নতুন একটি দৃশ্য দেখছি আজকাল। জল-স্থল-অন্তরীক্ষ পথে ইউরোপ- আমেরিকায় ঢুকে বাংলাদেশের ক, খ, গ সকলে নিজেকে ব্লগার বলে পরিচয় দিচ্ছে। ব্লগারদের এখন পোয়াবারো। কেউ ব্লগার– এই খবর শুনলে সাহায্য করার জন্য তড়িঘড়ি ছুটে আসে নানা রকম সংগঠন। ফেসবুকে লেখে না, বা ছবি পাঠায় না, এমন লোকের সংখ্যা পৃথিবীতে কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশের যারা ফেসবুকে লেখে তাদের অনেকে ইদানিং ব্লগার হিসেবে নিজেদের দাবি করে। বিদেশের লোকেরা তো এখন বাংলাদেশের ব্লগার মানেই অচিরে খুন হতে যাচ্ছে এমন এক সম্প্রদায়কেই মনে করে। অনন্ত বিজয় দাস ইসলামি সন্ত্রাসিদের হুমকি পাওয়ার পর সুইডেনের ভিসা চেয়েছিলেন, তাকে ভিসা দেয়নি সুইডেন। তারপর তো আমরা সবাই দেখলাম কী করে অনন্তকে নৃশংসভাবে হত্যা করলো ইসলামি সন্ত্রাসীরা। এই ঘটনার পর, সুইডেন, বিশেষ করে বাংলাদেশের সুইডিশ দূতাবাস ভীষণভাবে অনুতপ্ত। প্রচুর ব্লগার- ফেসবুকারদের সুইডেনের ভিসা দিয়ে ভুলের প্রায়শ্চিত্য করেছে।
বাংলাদেশের নাস্তিক ব্লগারদের যখন কোপানো শুরু হলো, আমি ইউরোপীয় সংসদে এবং ইউরোপ আমেরিকার বড় মঞ্চগুলোয় ব্লগারদের জীবন বাঁচানোর জন্য মাসের পর মাস অনুরোধ করেছি। এ নিয়ে আমেরিকার ফ্রিথট ব্লগে লিখেছিও প্রচুর। বিদেশের রেডিও টেলভিশনে বলেছি মানুষ যেন বাংলাদেশের ব্লগারদের জীবন বাঁচাতে সাহায্য করে। আমি ক্ষুদ্র মানুষ হলেও আমার মূহুর্মূহু অনুরোধে বেশ কিছু সংগঠন উদ্যোগ নিয়েছে ব্লগারদের সাহায্য করতে। এখন প্রশ্ন হলো, কারা নিরাপদ এবং কারা নিরাপদ নয় বাংলাদেশে। কেউ কি সঠিক করে বলতে পারে, কে খুন হবে নেক্সট? কেউ পারে না, পারে না বলেই বলে ফেলা যায় সবারই নিরাপত্তার অভাব।অভিজিতের মতো বইয়ের লেখকও যেমন খুন হয়ে যেতে পারেন, কোনও বই না লিখেও নাজিমুদ্দিন সামাদও খুন হতে পারেন। সন্ত্রাসীদের চাপাতি এখন কার ঘাড়ের ওপর পড়বে কেউ জানে না। সুতরাং দেশ ছাড়ো, প্রাণ বাঁচাও। এই অবস্থায় কিন্তু এখন ইউরোপ আমেরিকায় বাংলাদেশের ব্লগার হিসেবে সুযোগ সুবিধে ভোগ করছে দু লাইন বাংলা শুদ্ধ করে লিখতে না জানা অনেকে। সকলে যে নাস্তিক বা সেক্যুলার, তাও নয়। এরাই এখন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী। নতুন প্রজন্মের প্রতিভাবান মুক্তচিন্তক যারা আছেন, তারা ভিন্ন পরিবেশে, ভিন্ন ভাষায়, ভিন্ন আবহাওয়ায় বাস করে কতটুকু সংগ্রামী থেকে যাবেন, দেশের পরিবর্তনের জন্য কতটা জরুরি হবে তাদের ভূমিকা, প্রশ্ন জাগে।
পঁচিশ বছরের নির্বাসিত জীবনে ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকায় নারীর মুক্তির জন্য নিরলস লেখালেখির জন্য বহুবার সম্মানিত হলেও আমি দেশে ফেরার জন্য অস্থির ছিলাম, এখনও অস্থির। কিন্তু দেশের সব সরকারই প্রাচীর তুলে রেখেছে আমার সামনে। আমার অনুমতি নেই দেশে প্রবেশের। নব্বই দশকের শুরুতে সারা বাংলাদেশের মৌলবাদিরা উন্মাদ হয়ে উঠেছিল আমাকে ফাঁসি দেওয়ার জন্য। আমার মাথার দাম ঘোষণা করা হয়েছে বহুবার। বাংলাদেশে, ভারতেও। তারপরও ইউরোপ- আমেরিকা ছেড়ে আমি আমার দেশে না হোক, আমার উপমহাদেশেই বাস করছি। ভারত আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে একবার, মনের জোরে ঢুকেছি বটে, পিঠের কাছে আততায়ীদের পায়ের শব্দ শুনি। আমাকে তাড়িয়ে দেওয়ার পায়তারা কিন্তু এখনও করছে ভারত। এত কিছুর পরও দেশের কাছাকাছি থাকার প্রবল ইচ্ছে আমার। আমি দালাই লামা নই। কাউকে খুশি করে কথা বলি না। আমার পায়ের নিচের মাটি যে কোনোদিন সরে যাবে জেনেও আমি অনড় দাঁড়িয়ে আছি। ঝুঁকি নিয়েও আছি। বেশ কিছু ব্লগার প্রতিবেশি দেশগুলোয় ছিল, ওদের বলেছি থেকে যেতে। কিন্তু কেউ থাকতে চায় না। সকলের লক্ষ্য ধনী দেশ। সকলেই ছুটে যায় ধনী দেশে। ধনী দেশের আরাম আয়েশ স্বস্তি স্বাচ্ছন্দ্য গরিব দেশ থেকে আসা প্রতিভাবানদের অনেক সময় মাথামোটা বানিয়ে ফেলে, আবার আকাট মূর্খদের কখনও কখনও বুদ্ধিজীবী বানিয়ে ফেলে।
কে প্রতিভাবান, কে নয় তা বিচার করার সরকারি দায়িত্ব আমার নয়। তবু আগ বাড়িয়ে আমি মত প্রকাশ করি। এ আমার চিরকালের স্বভাব। আমি জাতীয়তাবাদী নই, কিন্তু দেশের প্রতিভা বিদেশে পাচার হলে দুঃখ পাই। শুধু খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জন্য প্রতিভা বিসর্জন দিতে হলে প্রাণে সয় না। আমার আলোকিত বোনটির কথাই ধরি। প্রতিভা ছিল অনেক। আমেরিকার মাটিতে এখন দিন আনে দিন খায়, প্রতিভার ছুট্টি হয়ে গেছে। আমার নিজের কোথাও ঘর হয়নি, বাড়ি হয়নি। অনাথের মতো এদিকে ওদিকে মাথা গুঁজে শুধু লিখে গেছি। কখনও সহজ ছিল না এ কাজ। বাঙালি লেখকেরা বিদেশের মাটিতে বসে বাংলায় লেখালেখি করে যাবেন জীবনভর, এ কথা বলা সহজ, করা নয়। আমি জাতীয়তাবাদী নই, সৌদি আরবের বা সিরিয়ার লেখকদের যদি বাঁচার জন্য ইউরোপ-আমেরিকায় গিয়ে অলেখক হয়ে যেতে হয়, আমার একই রকম দুঃখ হয়।
লেখক: কলামিস্ট