গ্রামীণফোনের নারী দিবস ক্যাম্পেইন নিয়ে অনেক ট্রল হলো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক আলোচনা-সমালোচনাও করলাম আমরা। এবার আসুন একটু গুরুত্বের সঙ্গে দেখি বিষয়টাকে।
কিছু পুরুষ মজা করে বলছেন, ‘হ্যাঁ, আমরা চাই নারীরা ব্যবসা সামলাবে, আর আমরা ঘর সামলাবো।’
মজা করে বললেও কথাটার মধ্যে এক ধরনের তাচ্ছিল্য রয়েছে। তারা আসলে ইঙ্গিত দিতে চাইছেন যে ঘর সামলানো সহজ ব্যাপার। পক্ষান্তরে ব্যবসা চালানো, যা পুরুষের কাজ বলেই বিবেচিত হয়ে আসছে, অপেক্ষাকৃত কঠিন। এই কঠিন দায়িত্ব গ্রহণের জন্য তাচ্ছিল্যের সঙ্গে নারীর প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছেন তারা।
আসলে সংসার বলুন আর ব্যবসা বলুন, যেকোনও কিছু চালানোর ক্ষেত্রেই কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, কৌশল রপ্ত করার ব্যাপার রয়েছে। নারী পুরুষ উভয়েই চাইলে এগুলো রপ্ত করতে পারেন। তবে যথেষ্ট ইচ্ছা, আগ্রহ, একাগ্রতা, চর্চা এবং সময়ের প্রয়োজন।
ব্যাপার হচ্ছে নারীর ঘর ছেড়ে বাইরে বেরোনোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে অনেক দিন হলো। বিভিন্ন কারণে নারীকে অর্থনৈতিক মুক্তি এবং সামাজিক নিয়ন্ত্রণ অর্জনের চেষ্টা করতে হয়েছে, ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে হয়েছে, চাকরি এবং ব্যবসায় দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা করতে হয়েছে। এবং বিশ্বজুড়ে বিশাল সংখ্যক নারী এতে সফল হয়েছেন। গৃহকর্মীর কাজ বলুন, গার্মেন্টসের কাজ বলুন, করপোরেট চাকরি, ব্যবসা, শিক্ষা, চিকিৎসা, আইন, অথবা যোগাযোগমাধ্যম বলুন– সব ক্ষেত্রেই এখন নারীর বিচরণ। অবাধ বলবো না, প্রচুর বাধাবিপত্তি মোকাবিলা করেই এসব ক্ষেত্রে তাদের বিচরণ। আবার একই সঙ্গে ঘরের হালও সে ধরে রেখেছে, যেটাকে প্রশংসার চোখে দেখা হয়ে থাকে।
কিন্তু জগৎজুড়ে যে সংখ্যক নারী বাইরের জগতে বিচরণ করতে শিখেছেন, সেই সংখ্যক পুরুষ কি ঘরে থাকা বা সংসার সামলানো শিখতে পেরেছেন, অথবা তাদের কি শিখতে দেওয়া হয়েছে? নারীকে বাইরে বেরোতে যতটা উৎসাহ দেওয়া হয়, পুরুষকে কি সেই হারে ঘরে থাকতে উৎসাহ দেওয়া হয়? নারীর জন্য ব্যবসা সামলানোকে যতটা গ্ল্যামারাস মনে করা হয়, পুরুষের জন্য ঘর সামলানো কি এখনও ততটাই লজ্জাজনক এবং দুর্বলতার পরিচায়ক বলে বিবেচনা করা হয় না?
তো, ঘটনাটা কী দাঁড়ালো? সব মিলিয়ে নারীরা বাইরে যতটা সময় দিচ্ছেন, পুরুষরা ঘরে ততটা সময় দিচ্ছেন না বা দিতে পারছেন না। ফলে ঘরের মোট সময়ের বরাদ্দ অনেকটাই কমে এসেছে। এতে ঘরের ভিত্তি ক্রমশই নড়বড়ে হয়ে পড়ছে। সব মিলিয়ে আমরা একটা সামাজিক ভারসাম্যের অভাব সৃষ্টি করেছি, যার ধকল নারীকেই পোহাতে হচ্ছে এবং এর কুফল ভোগ করবে আমাদের সন্তানরা। মা এবং বাবা দুজনেই যখন বাইরে, সন্তান তখন অনেক কম মনোযোগ ও যত্ন পাচ্ছে এবং এর দায়ভার চাপানো হচ্ছে শুধু নারীর ওপরেই। যদিও মা-বাবা দুজনেই বাইরে ব্যস্ত থাকেন, সন্তানের অসুস্থতার জন্য, শিক্ষা বা অন্য কোনও ক্ষেত্রে ব্যর্থতার জন্য মাকেই দায়ী করা হয়। দায় যারই হোক, এই ভারসাম্যের অভাবের ফলে নিকটবর্তী ক্ষতিটা হচ্ছে সন্তানদের, এবং সুদূরপ্রসারী ক্ষতিটা হচ্ছে আমাদের সবার- অর্থাৎ গোটা সমাজের।
কাজেই কে কী সামলাবো তা নিয়ে ধস্তাধস্তি বাদ দিয়ে আমাদের আরও গভীরে তাকাতে হবে, সমঝোতার পথ খুঁজতে হবে, ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে হবে। বাইরের জগৎ ত্যাগ করে নারীর ঘরে বসে থাকাই সমাধান নয়, কারণ সেক্ষেত্রে তার প্রতি নিগ্রহের মাত্রা বেড়ে যাবে। পক্ষান্তরে, ঠাট্টা না করে পুরুষরা যদি আসলেই ঘরের অর্ধেক দায়িত্ব এবং দায় নিজ কাঁধে তুলে নিতে পারেন, তাহলে বেশ হয়।
আসলে দীর্ঘদিন ধরে একটু একটু করে সৃষ্টি হওয়া একটা সামাজিক সমস্যার সমাধান একবাক্যে বলে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে ট্রল আর বিদ্রূপ বাদ দিয়ে মূল সমস্যাটা চিহ্নিত করতে পারলে তা হবে সমাধানের পথে ছোট হলেও একটা ইতিবাচক পদক্ষেপ। আমরা যদি এটুকুও করতে না পারি তাহলে ভারসাম্যহীন এই সমাজ সামলাতে একসময় হিমশিম খাবো নারী-পুরুষ সবাই।
লেখক: অভিবাসী শিক্ষক ও অনুবাদক