছেন। গোটা দেশে সামরিক বাহিনী, শিক্ষাঙ্গন, প্রশাসন, পুলিশ, বিচারবিভাগ থেকে হাজার হাজার এরদোয়ান বিরোধী বলে কথিতদের উৎখাত করছেন। বছরের পর বছর ধরে এরদোয়ান বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করার যে সুযোগ তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান খুঁজছিলেন এই ব্যর্থ সামরিক ক্যু তার জন্য সেই সুযোগ এনে দিয়েছে। জনগণের হৃদয় জয় করার বদলে শত্রু উৎপাটনে যে শাসকরা মনোযোগী হন তার পরিণতি কখনই ভালো হয় না। রক্ত দিয়ে ক্ষমতা টেকাতে যারা চান, রক্তাক্ত পথেই তাদের বিদায় নিতে হয়। তুরস্কের এরদোয়ান যে ব্যতয় হবেন না সেকথা খুব নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। তবে এরদোয়ান যতদিন শাসন ক্ষমতায় থাকবেন তুরস্ক ততদিন আরও প্রাণসংহার আর রক্তপাতের লীলাভূমিই হয়ে ওঠবে। দেশি- বিদেশি নানা খেলোয়াড় তুরস্কের রাজনীতির এই রক্তপিপাসাকে হয়তো আরও তীব্র করে তুলবে।

চার.

রাজনীতির এই রক্তপিপাসা এখন দেশে দেশে চলছে। বাংলাদেশে হালে আমরা ধর্মবাদী চরমপন্থীদের উত্থান দেখছি। আবার এই চরমপন্থার মূলউৎপাটনের আকাঙ্ক্ষার সর্বত্র সামরিকীকরণের প্রবণতাকে সুস্পষ্ট হয়ে উঠতে দেখছি। দেশের গণতান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠানিকতাকে শক্ত করার বদলে এক ধরনের বলপ্রয়োগ নির্ভর রাজনীতির চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। ভয়ের উৎপাদন এখন রাষ্ট্রিক প্রচেষ্টা হয়ে উঠছে। সবকিছুকে বন্ধ করে, ভীতি উৎপাদনের রাস্তাগুলোকে প্রশস্ত করে ক্ষমতাবানদের নির্ভার করার চেষ্টা চলছে। মুক্তচিন্তার বিকাশের ধারাকে বলপ্রয়োগের নীতিতে পরিচালিত করার আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়ে উঠছে। এই প্রবণতা রাষ্ট্রকে পৃথিবীর কোথাও সফল করেনি। বাংলাদেশেও তা সফল হবে না।

মাঝখান থেকে শক্তিমানরা নানান উপায়ে ভীতিজর্জর রাষ্ট্রের কাছ থেকে নানা অনায্য সুবিধা আদায় করে নেবে। বাংলাদেশে ইতোমধ্যে ভারত, আমেরিকা, রাশিয়া সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েছে। চীন হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এই সুযোগ কাজে লাগাবার জন্যে। আমাদের করিডোর,আমাদের বন, আমাদের সমুদ্র, আমাদের খনিজ সম্পদ, আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশ এভাবে ইতোমধ্যেই নানান ভাবে অন্যদের বিশেষ লাভালাভের ক্ষেত্র হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যদিয়ে আমাদের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বিকাশের সম্ভাবনা জঙ্গিবাদী বিকাশের পথে ধাবিত হচ্ছে।

চার.

সম্প্রতি এক সমাবেশে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ কিছু কথা বলেছেন। কথাগুলোর গুরুত্ব আছে ।

গত ১৯ জুলাই ২০১৬ মঙ্গলবার রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স মিলনায়তনে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম   বলেন, ‘আমি কোনও রাজনৈতিক বক্তব্য দেব না। যা বলব ইশারা-ইঙ্গিতে বুঝে নেবেন। স্বাধীনতার পর স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে আমরা রক্ষা করতে পারিনি। দ্বিতীয়বার যাতে ওই ধরনের ঘটনা ঘটতে না পারে, সে জন্য আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। বাঙালি যেমন বীরের জাতি, তেমনি বেঈমানের জাতিও। তাই আমাদের সজাগ থাকার প্রয়োজন আছে। মনে মনে প্রস্তুতি রাখারও প্রয়োজন আছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ঝড়-বৃষ্টি নেই, গাছের পাতা নড়ছে না, তখন বুঝতে হবে একটা কিছু হতে পারে। তাই আমি ইঙ্গিত দিয়ে বললাম, সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।’

পাঁচ.

লেখাটি শেষ করি একটা পুরনো কৌতুক দিয়েই। স্ট্যালিনের পর সোভিয়েত ইউনিয়নে ক্ষমতায় এসেছেন ক্রুশ্চেভ। পার্টির এক অধিবেশনে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি স্ট্যালিনের কর্মকাণ্ডের তীব্র সমালোচনা করছিলেন। হঠাৎ সভার মধ্যে একজন জোরে বলে উঠলেন, তখন আপনি কোথায় ছিলেন? তখন কেন কোনও কথা বলেননি?

সহসা সভাস্থলে পিনপতন নীরবতা নেমে এলো। ক্রুশ্চেভ গর্জে উঠলেন, ‘কে বললো কথাটা’?

কেউ কোনও উত্তর দিল না।

ক্রুশ্চেভ এবার মুচকি হেসে বললেন , এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছেন তখন আমি কেন চুপ ছিলাম!
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক
আরও পড়তে পারেন: জঙ্গি ধরলে নাটক, না ধরলে সরকার ব্যর্থ!