কথা বলছিলাম মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত ‘ডুব’ চলচ্চিত্রটি নিয়ে। গত বছরের নভেম্বর মাসে কলকাতার একটি শীর্ষ স্থানীয় পত্রিকা প্রায় হলফ করেই লিখলো যে, ‘ডুব’ ছবিটি হুমায়ূন আহমেদের জীবনের একটি অংশ নিয়ে নির্মিত। পত্রিকাটি পড়ে জানতে পারলাম, বলিউডের অভিনেতা ইরফান খান নাকি ‘ডুব’ চলচ্চিত্রটিতে অভিনয় করেছেন হুমায়ূন আহমেদের চরিত্রে। এর পরপরই এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন এমন একজন অভিনেত্রী বাংলাদেশের মিডিয়াতে স্বীকার করেছেন যে, ‘ডুব’ এর যে গল্পটি শুটিং পর্যন্ত তিনি দেখেছেন-জেনেছেন, তা হুমায়ূন আহমেদের জীবনে প্রায় হুবহু ঘটেছে। তিনি জানান, তার চরিত্রটির সঙ্গে প্রয়াত লেখক হুমায়ূন আহমেদের প্রথম পক্ষের স্ত্রী গুলতেকিন খানের সঙ্গে মিল রয়েছে। ফলে, সিনেমাটির গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র যখন এভাবে বলে, তখন সাধারণ মানুষের বুঝতে আর বাকি থাকে না যে, এটি হুমায়ূন আহমেদের জীবন থেকেই নেওয়া।
অথচ, দুদিন আগেই বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় পড়লাম, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী দাবি করেছেন যে, ‘ডুব’ চলচ্চিত্রটির গল্প মৌলিক! কেমন যেন গোলমেলে লাগছে না ব্যাপারটা? একদিকে ছবিটির অন্যতম প্রধান একটি চরিত্র বলছে যে ছবিটির গল্পের সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের জীবনীর প্রায় হুবহু মিল আছে! তাহলে কার কথা বিশ্বাস করব আর কার কথা বিশ্বাস করব না? ধরে নিলাম, ছবিটির পরিচালক হিসেবে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর বক্তব্যই সত্য। ফারুকী তার ভেরিফাইড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ছবিটি নিয়ে নানা সময় নানা ধরনের বক্তব্য পেশ করেছেন। একটি লেখায় তিনি কলকাতার শীর্ষস্থানীয় ওই পত্রিকার খবরটিকে গুজব বলে আখ্যায়িত করেছেন। ঠিক আছে, ধরে নিলাম পত্রিকাটি গুজব ছড়িয়েছে। এই ধরনের একটি গুজব ছড়ানোর কারণে ফারুকী তো পারতেন এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে। তাহলে, কোনও ব্যবস্থা কেন নিলেন না তিনি? আচ্ছা ধরে নিলাম, এমন নামিদামি একটি পত্রিকার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সময় নেই ফারুকীর। কিন্তু ছবিটির কলাকুশলীদের মধ্যেই যখন একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র স্বীকার করলো যে, ‘ডুব’ চলচ্চিত্রটির সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের জীবনের প্রায় হুবহু মিল আছে, তখন অন্তত ওই অভিনেত্রীর বিরুদ্ধে তো গুজব ছড়ানোর প্রতিবাদ করা যেত! কই ফারুকী তো তেমন কিছুই করেননি? এমন যদি হতো ওই অভিনেত্রীর সঙ্গে এখন আর সিনেমাটির কোনও সম্পর্ক নেই, তা হলেও ফারুকীর কথায় আস্থা রাখা যেত। ওই অভিনেত্রী তো তার নির্ধারিত ভূমিকায় থেকেই বলছেন, ছবিটির সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের জীবনের হুবহু মিল আছে, অথচ ফারুকী বলছেন এটি একটি মৌলিক গল্প! বিষয়টা কেমন যেন হাস্যকর লাগছে না?
তার মানে, কী দাঁড়ালো ব্যাপারটা? ছবিটির কলাকুশলীরা বলে বেড়াচ্ছেন এটা হুমায়ূন আহমেদের জীবনী নিয়ে তৈরি করা হয়েছে। একদিকে ছবিটি নিয়ে দর্শকের মধ্যে হুমায়ূন ক্রেজ তৈরি হয়ে গেলো, ফলে ব্যবসায়িক দিকটি মোটামুটি চাঙা হয়ে গেল। অন্যদিকে ছবির কাহিনীকে মৌলিক হিসেবে চালিয়ে দিয়ে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী হুমায়ূন আহমেদের পরিবারের অনুমতি না নিয়ে ছবি তৈরি করার যে দায়, তা মোটামুটি সহজভাবে এড়িয়ে গেলেন! বাংলাদেশের খ্যাতিমান একজন লেখককে নিয়ে সস্তা একটি বিজনেস পলিসি দাঁড়িয়ে গেল আর কী! হুমায়ূন আহমেদের জীবনীকে এভাবে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার না করলেই কি নয়? আমাদের তো অনেকগুলো হুমায়ূন নেই। একজন হুমায়ূন আহমেদের জীবনের গল্প নিয়ে ছবি হবে, অথচ সেটি স্বীকার করা হবে না, সেটা কি দেখতে ভালো লাগে?
এই যখন পরিস্থিতি, তখন অনেকের মধ্যেই প্রশ্ন জাগতে পারে, হুমায়ূন আহমেদের জীবনী নিয়ে ছবি বানানো কি কোনও অপরাধ? অবশ্যই না। হুমায়ূন আহমেদের যে বর্ণিল জীবন, তা নিয়ে ছবি বানানো তো যেকোনও পরিচালকের কাছেই খুব লোভনীয় বিষয়। তিনি একজন সেলিব্রেটি, তিনি কারও একার সম্পত্তি নয়। অতএব যে কেউই তার জীবনী নিয়ে ছবি বানাতে পারে। তবে, তার জীবনী নিয়ে ছবি বানানোর আগে যেকোনও পরিচালকেরই উচিত তার পরিবারের সঙ্গে গল্পগুলো মিলিয়ে নেওয়া, এতে করে কোনো ভুলভ্রান্তি থাকলে তা সহজেই এড়িয়ে যাওয়া যায়। এমন তো নয় যে, হুমায়ূন আহমেদের জীবনী নিয়ে কেউ ছবি বানাতে চেয়েছে আর তার পরিবারের পক্ষ থেকে আপত্তি করা হয়েছে। শাওনের বক্তব্য যতটুকু শুনেছি, এ ব্যাপারে তার সঙ্গে কোনও যোগাযোগই করা হয়নি। পত্রিকা পড়ে যতটুকু জানলাম, ছবিটি নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের পরিবারের অন্যদের সঙ্গেও কোনও যোগাযোগ করা হয়েছে বলে শুনিনি। তারা নাকি জানতেনই না ছবিটি সম্পর্কে। তাহলে এইভাবে একজন ব্যক্তির জীবনী নিয়ে সিনেমা বানানোর উদ্দেশ্য কী? পরিবারের পক্ষ থেকে খারাপ কিছুর ভয় পাওয়া কি একেবারেই অমূলক?
শুনেছি তসলিমা নাসরীনের জীবন নিয়েও ভারতে একটি ছবি বানানো হয়েছে। তসলিমা নাসরিন নিজেই স্বীকার করেছেন ছবিটির সঙ্গে তার জীবনের মাত্র ২০% মিল আছে। তারপরও তো ছবিটির পরিচালক তসলিমার সঙ্গে দেখা করে ছবিটি নিয়ে আলাপ করেছেন। হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে নেই, কিন্তু তার পরিবার, স্ত্রী-সন্তানরা তো বেঁচে আছে, তাদের সঙ্গে তো যোগাযোগ করা যেত। মৃত হুমায়ূন আহমেদকে সিনেমায় কিভাবে চিত্রায়িত করা হলো, তা নিয়ে খোঁজখবর নেওয়া তো অযৌক্তিক নয়।
এই ছবিটিকে নিয়ে অনেকে ফিকশন/ননফিকশন বা বাক স্বাধীনতা প্রসঙ্গসহ নানারকম যুক্তি-তর্ক জুড়ে দিয়েছেন। প্রতিটি মানুষেরই যেমন বাক স্বাধীনতা আছে, তেমনি প্রতিটি মানুষেরই নিজের মানহানির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর অধিকার আছে। অনেকে শাওনের হস্তক্ষেপকে অযাচিত বা অপ্রয়োজনীয় হিসেবেই দেখছেন। আমি তো মনে করি, বিষয়টি নিয়ে শাওনেরই সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হওয়া উচিত। কারণ, হুমায়ূন আহমেদের জীবনী নিয়ে কোনও চলচ্চিত্র নির্মিত হলে সেটিতে শুধু হুমায়ূন আহমেদের একার জীবন উঠে আসবে না। হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে জড়িত সবগুলো মানুষের চরিত্রই চিত্রায়িত হবে সেই সিনেমায়। আপনি পছন্দ করুন আর না করুন, প্রয়োজনীয় মনে করুন বা অপ্রয়োজনীয় মনে করুন, শাওনই কিন্তু আপনার প্রিয় লেখকের প্রিয়তমা স্ত্রী এবং মৃত্যুর শেষদিন পর্যন্ত শাওনই ছিলেন হুমায়ূন আহমেদের পাশে।
কাজেই লেখকের প্রিয়তমা স্ত্রীর হস্তক্ষেপকে অপ্রয়োজনীয় মনে করা আর লেখককে অসম্মান করা একই কথা। এছাড়া, একদিকে হুমায়ূন আহমেদের জীবনী, অন্যদিকে নিজের ভূমিকা সিনেমায় কিভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, তা দেখার শতভাগ অধিকার আছে শাওনের।
ও হ্যাঁ, ছবিটির মুক্তি সাময়িকভাবে বন্ধ করায় অনেকে বাক স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। আমি এ বিষয়টিকে বাক স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছি না। আজকে খ্যাতিমান একজন লেখকের জীবনী নিয়ে ছবি তৈরি করে মৌলিক গল্প হিসেবে চালিয়ে দেওয়াকে প্রশ্রয় দিলে, কাল হয়তো দেখবেন আপনার অথবা আমারই একটি উপন্যাসের গল্প নিয়ে ছবি বানিয়ে মৌলিক গল্প বলে চালিয়ে দেবেন যে কেউ। এতে পত্রিকার প্রচার-প্রচারণায় সিনেমা নিয়ে ব্যবসাটা ঠিকই হবে, মাঝখান থেকে অ্যাকনলেজ করার কালচারটাই উঠে যাবে। এই জাতীয় কাজে আমি ফিকশন/ননফিকশন বা বাক স্বাধীনতাকে টেনে আনি না, আমি একে গল্পচুরির সঙ্গে তুলনা করি।
লেখক: সাংবাদিক
rokeya.lita@hotmail.com