X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু…

প্রভাষ আমিন
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২২:০৯আপডেট : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২২:০৯

ঢাকা বা বাংলাদেশের যেকোনও অর্জন আমাদের গর্বিত করে। যখন শুনি বাংলাদেশের কোনও খেলোয়াড় সেরা হয়েছে; ফসল উৎপাদনে, মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ দারুণ উন্নতি করেছে; গর্বে আমাদের বুক ফুলে যায়। কিন্তু ইদানীং একটি সূচকে ঢাকা প্রায়ই শীর্ষে উঠে যায়, যা আমাদের গর্বিত তো করেই না, শঙ্কিত করে, লজ্জিত করে। বায়ুদূষণের তালিকায় ঢাকা প্রায়ই বিশ্বের এক নম্বর স্থান দখল করে। অথচ ঢাকা সৃষ্টিকর্তার এক আশীর্বাদের শহর। চারপাশে চারটি মিঠা পানির নদী আছে, এমন শহর বিশ্বেই বিরল। ঢাকায় একসময় জালের মতো বিস্তৃত খাল ছিল। খাল ভরাট করেছি অনেক আগেই। এখন দখলে-দূষণে নদীগুলোকে গিলে ফেলতে চাই।

বায়ুদূষণের সরাসরি প্রভাব পড়ে ফুসফুসে। শুধু ফুসফুস নয়, বায়ুদূষণের কারণে লিভার, হার্ট, কিডনিও আক্রান্ত হতে পারে। পরিসংখ্যান আর চিকিৎসকদের পরামর্শ শুনলে আতঙ্কেই শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়। বায়ুদূষণ যেমন বাড়ছে, তেমনি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রোগীর সংখ্যাও। ঢাকার বক্ষব্যাধি হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা দুই থেকে তিনগুণ বেড়েছে। বায়ুদূষণে বেশি ঝুঁকির শিকার গর্ভবতী মা ও শিশুরা। এমনকি গর্ভবতী নারী বায়ুদূষণে আক্রান্ত হলে তার শিশু অটিজমে আক্রান্ত হতে পারে। তার মানে শিশুদের ভবিষ্যৎ তো আমরা নষ্ট করছিই, এমনকি জন্মের আগেই একটি শিশু আমাদের অবিমৃষ্যকারিতার শিকার হতে পারে। এই শিশুরা কোনোদিনই আমাদের ক্ষমা করবে না।

কিছু কিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগ আছে, যেখানে আমরা অসহায়, কিছুই করার থাকে না। যেমন- ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, অতিরিক্ত শীত, গরম অথবা বৃষ্টি। এই দুর্যোগগুলোও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণেই বাড়ছে। তবে বায়ুদূষণ সরাসরি আমাদের সৃষ্ট। আমরা চাইলেই এই বিপর্যয় রোধ করতে পারি, কিন্তু করছি না। মানুষের মতো এমন আত্মহননপ্রবণ প্রজাতি আর নেই। বলা হয়, বোকারা যে ডালেই বসে, সে ডাল কেটে ফেলে। কিন্তু আমরা জেনেশুনেই নিজেদের শ্বাসরোধ করছি। আমরা কি বোকা, নাকি অতি চালাক, নাকি সর্বগ্রাসী লোভ আমাদের বিবেচনাবোধও কেড়ে নিয়েছে?

গবেষণা বলছে, ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য ৫০ ভাগ দায়ী ইটভাটা। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও গৃহস্থালি বর্জ্যের দায় ৩০ ভাগ, গাড়ির ধোঁয়ায় দূষিত হয় ১০ ভাগ, শিল্প-কারখানার বর্জ্যে হয় বাকি ১০ ভাগ।

ঢাকার চারপাশে হাজারের বেশি মান্ধাতা আমলের প্রযুক্তির ইটের ভাটা। বলা ভালো, সারি সারি ইটভাটা ঢাকাকে ঘেরাও করে রেখেছে। বিশাল চিমনি থেকে টনকে টন ধোঁয়া ছাড়ে এসব ইটভাটা। সেই ধোঁয়া ঢাকাকে গ্যাস চেম্বারে বদলে দেয়।  ঢাকার চারপাশের ইটভাটা বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশনা আছে। কিন্তু তা কেয়ার করা হয় বলে মনে হয় না। এই ইটভাটা পরিবেশের বহুমুখী ক্ষতি করে। ধোঁয়া ছেড়ে সরাসরি বাতাসকে ক্ষতি করার বিষয় তো আছেই, ইটভাটায় জ্বালানি সরবরাহের জন্য উজাড় হয় গাছ। আর ইট পোড়াতে যে মাটির জোগাড় হয়, তাতে শেষ হয়ে যায় মাটির উর্বরতা শক্তি। অল্প টাকার লোভে কৃষক বিক্রি করে দেয় তাঁর টপ সয়েল। নির্মাণকাজের জন্য এখন অনেক বিকল্প বেরিয়েছে। ইটেরও অনেক বিকল্প আছে। তাছাড়া ইট বানাতেও প্রচলিত ভাটার বিকল্প পদ্ধতি আবিষ্কার হয়েছে অনেক আগেই। চাইলেই প্রায় ধোঁয়া ছাড়াই ইট পোড়ানো সম্ভব। তাই সরকার চাইলে এ মুহূর্তে পুরোনো প্রযুক্তির ইটভাটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে দিতে পারে। এতে নির্মাণ খরচও বাড়বে না। আর এটি করতে পারলে ঢাকার বায়ু পরিস্থিতি ৫০ ভাগ ভালো হয়ে যাবে। এটি খুবই সহজ। শুধু দু-তিন মাস সময় দিয়ে ইটভাটা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিলেই হলো। এ সিদ্ধান্ত শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশেই বাস্তবায়ন সম্ভব। আর ইটভাটা তো গোপনে করা সম্ভব নয়। অনেক দূর থেকেও ইটভাটার চিমনি দেখা যায়। পরিবেশের তোয়াক্কা না করে, হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে দিনের পর দিন ইটভাটা চলছে, আমাদের মৃত্যু ত্বরান্বিত করছে, আমরা তাদের কিছুই বলছি না। কেন?

ঢাকার বায়ুদূষণের আরেকটি প্রধান কারণ গাড়ির কালো ধোঁয়া। এটিও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তিন চাকার টু স্ট্রোক ইঞ্জিনের গাড়ি নিষিদ্ধ করে ফোর স্ট্রোক ইঞ্জিন চালুর পর নাটকীয়ভাবে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছিল। এখন আলাদা কিছু করতে হবে না। শুধু বিদ্যমান আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করলেই গাড়ির কালো ধোঁয়া অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। যেসব গাড়ি কালো ধোঁয়া ছাড়ে, সেগুলো তো ফিটনেস পাওয়ার কথা না। বিআরটিএ গাড়ির ফিটনেস দেওয়ার ব্যাপারে কঠোর এবং সৎ হলেই কালো ধোঁয়ার দূষণ প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব। কেন করছি না?

দূষণের আরেকটি বড় কারণ রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও উন্নয়ন। ঢাকায় এখন নানামুখী উন্নয়ন কাজ হচ্ছে। স্থানীয় উন্নয়ন, নির্মাণকাজ তো আছেই, আছে মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বিআরটির মতো বড় প্রকল্পের কাজ। আমি বলছি না, বায়ুদূষণ ঠেকাতে উন্নয়নকাজ বন্ধ করে দিতে হবে। মাথা কেটে ফেলা কখনোই মাথাব্যথার সমাধান নয়। তবে সঠিক নিয়ম মেনে চললে বাতাস ঠিক রেখেই উন্নয়ন সম্ভব। মেগা প্রকল্পে হাজার কোটি টাকা খরচ করা গেলে ধুলা বন্ধে আর অল্প কিছু টাকা খরচ করলেই হয়। সেটা কেন করছি না?

নিত্যদিনের রাস্তা খোঁড়ার কাজটা দক্ষতার সঙ্গে দ্রুতগতিতে করা সম্ভব। কিন্তু আমরা একবার রাস্তা খুঁড়লে তা মেরামত করার বিষয়টি ভুলেই যাই। আমাদের বাড়িঘরের নির্মাণসামগ্রী ফুটপাতে খোলা আকাশের নিচে ফেলে রাখি। একটু ঢেকে রাখলেই বাতাস দূষিত হবে না। গৃহস্থালি বর্জ্য এবং শিল্পবর্জ্যও ঠিক নিয়ম মেনে অপসারণ করা গেলে দূষণ কমিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু সেই সম্ভব কাজটাই আমরা করি না।

তার মানে আমরা চাইলেই ঢাকার বায়ুর মান উন্নত করতে পারি। বায়ুদূষণের সঙ্গে প্রকৃতির কোনও দায় নেই। বরং আমরা অপেক্ষা করি, বর্ষাকাল এলে বাতাস কিছুটা ভালো হবে। কিন্তু সারা বছর বাতাস ভালো রাখার দায়িত্ব আমাদেরই। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা ভালো বাতাসে ফুসফুস ভরে নিশ্বাস নেবো, নাকি সবার শ্বাসরোধ করে তিলে তিলে মারবো। আমার ধারণা, আমাদের হাতে হলেও এটি কখনোই হবে না। কারণ, যাদের সিদ্ধান্তে ঢাকার বাতাস ভালো হতে পারবে, তাদের এসব নিয়ে ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। কারণ তাদের অফিস, বাসা, গাড়ি পুরোটাই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। তাঁদের কখনোই ঢাকার দূষিত বাতাসে শ্বাস নিতে হয় না। হলে নিশ্চয়ই তারা ভাবতেন। তবু তাদের সুমতির দিকে আশা নিয়ে বসে থাকতে হবে অসহায় আমাদের। যদি শ্বাসকষ্টে মরে যাই, তাহলেও অভিশাপ দিয়ে যাবো—যারা ইটের ভাটা করে, রাস্তা খুঁড়ে, কালো ধোঁয়া ছেড়ে আমাদের বেঁচে থাকাটাই কষ্টকর করেছিল; যাদের কারণে বেঁচে থাকার মতো আমাদের মৃত্যুটাও যন্ত্রণাদায়ক হয়েছে; তারাও যেন এই দুর্ভোগের শিকার হন। তাহলেই তারা বুঝবেন, বুক ভরে শ্বাস নেওয়াটা কত আনন্দের, ঢাকার বাতাস ভালো করাটা কত গুরুত্বপূর্ণ। রবি ঠাকুরের কবিতা দিয়েই লেখাটি শেষ করি- ‘যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো/ তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?’ যারা আমাদের বায়ু বিষাক্ত করছে, তাদের আমরা কখনোই ক্ষমা করবো না, ভালোবাসা তো অনেক পরের কথা।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মেসির জোড়া গোলে মায়ামির আরেকটি জয় 
মেসির জোড়া গোলে মায়ামির আরেকটি জয় 
কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার ৫ ইউনিয়নে চলছে ভোট গ্রহণ
কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার ৫ ইউনিয়নে চলছে ভোট গ্রহণ
যাদের স্যালাইনে বাঁচে প্রাণ, তাদের মজুরি বাড়ে না
১৬ শ্রমিকের উৎপাদিত স্যালাইন দিয়ে চলছে ৯ জেলার হাসপাতালযাদের স্যালাইনে বাঁচে প্রাণ, তাদের মজুরি বাড়ে না
সিলেটে ট্রাকের ধাক্কায় ৩ মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
সিলেটে ট্রাকের ধাক্কায় ৩ মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ