সাবমেরিন ডুবলে ভাসবে বাংলাদেশ

প্রভাষ আমিনবাংলাদেশে এখন সব কৌতূহলের কেন্দ্রে 'নবযাত্রা' ও 'জয়যাত্রা'। কারণ এমন ঘটনা বাংলাদেশে আগে কখনও ঘটেনি। বাংলাদেশের অনেক কিছুই ছিল। কিন্তু সাবমেরিন মানে ডুবোজাহাজ ছিল না। অবশেষে স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর বাংলাদেশের নৌবাহিনীতে যুক্ত হলো সাবমেরিন। জাতিসংঘের সদস্য ১৯৩টি দেশের মধ্যে এর আগে মাত্র ৪০টি দেশের সাবমেরিন ছিল, এই তালিকায় ৪১ নম্বর দেশের নাম বাংলাদেশ। যে যাই বলুন না কেন, স্বাধীনতার মাসে এই অর্জন আমাকে গর্বিত করেছে। আমার মধ্যে দারুণ ভালো লাগার একটা অনুভূতি কাজ করছে। আমি হয়তো কোনোদিন সামনাসামনি সাবমেরিন দেখবো না। তবু কেন জানি মনে হচ্ছে, এ সাবমেরিন আমার, এ অর্জন আমাদের সবার। নয়মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হয়েছে। ১৬ ডিসেম্বর এক লড়াই শেষ হয়েছে, তারপরই শুরু হয়েছে দেশ গড়ার নতুন সংগ্রাম। এ সংগ্রাম উন্নয়নের, দারিদ্র বিমোচনের, সক্ষমতা অর্জনের। আর এই অর্জনের পথে সাবমেরিন একটি বড় পদক্ষেপ।
সমরাস্ত্রের ধরন দুটি আক্রমণাত্মক ও রক্ষণাত্মক। টর্পেডো ও মাইনসমৃদ্ধ সাবমেরিন দুটি আক্রমণাত্মক। কিন্তু আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, এ দুটি সাবমেরিন বাংলাদেশের কখনোই কোনও কাজে লাগবে না। কোনও টর্পেডো বা মাইন ছোঁড়া হবে না। তাহলে দেড় হাজার কোটিরও বেশি টাকা ব্যয় করে কেনা সাবমেরিন দুটি আমাকে এত গর্বিত করছে কেন? বাংলাদেশের এমন আরও অনেক কিছু আছে, যা কখনও ব্যবহৃত হয়নি, হয়তো হবেও না। বর্তমানে যা বাস্তবতা, তাতে বাংলাদেশকে হয়তো আর কখনোই কোনও যুদ্ধ করতে হবে না। কিন্তু তাই বলে কি আমরা সামরিক শক্তি কমিয়ে ফেলবো? আমি আক্রান্ত হবো না বা আক্রমণ করবো না, এটা এক কথা। কিন্তু আমার আক্রমণ করার বা আক্রান্ত হলে প্রতিরোধের সক্ষমতাই নেই, এটা আরেক কথা। প্রয়োজনে আক্রমণ করার বা আক্রান্ত হলে তার জবাব দেওয়ার সক্ষমতা আমাদের থাকতে হবে। তাহলে আমরা বুক ফুলিয়ে চলতে পারবো। নইলে সবাই আমাদের অবহেলা করবে, উপেক্ষা করবে। বাংলাদেশের অবস্থান আসলে ভারতের পেটের ভেতরে। সামরিক শক্তিতে ভারত বাংলাদেশের চেয়ে অনেক অনেক এগিয়ে। বাস্তবতা হলো, আমরা কখনোই সামরিক শক্তিতে ভারতের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবো না। ভারত আমাদের বন্ধু এবং তিন দিক থেকে ঘিরে রেখেছে। ভারত আজ আমাদের বন্ধু, চিরদিন বন্ধু থাকবেই, এমন কোনও কথা নেই। তবে একটা কথা সবাইকে মাথায় রাখতে হবে, বন্ধু বদলানো যায়, কিন্তু প্রতিবেশী বদলানো যায় না। তাই আমরা ধরে নিচ্ছি, ভারতের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কই থাকবে। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, সব বন্ধুই একরকম নয়। ধরুন আপনার ছেলেবেলার দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু, যাদের সঙ্গে আপনার বন্ধুত্ব আছে এবং থাকবে। তাদের একজন হলো পুলিশের আইজি, আরেকজন হলো প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। সেই দুই বন্ধুর সঙ্গে আপনার আচরণ কি একইরকম হবে? আপনি যতই নির্মোহ হন, দুই বন্ধুর প্রতি আচরণ একইরকম হবে না। এটাই বাস্তবতা। আইজি বন্ধু আপনার যতটা সমীহ পাবে, শিক্ষক বন্ধু ততটা পাবে না। তাই বন্ধুর কাছ থেকে সমীহ আদায় করতে হলেও আপনার চাই শক্তি, চাই সক্ষমতা। আপনার কাছে একটি লাইসেন্স করা অস্ত্র আছে। তার মানে তো এই নয়, আপনি প্রতিদিন সেই অস্ত্র নিয়ে বেরুবেন এবং বন্ধু-শত্রু যাকে পান, তাকেই অস্ত্রটি দেখিয়ে বেড়াবেন বা ইচ্ছামত গুলি করবেন। এমন হতে পারে, আপনি কোনোদিনই সেই অস্ত্রটি ব্যবহার করবেন না বা হতে পারে কোনোদিন বেরও করতে হলো না। আপনার অস্ত্রটি কিন্তু সমাজে আপনার অবস্থান বদলে দেবে। আর সুযোগ থাকলে কি আপনি আপনাকে সক্ষম করে তুলবেন না? ঠিক এ কারণেই সাবমেরিন আপনার দরকার।
সাবমেরিন কেনা হতে না হতেই কিন্তু বাংলাদেশের প্রতি ভারতের মনোভাব বদলে গেছে। ভারতের বিভিন্ন মহলে তুমুল আলোচনা। সবাই বাংলাদেশকে অন্য চোখে দেখতে শুরু করেছে। সেই দৃষ্টিতে আছে কিছু সন্দেহ-সংশয়ও। বিশেষ করে গতবছর চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং-এর সফরের পর বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক নতুন মাত্রা পায়। এর পর থেকেই বাংলাদেশকে ভারত একটু সন্দেহের চোখে দেখা শুরু করেছে। আর সাবমেরিন দুটি চীন থেকে কেনা। তাতেই ভারতের সন্দেহ-সংশয় বেড়ে গেছে। ভারত মনে করছে, সাবমেরিন দুটির প্রশিক্ষণ এবং অন্যান্য কাজে বঙ্গোপসাগরে চীনের উপস্থিতি থাকবে। আর চীনের উপস্থিতিটাই ভারতের জন্য অস্বস্তিকর। ভারতের ভাবনা যতটা বাংলাদেশকে নিয়ে তারচেয়ে বেশি চীনকে নিয়ে। আঞ্চলিক রাজনীতিতে চীন ভারতের প্রতিপক্ষ, বাংলাদেশ নয়। তাই চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কোন্নয়ন ভাবাচ্ছে ভারতকে। এই অবস্থাটা আমার ভালো লাগছে। আশা করি, সাবমেরিন সূত্রে পাওয়া এই বাড়তি শক্তি কূটনীতির টেবিলে বাংলাদেশকে বাড়তি স্কোর দেবে।

আমি বরাবরই বলে আসছি, একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারত আমাদের সহায়তা করেছে, যার জন্য আমরা চিরকৃতজ্ঞ। কিন্তু কৃতজ্ঞতার মানে এই নয় যে ভারতকে আমরা নিঃশর্তে সব দিয়ে দেবো। ভারত আমাদের নিকট প্রতিবেশী, বড় প্রতিবেশী। তারা যদি আমাদের ‘এলডার ব্রাদার’ হন তাহলে আমরা আছি, কিন্তু ‘বিগ ব্রাদার’ হলে নাই। ভারতকে সবসময় মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। আর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিছক একতরফা নয়। স্বার্থ যতটা বাংলাদেশের, ততটাই ভারতের। বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক না থাকলে, ভারতও শান্তিতে থাকতে পারবে না। আগের সরকারগুলোর সময়ে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করেছে অবাধে। বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করে ভারতে ব্যবহারের জন্য ১০ ট্রাক অস্ত্র আনা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশের ভূমিকে কারো জন্য ব্যবহৃত হতে দেয়নি। ভারত নিশ্চয়ই তার সুফল পেয়েছে। তাদের অবশ্যই আমাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কিন্তু সীমান্তে ভারতের বিএসএফ পাখির মতো গুলি করে বাংলাদেশিদের হত্যা করে, তিস্তার পানি বণ্টনের ইস্যুটি অনেকদিন ধরেই মূলার মতো ঝুলিয়ে রেখেছে ভারত। আগামী মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত যাচ্ছেন। আশা করি ভারত শেখ হাসিনার প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতার প্রকাশ ঘটাবে।

আরেকটা বিষয়, চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বের উষ্ণতা এবং সাবমেরিন আমাদের যে সক্ষমতার নতুন মাত্রা দিয়েছে, তা ব্যবহার করতে যেন আমরা কৌশলী হই। ভারত এবং চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্যটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি আমাদের ডিপ্লোম্যাটরা বিষয়টি মাথায় রাখবেন।

বলছিলাম সাবমেরিনের কথা। অনেকেই বলছেন, বাংলাদেশের মতো গরিব দেশের জন্য সাবমেরিন নিছক বিলাসিতা। কিন্তু বাস্তবতাটা হলো, গত একদশকে দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশে নাটকীয় সাফল্য পেয়েছে। গতবছর বিশ্বব্যাংক প্রধান বাংলাদেশে এসে এ সাফল্যের স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন। এই সাফল্যের পরও বাংলাদেশের ২২ ভাগ মানুষ এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। দারিদ্র্য বিমোচনের ধারায় নিশ্চয়ই এ অবস্থারও উন্নতি হবে। কিন্তু ২২ ভাগ মানুষ গরিব বলে সাবমেরিন কেনা যাবে না, এ যুক্তির সঙ্গে আমি একমত হতে পারছি না। সক্ষমতা বাড়ানো দারিদ্র্য বিমোচন ধারাকেই শক্তিশালী করবে। আর ব্যাপারটা এমন নয় যে, যে টাকা দিয়ে আমরা সাবমেরিন কিনেছি, সে টাকা দিয়ে দারিদ্র্য বিমোচন করা যেতো। বরং ব্যাংকিং খাতে লুটপাট বন্ধ করা গেলে চোখ বন্ধ করে এমন আরো কয়েকটি সাবমেরিন কিনে ফেলা যেতো। সাবমেরিন কেনার পাশাপাশি, আমাদের সবক্ষেত্রে, বিশেষ করে আর্থিক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।

আন্তর্জাতিক আদালতের মামলার রায়ে বাংলাদেশ মিয়ানমারের কাছ থেকে ১লাখ ১১ হাজার ৬৩১ বর্গ কিলোমিটার সমুদ্র এলাকা এবং ভারতের কাছ থেকে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গ কিলোমিটার সমুদ্র এলাকার ওপর কর্তৃত্ব অর্জন করেছে। এখন সমূদ্রে পড়ে থাকা আরেক বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। বাংলাদেশ গরিব দেশ, মানুষ বেশি। তাই আমাদের জলে-স্থলে প্রতিটি ইঞ্চি সম্পদ কাজে লাগাতে হবে। সমুদ্রসীমা জয়ের পর ব্লু ইকোনমি নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। সেই ব্লু ইকোনমির সুবিধা আদায় করতে সমুদ্রে আমাদের কর্তৃত্বটা নিশ্চিত করতে হবে। দুটি সাবমেরিন বিশাল সমুদ্রে আমাদের অবস্থান শক্ত করবে, নৌবাহিনীর মনোবলকে করবে বিশালতর।

রক্ষণাত্মক অস্ত্র না কিনে বাংলাদেশ কেন আক্রমণাক অস্ত্র কিনলো, এই প্রশ্নও এসেছে। কারণ বাংলাদেশ গত এক দশকে বদলে গেছে পুরোটাই। আগের সেই বিদেশ নির্ভরতা নেই। সামাজিক সব সূচকে দারুণ উন্নতি করেছে। ঊর্ধ্বগামী অর্থনীতির সূচকগুলোও। বদলটা হচ্ছিল ধীরে ধীরে। নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণ শুরুর পর বদলে যাওয়া বাংলাদেশ দৃশ্যমান হয়েছে। এই বাংলাদেশ আর সেই বাংলাদেশ নেই। বাংলাদেশ এখন শুধু সামনে এগিয়ে যাবে। নিন্দুকেরা বলছেন, চীন থেকে আনা পুরোনো সাবমেরিন কোনও কাজে লাগবে না।

এমনকি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল এই সাবমেরিন ডুববে কিনা তা নিযে সংশয় প্রকাশ করেছেন। নিশ্চয়ই নিন্দুকদের মুখে ছাই দিয়ে নবযাত্রা ও জয়যাত্রা ডুববেই। আর সাবমেরিন ডুবলে ভাসবে বাংলাদেশ।

লেখক: বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ

probhash2000@gmail.com