আমি আগেই লিখেছিলাম যে, তারা যাদের এক সময় ‘দাস’ ভাবতো সেই বাংলাদেশিরা ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিতব্য সার্ক সম্মেলনে অংশগ্রহণে রাজি না হওয়া পাকিস্তানি শাসক বা দেশটির সামরিক শক্তি ক্ষুব্ধ ছিল। এরপর সার্ক সম্মেলনটি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে যায়। এর জবাবে ঢাকায় অনুষ্ঠিত আইপিইউ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে পাকিস্তান। কিন্তু সম্মেলনটির আয়োজন বন্ধ করতে পারেনি।
মীর বলেছেন, ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্কে সহযোগিতার জন্য তিনি সম্মাননা গ্রহণ করতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তা আরও খারাপের দিকে মোড় নিচ্ছে। এবং তিনি এখন বুঝতে পেরেছেন যে, এটা ছিল একটি ধোঁকা। ফলে তিনি এই সম্মাননা ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
কিছু ঘটনার কথা স্মরণ করি এবং ভেবে দেখি নিজেকে কিভাবে পাকিস্তানের শাসকদের কাছে নায়ক হিসেবে উপস্থাপন করতে বিশ্বকে ধোঁকা দিয়েছেন।
তিনি উল্লেখ করেননি, বাংলাদেশ যখন ১৯৭১ সালের কোনও যুদ্ধাপরাধীকে ফাঁসি দিয়েছে তখন পাকিস্তানের ভূমিকা, বাংলাদেশে ইসলামি জঙ্গিবাদে পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগে পাকিস্তানের কূটনীতিক গ্রেফতার, জবাবে ভুয়া অভিযোগ তুলে ইসলামাবাদে বাংলাদেশি কূটনীতিককে বহিষ্কার এবং সরকারবিরোধী বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে কূটনৈতিকবিরোধী সখ্যতার মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলানোর কথা।
যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দেওয়ায় বাংলাদেশকে খাটো করতে পাকিস্তান চেষ্টা করেছিল মানবাধিকার রক্ষার নামে কমনওয়েলথ যেন ঢাকার নিন্দা করে। আরও কয়েকটি ইস্যুতে আন্তর্জাতিকভাবে এমন পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করে পাকিস্তান।
এক সময় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য পাকিস্তান সরকারকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানানো মীর এখন ভুলে গেছেন যে পাকিস্তান ক্ষমা চেয়েছে দুঃখপ্রকাশ করেনি, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগের সময়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ভিন্নরূপে হাজির হতে পারত।
১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘাতকদের আশ্রয় দেওয়ার পর পাকিস্তানের জন্য এটাই স্বাভাবিক। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাংলাদেশে তাদের স্বার্থরক্ষাকারী শাসকগোষ্ঠীকেই ক্ষমতায় পেয়েছে। যারা তাদের ভারত বিরোধিতায় উন্মুক্ত নতুন ক্ষেত্র তৈরি করে।
আমরা ভুলে যেতে পারি না পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তার মৃত্যুতে বিএনপির খালেদা জিয়া যেভাবে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে শোক জানিয়েছেন। যা ছিল আমাদের অনেক হতবাক ও লজ্জিত করেছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা চালানো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একজন ছিলেন এই নিহত সেনা কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ-ভারতের ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক দেখে বাংলাদেশে নিজেদের অবস্থান হারাতে দেখে আতঙ্কিত পাকিস্তান। একই সঙ্গে তারা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কিছু ক্ষেত্রে এক ঘরে হয়ে পড়ছে। ফলে তারা শেখ হাসিনাকে আক্রমণ শুরু করেছে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে যেদিন নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তান হামলা চালিয়েছিল সেই ২৫ মার্চকে জাতীয় গণহত্যা দিবস ঘোষণা করায় বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে সামনে এসেছে। বিএনপি-জামায়াত কখনও এটা করতো না। কিন্তু শেখ হাসিনা করেছেন এবং করে চলেছেন। কারণ তিনি দেশের জাতির জনকের কন্যা এবং দেশের মানুষের নেতা।
শেখ হাসিনা দেশের মানুষের কথা শুনেন। কিন্তু পাকিস্তানি নেতারা তাদের জনগণের কথা শুনেন না। পাকিস্তানের জনগণ বাংলাদেশের সঙ্গে উষ্ণ ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক চান। শুরুতে তারা ক্ষমা চান এবং আমার বাবার মতো মুক্তিযোদ্ধাদের ‘গাদ্দার’ (বিশ্বাসঘাতক) বলা থেকে বিরত থাকেন।
এখন হামিদ মীরের উচিত নিজের মহান পিতা প্রয়াত ওয়ারিসকে জিজ্ঞেস করা, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের অন্যায়ের পরও তার এখন সম্মাননা ফিরিয়ে উচিত কিনা।
সব শেষে কিন্তু একমাত্র নয়, এই সম্মাননা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ব্যক্তিগতভাবে যারা ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের প্রতি শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতার নিদর্শন। রাজনীতির সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই। দুঃখজনক হলো, শেখ হাসিনার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছেন এবং তাকে খাটো করতে ভুল বিষয় নির্বাচন করেছেন। দয়া করে নিজের সুমতিতে ফিরে আসুন, পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন দল ও সেনাবাহিনী দ্বারা ব্যবহৃত হবেন না।
লেখক: সাংবাদিকতায় জাতিসংঘের ড্যাগ হ্যামারসোল্ড স্কলার এবং লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রেস মিনিস্টার