পরে যখন সাত খুন মামলার কৌশলী সাখাওয়াত হোসেনকে মনোনয়ন দেওয়া হলো, তখন বিএনপির নেতা-কর্মী এবং সাধারণ নাগরিকরা স্বস্তিই পেয়েছেন বলা যায়। কারণ নতুন মুখ সাখাওয়াত হোসেন পরিচ্ছন্ন ইমেজের। সাখাওয়াত হোসেন মনোনয়ন দেওয়ার পর আবার আরেকটি অংক তৈরির চেষ্টা শুরু হয়। এই চেষ্টার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের সাধারণ নাগরিকেরা ছিলেন না। ছিলেন যারা দূর থেকে নারায়ণগঞ্জকে দেখে পত্রিকা, টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বক্তব্য রেখে ঝড় তোলার চেষ্টা করেন। তাদের কাছে প্রকৃত মাঠ জরিপটি ছিল না বলেই তারা বলে গেছেন- ২২ ডিসেম্বরের নির্বাচনে সেলিনা হায়াৎ আইভী বলি হতে চলেছেন। তাকে পরাজিত করে সরকার প্রমাণ করবে ভোট সুষ্ঠু হয়েছে। কেউ কেউ এটাও বলার চেষ্টা করেছেন আইভীকে দিয়ে নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করা সম্ভব হবে না। সেখানে শামীম ওসমানের মতো নেতা দরকার। তাই হারিয়ে দিয়ে আইভীর রাজনীতি শেষ করিয়ে দিতে চায় আওয়ামী লীগ। তখন শামীম ওসমান আবার আপন রূপে ফিরতে পারবেন। এবং সাখাওয়াত মেয়র হলেও শামীম ওসমানের বশ্যতা মেনে নিয়েই তাকে চলতে হবে।
নারায়ণগঞ্জের রাজনীতির জন্য স্বস্তির বিষয় হলো আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব নারায়ণগঞ্জের সাধারণ নাগরিকদের মনোভাব পাঠ করতে পেরেছেন। যদি আওয়ামী লীগের কথা বলি- আওয়ামী লীগ প্রকৃত অর্থেই পরিচ্ছন্ন নির্বাচন করতে চেয়েছে, বিজয়ী হওয়ার বাসনাও ছাড়েনি। তাই আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব দেখেছে যেখানে তার সেলিনা হায়াৎ আইভীর মতো প্রার্থী আছেন, সেখানে নির্বাচনকে অপরিচ্ছন্ন করার ঝুঁকি নিয়ে লাভ কী। আইভী ১৩ বছরে যে ইমেজ তৈরি করেছে তার বিনিময়েই জয়ী হয়ে আসতে পারবে। হয়েছেও তাই। দেখা গেছে সেলিনা হায়াৎ আইভী যে ভোট পেয়েছেন তার মধ্যে প্রায় ৯৭ হাজার ভোট তার নিজস্ব ভোট ব্যাংকের। বাকি ৭০ হাজার ভোট তিনি পেয়েছেন আওয়ামী ব্যাংক থেকে। সাখাওয়াত হোসেন যে ৯৬ হাজারের মতো ভোট পেয়েছেন, সেটা বিএনপির নিজস্ব ভোট ব্যাংকের। অর্থাৎ দোদুল্যমান ভোটের পুরোটাই নিজে ইমেজে ব্যালটে নিতে পেরেছেন আইভী। সাখাওয়াত হোসেনকে দিয়ে বিএনপিও লাভবান হয়েছে। তারা নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে নতুন মুখ নিয়ে আসতে পেরেছে। এবং যাকে নিয়ে আসা হয়েছে তার ব্যক্তিগত ইমেজও পরিচ্ছন্ন। আগামী নির্বাচনগুলোকে সামনে রেখে সাখওয়াত হোসেন নিজেকে তৈরি করার সুযোগ পাবেন।
ভোটের ৬ দিন আগে বোস কেবিনের চায়ের আড্ডাতে ছিলাম। আইভী এবং সাখাওয়াতের মাঠের খবর জানতে চাইছিলাম পরিচিতদের কাছে। সেখানে আওয়ামী লীগ-বিএনপি সমর্থক ছিলেন। নেতা পরিচয়ের মানুষও ছিলেন। কিন্তু বোস কেবিনের আড্ডায় কোনও বিভক্তি ছিল না। তাদেরই একজন বললেন- আমাদের দুই প্রার্থীই মানুষ ভালো। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের যে অবস্থা সেখানে সাখাওয়াত হোসেন একটা ইটও বসাতে পারবেন না। যেটা আইভী পারবেন। এই কথা থেকেই কিন্তু বুঝা হয়ে গিয়েছিল ভোটের ফলাফল কোন দিকে যাচ্ছে। কারণ নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দারা উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বন্ধ রাখতে চাচ্ছেন না। উন্নয়ন সক্রিয় রাখতে হলে, আইভীকে তারা সামনে রাখতে চেয়েছেন। তবে সাখাওয়াতকে তারা বর্জন করেননি। আওয়ামী লীগ সমর্থকদের কাছেও সাখাওয়াত হোসেন পছন্দের ও পরিচ্ছন্ন প্রার্থী বলে বিবেচিত ছিলেন।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যে একটিও ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটলো না, তার কৃতিত্ব মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদেরই দিতে হয়। তারা সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। সবাই মিলে চেয়েছেন ভালো নির্বাচন উপহার দেওয়ার। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিবেচনায় ভোট প্রদানের হার কিছুটা হলেও, নির্বাচন পরিচ্ছন্ন হয়েছে। এখানে নির্বাচন কমিশনের কোনও কৃতিত্ব নেই। তারা যদি ভালো নির্বাচন করতে চাইতেন, তাহলে আগের নির্বাচনগুলোতেও পরিচ্ছন্নতা দেখা যেত। নারায়ণগঞ্জ নির্বাচন যে অনুকরণীয় হয়ে রইলো তার কৃতিত্ব অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল এবং প্রার্থীদের। এবং অবশ্যই নারায়ণগঞ্জের নাগরিকদের। জয়তু নারায়ণগঞ্জ।
লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি