ওপরের পর্যবেক্ষণটির বাংলা ভাবার্থ দাঁড়ায়, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কোনও ব্যক্তিকে সরকারি, বেসরকারি, সামাজিক বা রাজনৈতিক কোনও প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের কোনও পদে বা দায়িত্বে নিয়োগ দেওয়া যাবে না।
মাননীয় ট্রাইবুনালের এ পর্যবেক্ষণটি নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যখনই কোনও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ব্যক্তি সরকারি, বেসরকারি, সামাজিক বা রাজনৈতিক কোনও প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকেছেন, তারা সেখানে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বিষবাষ্প ছড়িয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অবমাননা করেছেন। দেশ বিদ্বেষী প্রজন্ম সৃষ্টি করেছেন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশ রাষ্ট্র, বাংলাদেশের জনগণ এবং এ দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। সুতরাং , ট্রাইবুনালের এ পর্যবেক্ষণটি একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা বলেই বিবেচ্য।
২০১৩ সালের জুলাই হতে আজ আমরা ২০১৬-এর প্রায় শেষ প্রান্তে উপনীত। প্রায় তিন বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে। কিন্তু ট্রাইবুনালের এই গুরুত্বপূর্ণ নিদের্শনাটি সত্যিকার অর্থে কার্যকর হতে আমরা দেখিনি। অথচ এ সত্যটি আমরা সকলেই অনুধাবন করি যে,বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের কোনও ঠাঁই নেই। তারপরও আমাদের সকল অভিব্যক্তি শুধুমাত্র টেলিভিশন চ্যানেলের মধ্যরাতের তর্ক-বিতর্ক, পত্র-পত্রিকায় কলাম লেখা, আর কিছু সভা-সেমিনার বা মানববন্ধনে সীমাবদ্ধ থেকেছে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিকে বর্জন করার জন্য রাষ্ট্রীয় কোনও সার্কুলার জারি করা হয়নি। কোনও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নীতি-নির্ধারণী রেজুলেশন প্রণয়ন করা হয়নি। কোনও সামাজিক প্রতিষ্ঠান ‘জিহাদ’ ঘোষণা করেনি। এমনকি দেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো কোনও নৈতিক অবস্থান জারি করেনি।
তবে হ্যা, গত শুক্রবারে (১৪ অক্টোবর ২০১৬) আওয়ামী লীগের ৩০তম জাতীয় সম্মেলন উপলক্ষে গঠনতন্ত্র উপ-কমিটির সভায় তিনটি আশাবাদী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এগুলো হলো:
১. যুদ্ধাপরাধী পরিবারের কোনও সদস্য আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্যও হতে পারবেনা;
২. বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িত পরিবারের কোনও ব্যক্তি আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্য হতে পারবেনা; এবং
৩. আওয়ামী লীগের আসন্ন জাতীয় সম্মেলনে দলটির গঠনতন্ত্রে ওপরে বর্ণিত দুটি নিষেধাজ্ঞা সংযোজনের প্রস্তাব করা হবে।
প্রথমেই সাধুবাদ জানাই আওয়ামী লীগ দলটিকে, এ ধরনের সাহসী রাজনৈতিক অবস্থান দেশবাসীর সামনে ঘোষণা করার জন্য। খুব হতাশ হই, যখন দেখি আওয়ামী লীগের এক শ্রেণির সুযোগসন্ধানী ও সুবিধালোভী নেতা-কর্মী ফুল হাতে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিকে বরণ করে নেন। মুক্তিযুদ্ধের আওয়ামী লীগকে যখন এভাবে নৈতিকতার সঙ্গে আপোষ করতে দেখি খুব কষ্ট হয়, বুকটা মুচরে ওঠে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নিরলস আত্ম-উৎসর্গের কথা মনে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় কালিমার ছাপ দেখতে পাই। কিন্তু আজ আওয়ামী লীগের এ বলিষ্ঠ ও দৃঢ় অবস্থান আমাকে আবারও আশাবাদী করে তোলে, লাল সবুজের পতাকাটি যেন শকুনীদের নখর থেকে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পায়।
এখন প্রত্যাশা, দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে। তাদেরও উচিত মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির ব্যাপারে তাদের অবস্থান দেশবাসীর সামনে পরিষ্কার করে তোলা। বাংলাদেশের রাজনীতি এবং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধিতা করা দুটো কখনোই এক সঙ্গে যেতে পারে না। এ দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দলের একটি নৈতিক দায়িত্ব হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়া। সুতরাং, যারাই এ লক্ষ্য থেকে দূরে সরে গিয়ে ভিন্ন লক্ষ্যে কাজ করবে, তাদের এ দেশে রাজনীতি করার কোনও অধিকার থাকবে না। অন্তত সাধারণ জনগণ তা যেকোনও মূল্যে প্রতিহত করবে।
একাত্তরের রাজাকার শিরোমণি গোলাম আযমের মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে মাননীয় ট্রাইবুনাল আরও বলেছেন, ‘We are of the opinion that the government may take necessary steps to that end for debarring those anti-liberation persons from holding the said superior posts in order to establish a democratic and non-communal country for which millions of people sacrificed their lives during the war of liberation.’
অর্থাৎ, ওপরের পর্যবেক্ষণে মাননীয় ট্রাইবুনাল বলেছেন যে, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের সময় লাখ লাখ মানুষ জীবন উৎসর্গ করেছেন। সেই রাষ্ট্রের সরকারের উচিত হবে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষশক্তির কোনও ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বা দায়িত্বে নিয়োগ দানের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা। মাননীয় ট্রাইবুনালের এ ধরনের পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্য হলো, মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষশক্তি যেন রাষ্ট্রের কোনও পদে বা দায়িত্বে নিয়োগ না পায়, সে ব্যাপারে সদা সতর্ক থাকা।
বর্তমানের আওয়ামী লীগ সরকার ইতোমধ্যে কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে যে, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলার মাটিতে করা সক্ষম। এ ব্যাপারে কোনও রকম চাপ দেশি বা বিদেশি, তারা আমলে নেয়নি। যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার সম্পন্ন করার মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। শুধু তাই নয়, আমাদের বিচার ব্যবস্থা এক সময়ের রুঢ় সমালোচনাকারীদেরকেও অভিভূত করেছে, তারা নিজেরাও এখন ভূয়সী প্রশংসা করেন আমাদের বিচার ব্যবস্থার।
মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তিকে রাজনৈতিকভাবে বর্জনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অকুতোভয় সৈনিক হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছে। আমরা চাই, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বর্তমানের আওয়ামী লীগ সরকারও যেন এমন কঠোর অবস্থান নেয়। যুদ্ধাপরাধী পরিবারগুলোর সদস্যরা যেন রাষ্ট্রযন্ত্রের কোনও পদে বা দায়িত্বে আসীন না হতে পারে, তার জন্য সরকার যেন সদা সতর্ক থাকে। আর শুধু সতর্ক থাকলেই হবে না, একই সঙ্গে আইন করে তাদের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে।
আমি আশাবাদী যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেভাবে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তিকে রাজনৈতিকভাবে বর্জন করেছেন, ঠিক তেমনভাবেই সরকার প্রধান হিসেবে রাষ্ট্রীয় সকল পর্যায় হতে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তিকে নির্মূল করবেন।
লেখক: আইনের অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের প্রসিকিউটর