আজকে, টেলিভিশনে আমরা কিছু করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে জানতে পারি সুদূর পশ্চিম আফ্রিকার এক দেশ সিয়েরা লিওনে বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃত দেওয়া হয়েছে, কিন্তু আমরা কি জানি কেন? ২০০২ সালে বাংলাদেশের বীর সৈনিকদের সিয়েরা লিওনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান উপলক্ষে, বাংলাদেশি সৈনিকদের বানানো ৫২ কিলোমিটার রাস্তা উদ্বোধনের সময় সিয়েরা লিওনের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট আহমেদ তেজান কাব্বা বাংলাকে সে দেশের সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন।
একটি টেলিকম প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দেখে হয়তো আমরা তাদের বাহবা দেই, কিন্তু তারা কি এই বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের অবদানকে যতসামান্য হলেও কোনরূপ সমাদর করেছেন?
বিশ্বের ১৪৩টি দেশে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো অর্থ নিয়ে সরকার কিংবা রাজনীতিবিদগণ খুব গর্ব করেন কারণ তা দেশের অর্থনীতিতে খুব বড় ভূমিকা রাখে। অথচ, পৃথিবীর যুদ্ধ বিধ্বস্ত এলাকায় যখন প্রবাসী বাংলাদেশিরা মানবতের জীবন কাটান তখন তাদেরকে নিয়ে আমাদের কোনও মাথাব্যাথা নেই। আজ, প্রবাসী শ্রমিক এবং কবি মুকুল অথবা জুয়েল যখন আন্তর্জাতিক পত্রিকার পাতায় স্থান পান এবং নিজেদের লেখা দিয়ে বিশ্বে বাংলা ভাষার স্থানকে দৃঢ় করে চলেছেন। অথচ তাদের নিয়ে চলে মানবতার বাণিজ্য; দেশের হাইকমিশনের সাংস্কৃতিক কোনও আয়োজনে তাদের ঠাই হয় না। কারণ, তারা শ্রমিক এবং অনেকেই বলেন তারা মূলধারার লেখক নন!
আমেরিকা থেকে ইউরোপ, আফ্রিকা থেকে এশিয়া, পৃথিবীর যে প্রান্তেই একজন দেশপ্রেমী বাংলাদেশি আছেন তারা তাদের নিজের উদ্যোগে একুশে ফেব্রুয়ারি তথা ভাষা শহীদদের কথা জানান দিয়ে যাচ্ছেন। গত বছর ঠিক এই সময়টাতে আমিও আমার বিভাগের শিক্ষক এবং ভাষাবিদদের সামনে ভাষা শহীদদের নিয়ে কথা বলেছি। তাদের অনেকেই অবাক হয়েছেন আমাদের বীর ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগের কথা শুনে এবং দৃঢ় শপথ নিয়েছেন পৃথিবীর বিপদাপন্ন ভাষাগুলোকে সংরক্ষণে নিজেদের আরও বিলিয়ে দিতে।
লেখার বিষয়বস্তুর সঙ্গে সম্পর্কিত বিধায় আরও একটি ঘটনা সবার সঙ্গে ভাগ করছি। গত কয়েক সপ্তাহে টেলিভিশন এবং পত্রিকায় ভাষা নিয়ে, বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রায় মৃত ভাষা, রেংমিটচা নিয়ে কয়েকটি সংবাদ দেখা এবং পড়ার সুযোগ হয়েছে।
সংবাদগুলো দেখে এবং পড়ে আমি নিজ মনে হেসেছি কয়েকবার। আমার মনে পড়ে, ২০০৯ সালে আমেরিকান ভাষাবিদ ডেভিড পিটারসনের নেতৃত্বে আমরা ৫-৬ জন আলিকদম থেকে প্রায় ৪ ঘণ্টা ছড়া এবং উঁচু পাহাড় বেয়ে এক গ্রামে গিয়েছিলাম রেংমিটচা ভাষী খুঁজে বের করতে। সৌভাগ্যক্রমে, আমরা একজন মহিলা এবং একজন পুরুষ রেংমিটচা ভাষীর খোঁজ পাই। তাদের মধ্যে একজন কিছু কিছু রেংমিটচা শব্দ তখনও বলতে পারতেন এবং আরেকজন খুব ভালো না হলেও গবেষণার কাজ চালিয়ে যাওয়ার মতো রেংমিটচা বলতে পারতেন। তখন পর্যন্ত সরকারিভাবে এই ভাষার কোন হদিস ছিল না। পেশা বা ব্যক্তিগত অনেক কারণেই হয়তো আমরা অনেক কিছুই এড়িয়ে যাই, কিন্তু যে মানুষগুলো ভাষার প্রতি নিখাঁদ ভালোবাসা থেকে বিপদাপন্ন ভাষা নিয়ে কাজ করেন তাদেরকে ন্যূনতম স্বীকৃতি না দেওয়া বড়ই অনৈতিক।
উপসংহারটা হয়তো লেখার মূলভাবের সঙ্গে যাবে না। তারপরও, আমি শেষটা এভাবেই করতে চাই। কেউ কি কখনও উপলব্ধি করেছেন যে পশ্চিম পাকিস্তান যেমন আমাদের ভাষা এবং সংস্কৃতিকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল, ঠিক তেমনিভাবে ভাষার জন্য লড়াই করা এক বীর জাতি হিসেবে ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় হোক, আমরা আমাদের প্রথাগত পদ্ধতিতে বসবাসকারি জনগোষ্ঠীদের ভাষা এবং সংস্কৃতি নিয়ে একই ধরনের খেলায় নিমজ্জিত আছি। বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতার কারণে কিছু উদ্যোগের কথা আমরা শুনতে বা দেখতে পাই, কিন্তু যারা মাঠ পর্যায়ে এই উদ্যোগগুলোর সুবিধা পাবে, তাদেরকে বাহিরে রেখে তথাকথিত বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ বা কর্ম পরিকল্পনায় কখনই প্রথাগত পদ্ধতিতে বসবাসকারী জ়নগোষ্ঠী- চাকমা, মারমা, সাওতাল, হাজং, সাদ্রি, ম্রো, খেয়াং, খুমি, খাসি, কক বরক, চাক, বম, ত্রিপুরা, লুসাই, প্রভৃত- এদের কেউই এই উদ্যোগগুলো থেকে যথাযথ সুবিধা পাবে না।
শুধুমাত্র ফেব্রুয়ারি মাসে ভাষার জন্য ভালোবাসা তুলে না রেখে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা একটু সচেষ্ট হলেই বাংলা এবং বাংলাদেশের অন্যান্য ভাষাগুলোকে যথাযথ সম্মান এবং মূল্যায়ন করতে পারব। কথায় আছে, নৈতিক শিক্ষা পরিবারেই শুরু হয়। যেদিন থেকে বাংলা ভাষাভাষী সত্যিকার অর্থে বাংলাকে মনে ও প্রাণে ধারণ করবে এবং রাজনীতির উর্ধ্বে থেকে রফিকুল ইসলাম, শান্তি রক্ষায় নিয়োজিত বাংলাদেশি বীর সৈনিক কিংবা পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা দেশপ্রেমী ও ভাষাপ্রেমীদের মূল্যায়ন করতে শিখবে সেদিন থেকেই শুধু বাংলা নয় বাংলাদেশের প্রথাগত পদ্ধতিতে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার্থে গৃহীত উদ্যোগগুলো সফল হবে এবং তাতে ভাষার জন্য যারা জীবন দিয়েছেন এবং বিদেশে বিভিন্নভাবে অবদান রেখে যাচ্ছেন তাদের প্রতি কিছুটা হলেও সম্মান জানানো হবে। একুশে ফেব্রুয়ারির সত্যিকার চেতনায় সকলেই বছরের ৩৬৫ দিন নিজ নিজ ভাষা চিন্তায় এবং কাজে উজ্জীবিত থাকুক।
লেখক: ভাষাবিদ, ভাষাবিজ্ঞান ও বহুভাষা অধ্যয়ন বিভাগ, নানিয়াং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিঙ্গাপুর।