আমি নিজে ছোটবেলায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে ‘বুলিইং’ -এর শিকার হয়েছিলাম। পত্রপত্রিকায় ‘বুলিইং’ এর শিকার শিশু-কিশোরদের আত্মহত্যার খবর পড়ে ভাবি এমন একটা কিছু যদি আমিও করে বসতাম তাহলে কোনোদিনই জানা হতো না যেসব বিষয়ের জন্য আমাকে ঘরে বাইরে নির্যাতিত হতে হয়েছিল, তার প্রায় সবই ছিল প্রশংসার বিষয়। অনেক দিক দিয়ে অনেক শিশুর চেয়ে আলাদা ছিলাম আমি, সব শিশুই সব শিশুর চেয়ে আলাদা হয়, এবং সেইসব ভিন্নতার জন্য নিজেকে ‘স্পেশাল’ না ভেবে ‘উটকো’ ভাবতে বাধ্য করা হয়েছিল আমাকে।
আমার নিজের শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল একটা ফুটা হওয়া ঢেউটিনের ছাদ বিশিষ্ট গ্রামের স্কুলে। অন্যান্য বাচ্চাদের চেয়ে তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি লম্বা ছিলাম বলে এসেম্বলির সময় লাইনে সবার পেছনে দাঁড়াতে হতো সবসময়। সেটা কোনও সমস্যা ছিল না যদি না প্রতিনিয়ত লম্বা হওয়ার জন্য ঘরে বাইরে নানান পীড়াদায়ক মন্তব্য শুনতে হতো। ছাত্ররা আমাকে ‘তালগাছ’ বলে ডাকত, বাড়িতে কথায় কথায় বলা হতো ‘দিনে দিনে লম্বা হচ্ছ শুধু, মাথায় কোনো বুদ্ধি নেই’। অনেকে বলতো ‘ বেশি লম্বা তো, তাই বুদ্ধি সব হাঁটুতে’।
একবার বৌচি খেলতে গিয়ে স্কুলের বারান্দায় ঝুলানো রেল লাইনের লোহা-কাটা ঘণ্টায় মাথা টুকে গিয়ে আমার কপাল অনেকখানি কেটে গেলো। নিজের গাল বেয়ে পড়া তাজা রক্ত দেখে আমি যখন ভয়ে অস্থির তখন একজন শিক্ষক ধমক দিয়ে বললেন, ‘এতো লম্বা হয়েছো কেন? আর দৌড়াদৌড়ির সময় মনে রাখতে পারো না যে তুমি তালগাছ?’
স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার সময় বিস্কুট দৌড়ে আমাকে দেওয়া হলো বড়দের গ্রুপে কারণ আমি বেশি লম্বা। এই গ্রুপিং এর যৌক্তিকতা বুঝিয়ে না বলে একটা অপরাধের শাস্তির মত মাথায় চাপিয়ে দেওয়া হলো বিষয়টা। এইসব মিলিয়ে নিজের শরীরকে ঘৃণা করতে শুরু করলাম একসময়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্র্যাক্টিস করতাম কীভাবে দাঁড়ালে আমাকে একটু খাটো দেখাবে। ফলে একসময় দেখা গেলো আমি কুঁজো হয়ে হাঁটছি। নিজের বাড়ন্ত বুক লুকিয়ে রাখার চেষ্টাও ছিল এর একটা কারণ। বড় হয়ে যখন জানতে পারলাম লম্বা হওয়া একটা সৌভাগ্যের বিষয় তখন বেশ অবাক হয়েছিলাম কিন্তু তেমন একটা আনন্দিত হতে পারিনি, কারণ ততদিনে বুঝে গেছি আমি খাটো হলেও আমাকে অন্যরকম নির্যাতন সইতে হতো। সমালোচনা আর নিন্দা ছাড়া শিশুর মানসিক বিকাশ সাধনের আর কোনও পদ্ধতি আমাদের দেশের মানুষের জানা নেই।
ষষ্ঠ শ্রেণির ষান্মাসিক পরীক্ষায় প্রথম হয়ে আমি আমার পরিবারের টনক নড়িয়ে দিলাম, আমাকে আরও ভালো স্কুলে পাঠাতে হবে। আমরা সিলেট শহরের ভালো স্কুলগুলো থেকে পাঁচ মাইল দূরের একটা গ্রামে থাকতাম, তবু যাতায়াতের অসুবিধা অগ্রাহ্য করেও পরের বছর আমাকে শহরের সবচেয়ে ভালো স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হলো। প্রথম দিন কম্পিত পায়ে স্কুলের গেটের ভেতর ঢুকে হতভম্ব হয়ে গেলাম। কী চৌকশ মেয়েগুলো! কী কথাবার্তা! কী হাঁটার স্টাইল! নিজেকে খুব বেমানান মনে হলো এদের ভিড়ে। যাই হোক, আমি পড়তে এসেছি, স্টাইল দিয়ে কি হবে?
গুটিগুটি পায়ে ক্লাসরুমে ঢুকে সামনের বেঞ্চেই একটা খালি সিট পেয়ে বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর একটা মেয়ে এসে ধমকে উঠল,
‘এই, তুমি কে? এখানে বসেছ কেন?’
‘জায়গা খালি ছিল তো’।
সে আমাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে বলল,
‘কোন জঙ্গল থেকে এসেছ? এখানে সবার নিজস্ব সিট থাকে। যাও, পেছনে গিয়ে বসো’।
আমাদের গ্রামের স্কুলে কারো আলাদা বসার জায়গা ছিল না। আব্বার মিলিটারি নিয়মে আমরা কাক-ডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠতাম, সবার আগে স্কুলে গিয়ে হাজির হতাম, সবসময় সামনের বেঞ্চে বসতাম। আমি কী করে জানবো শহরের স্কুলের হালচাল? পেছনের দিকের বেঞ্চগুলোর দিকে তাকিয়ে মিনমিন গলায় বললাম,
‘পেছনে জায়গা নেই তো।’
সে আমার ব্যাগটা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে বলল,
‘তাহলে মাটিতেই বসো’।
ক্লাসের সব মেয়েরা হো হো করে হেসে উঠলো। কয়েকদিনের মধ্যেই টের পেলাম স্কুলে মেয়েটার ভীষণ দাপট, গার্লস গাইডের লিডারের চ্যালা সে, পরবর্তিতে সে’ই লিডার হবে।
তার কারণে নতুন স্কুলের অনিশ্চয়তার কষ্ট অনেক গুণে বেড়ে গিয়েছিল। আমার গ্রাম্য চলাফেরা, কথাবার্তা, তেল চপচপে চুলে গ্রাম্য কায়দার বেণী, মায়ের উপদেশ মতো মাথা বুক ওড়না দিয়ে পরিপাটি করে ঢেকে রাখা, সবকিছুই ছিল তাদের কাছে কৌতুকের বিষয়। এসব কথা কাউকে বলার সাহস পাইনি কখনও, বললে খুব লাভ যে হতো তাও না। শুধু লুকিয়ে লুকিয়ে অনেক কাঁদতাম। মরে যেতে ইচ্ছে করত। আমার গ্রামের স্কুলের বাচ্চাদের হাসি-ঠাট্টাকে এসবের কাছে পানিভাত মনে হতো।
তারপর এসএসসি পাস করা পর্যন্ত তিনটি বছর আমি ওই মেয়ের ছায়া না মাড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছি যদিও ভাগ্যক্রমে খুব বেশিদিন এসব নির্যাতন সইতে হয়নি আমাকে। কিছুদিনের মধ্যেই বাংলার শিক্ষিকা রওশন ম্যাডামের সুনজরে পড়ে গেলাম, তিনি আমার লেখা রচনাগুলো ক্লাসে পড়ে শুনিয়ে বলতে লাগলেন, ‘দেখো কী সুন্দর করে আপন মনে গুছিয়ে লিখেছে’। রওশন ম্যাডাম কোনোদিনই জানতে পারবেন না তার ওইটুকু প্রশংসা আমার কতটা উপকার করেছিল। নিজের কাছে নিতান্তই অকেজো অপদার্থ প্রতিপন্ন হওয়া থেকে বেঁচে গিয়েছিলাম, ক্লাসের মেয়েরা কিছুটা সমীহ করতে শুরু করায় ‘বুলিইং’ -ও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
গতবছর ফেসবুকে একজনের বন্ধু-তালিকায় ওই মেয়েটিকে দেখে বন্ধু হওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম আমি, সে গ্রহণও করেছিল কিন্তু কখনও তার সঙ্গে কোনও ধরনের আদান প্রদান হয়নি। কিছুদিন পর লক্ষ্য করলাম সে আমাকে ডিলিট এবং ব্লক করে দিয়েছে। হয়তোবা তার হাতে নির্যাতিত একটি মেয়ের এতোটা উজ্জ্বলভাবে টিকে থাকা মেনে নিতে পারেনি সে, অথবা হয়তো নিজের আচরণের কথা মনে করে লজ্জা পেয়েছে। অনেক কিছুই হতে পারে।
কিন্তু সবকিছুর পর স্কুলজীবনের সেই ‘বুলিইং’ যে আমার কোনও ক্ষতি করেনি তা হলফ করে বলতে পারবো না। আমার যতটা আত্মবিশ্বাসী হওয়ার কথা ছিল ততটা আমি নই। ইউকে তে শিক্ষকতা করছি বহুবছর হলো। বছরে দু’বার আমার লেসন অবজারভেশন হয়, এবং প্রতিবার আমাকে বলা হয়, ‘তুমি ভালো শিক্ষক, কিন্তু তোমার আত্মবিশ্বাসের অভাব প্রকটভাবে চোখে পড়ে’।
একবার আমার বসকে বলেছিলাম, ‘নিজেকে ওভারএস্টিমেট করার চেয়ে আন্ডারএস্টিমেট করা ভালো নয় কি?’
সে উত্তরে বলেছিল, ‘দু’টোই খারাপ। নিজেকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে শিখতে হবে’।
এই কাজটাই শিখিনি কখনও, নিজের মূল্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া, কারণ সবসময় নিজের গুণগুলোর জন্যই সমালোচিত হয়ে এসেছি ছোট থেকে।
শিশুর মানসিক বিকাশের দায়িত্ব যাদের হাতে সেই মা-বাবা অথবা শিক্ষকরাই অনেক সময় শিশুকে বুলি করেন, তার মনোবল ভেঙে দেন, তাকে বাকি পৃথিবীর হাতে অসহায় করে তোলেন। এরকম পরিস্থিতিতে বড়দের ওপর ভরসা করতে শেখেনা শিশুরা এবং সহপাঠীদের হাতে নির্যাতিত হলে অভিযোগ করবার জন্য একটা নিরাপদ, নিশ্চিত স্থানও তাদের থাকে না। আর এর পরিণাম হতে পারে খুবই করুণ।
এ গেল সমস্যার কথা। কিন্তু সমাধানের পথ কী? উন্নত দেশগুলোতে বুলিইং কে একটি গুরুতর বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মা-বাবাকে বুলিং এর প্রতি সচেতন করে তোলার পাশাপাশি শিক্ষকদের এবিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। খুব ছোট ক্লাস থেকে শিক্ষকরা বাচ্চাদেরকেও এসব বিষয়ে সচেতন করে তোলার চেষ্টা করেন। এসব নিয়ে গল্প লেখা হয়, ভিডিও বানিয়ে শিশুদের দেখানো হয় যাতে তারা শিখতে পারে কাউকে বুলি করা কতবড় অন্যায় অথবা তাকে কেউ বুলি করলে সে কী করবে।
একটা শিশুকে যত ভালো স্কুলেই পাঠানো হোক না কেন, যত ভারী বই পড়ানো হোক না কেন, তার বেড়ে ওঠার পরিবেশকে যদি সুন্দর করা না যায়, তাকে যদি নিজের গুণাবলী সম্পর্কে সচেতন করে তোলা না যায় তবে সেই শিশু কোনদিনই বড় হয়ে নিজের সকল সম্ভাবনাকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে পারবে না। কাজেই শিশুর মানসিক বিকাশের প্রতি আরো সচেতন হওয়ার, শিশুর জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তুলতে আরও সচেষ্ট হওয়ার অনুরোধ জানাই সংশ্লিষ্ট সকলকে।
লেখকঃ: যুক্তরাজ্য প্রবাসী শিক্ষক ও অনুবাদক