শ্যামল কান্তি সিনড্রোম এবং রাষ্ট্রের ক্ষয়রোগ

শুভ কিবরিয়াএখন এটা আর অজানা নয় ক্ষমতাবানরা শ্যামল কান্তির মতো অবলা শিক্ষককে জেলখানার চারশিকের মধ্যে ঢুকিয়েই ছেড়েছে। কী অপরাধ শ্যামল কান্তির? মামলা বলছে তিনি ঘুষ খেয়ে কাজ করেননি। দুর্নীতি করেছেন। পুলিশ সেই মামলার তদন্ত করেছে। তারই ভিত্তিতে নিম্ন আদালত শ্যামল কান্তি ভক্তের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। শ্যামল কান্তি ভক্ত ‘অবলা শিক্ষক’। তাই আদালতের প্রতি সম্মান দেখিয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইলে আদালত জামিন মঞ্জুর না করে তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। পুলিশ তাকে কারগারে পাঠিয়ে দেয়।


এখানে কতগুলো বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে:-
এক. শ্যামল কান্তি যদি বিত্তশালী হতেন তবে বড় উকিলের পেছনে পয়সা খরচ করে উচ্চআদালত থেকে হয়তো জামিন নিতে পারতেন। এরকম জামিনের খবর আমরা হরহামেশা দেখি।
দুই. নারায়ণগঞ্জের জেষ্ঠ্য বিচারিক হাকিমের আদালত কি আরেকটু নমনীয় হতে পারতেন না? আদালতে শ্যামল কান্তি কি ন্যায় বিচার পেলেন? শ্যামল কান্তি অবশ্য সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমি এখানে ন্যায়বিচার পেলাম না। একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির কারণে আমাকে ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পিতভাবে এই মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে যে ঘুষের অভিযোগ আনা হয়েছে, আমি কখনো এই ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত নই। আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। যে সময় ঘুষ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে, তখন শীতলকালীন বন্ধ ছিল বিদ্যালয়। ’
তিন. ঘুষ দিয়ে কাজ করতে চাওয়া কি অপরাধের পর্যায়ে পড়ে? তাহলে যিনি অভিযোগ করছেন, শ্যামল কান্তি ঘুষ খেয়েও কাজ করেন নাই সেই ঘুষদাতা কি অপরাধের ঊর্ধ্বে? আইন কি এক্ষেত্রে ন্যায্যতা বজায় রাখলো?
চার. নিম্ন আদালত কি স্বাধীনভাবে এই মামলায় শ্যামল কান্তি ভক্তের জামিন আবেদন বিচার করতে পেরেছেন? নাকি তারাও ছিলেন চাপের মুখে? এই প্রশ্ন উঠেছে কারণ, এখানকার প্রভাবশালীদের প্রভাবের কথা দেশবাসির জানা। তাছাড়া মাননীয় প্রধান বিচারপতি সম্প্রতি সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলার আপিল শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে বলেই ফেলেছেন, নিম্ন আদালতকে কব্জা করা হয়েছে, এবার সুপ্রিম কোর্টকেও কব্জা করতে চায় সরকার। সেই ‘কব্জাপ্রথার’ বলি হলেন কি শ্যামল কান্তি ভক্ত?

পাঁচ. শ্যামল কান্তি দুর্নীতি করেছেন কী না তা আদালত নিশ্চয় সুবিবেচনা করবেন। কিন্তু দুর্নীতি নিয়ে আমাদের জনধারণা কি? আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশনই বা এবিষয়ে কি ভাবেন?
দুদকের ২০১৬ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনের সুপারিশ বলছে, ‘দুর্নীতিগ্রস্তরা যে সমাজে সম্মানিত ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি হিসেবে বিবেচিত, সেই সমাজে দুর্নীতি রোধ করা কঠিন। ’
শুধু তাই নয়, প্রশ্ন ওঠতে পারে, প্রভাবশালীদের কাছে কি বিচারব্যবস্থা জিম্মি?
০২.
শ্যামল কান্তি ভক্ত নারায়ণগঞ্জ পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অপরাধে ২০১৬ সালের ১৩ মে শ্যামল কান্তিকে ওই বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে প্রকাশ্যে লাঞ্চিত করা হয়। স্থানীয় সাংসদ সেলিম ওসমানের নির্দেশে তাকে কানধরে ওঠবস করানো হয়। এই ঘটনার ভিডিও প্রচারিত হলে দেশ জুড়ে তোলপাড় ওঠে। মামলা হয়।বিচারবিভাগীয় তদন্ত হয়। মামলায় সাংসদ সেলিম ওসমানের বিরুদ্ধে আদালত সমন জারি করে। আদালতে হাজিরা দিয়ে জামিন পান সাংসদ সেলিম ওসমান।
শ্যামল কান্তির বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত এবং এক শিক্ষার্থীকে মারধরের অভিযোগ করে দুটি মামলা হয়। আদালত দুটি মামলা খারিজ করে দেন। এরপর প্রবল প্রতাপশালী ক্ষমতাবানদের ইঙ্গিতে শ্যামল কান্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হয়। পানিতে বাস করে কুমিরের সঙ্গে লড়াইয়ের সাজা মিলছে এখন শ্যামল কান্তির কপালে। কেননা শ্যামল কান্তি সংবাদমাধ্যমে অভিযোগ করেছেন, ‘আমাকে চাপে রাখার জন্যই এই মামলা করা হয়েছে। পুলিশ আগে থেকেই ওই প্রভাবশালী ব্যক্তির পক্ষে কাজ করছে। এই মামলায় পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন অন্য রকম হতে পারতো। কিন্তু ওই প্রভাবশালী ব্যক্তিকে খুশী করার জন্যই পুলিশ এই ধরনের প্রতিবেদন দাখিল করেছে। ’
সবচেয়ে বড় অভিযোগ করেছেন শ্যামল কান্তির স্ত্রী সবিতা হালদার। তিনি সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, ‘ বন্দর ধানার এসআই মোখলেসুর রহমান আমাদেরকে সাংসদের সাথে মিলে যাওয়ার জন্য বারবার চাপ দিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন সাংসদ ৫০ লাখ টাকা দেবেন। আমাদেরকে নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে চলে যেতে হবে। কিন্তু আমার স্বামী এতে রাজি হননি। ’
০৩.
শ্যামল কান্তি শিক্ষক। শ্যামল কান্তি একজন সংখ্যালঘু ধর্মের মানুষ। ঘটনাচক্রে তার প্রতিপক্ষ দাঁড়িয়ে গেছে নারায়ণগজ্ঞের সবচাইতে শক্তিমান মুসলমান পরিবার। ক্ষমতায় প্রবল, টাকায় শক্তিমান, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের স্নেহধন্য এই পরিবারের বিপক্ষে শিক্ষক শ্যামল কান্তির এরকম অসম লড়াইয়ে তাই সমাজ, রাষ্ট্র, আদালত, পুলিশ সর্বত্রই তিনি বৈরিতার মুখে পড়েছেন। হয়তো আরও পড়বেন। এক অর্থে নারায়ণগঞ্জের এই ক্ষমতাবান ওসমানগংদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তিনি এক বড় ঝুঁকিই নিয়েছেন। এই চাপ শেষ পর্যন্ত তিনি কতটা সইতে পারবেন, তার পরিবার সইতে পারবে বলা মুশকিল। কিন্তু আমরা জানি রাষ্ট্র যদি দুর্বলকে সবলের আক্রমণ থেকে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয় তবে সেই রাষ্ট্র নিজেই আক্রান্ত হয় ক্ষয়রোগে।
০৪.
শ্যামল কান্তি ভক্তকে নিয়ে গত একবছর ধরে যা ঘটলো তা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের একটা বড় ক্ষয়রোগের নমুনা। কেননা আমরা দেখছি ক্ষমতাবানরা যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। বাধা দেওয়ার কেউ নেই। সমাজ ও রাষ্ট্র বরং তাতে সহায়তাই করবে। ক্ষমতাকেন্দ্র এই অন্যায়কারি, অনায্যকারিদের পাশে দাঁড়াবে অধিকতর সমবেদনা নিয়ে, সহায়তা নিয়ে তাদের সুরক্ষা দেবে।
কিন্তু কেন এমন ঘটছে?
প্রথমত, আমাদের রাষ্ট্র ও সরকারের ক্ষমতাকাঠামোর ব্যালান্স সর্বত্রই নড়বড়ে হয়ে ওঠছে। ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন যে রাষ্ট্রক্ষমতার জন্ম দিয়েছে তার সবচাইতে বড় ফলাফলই হচ্ছে এই ভারসাম্যহীন ক্ষমতা। আমাদের সংসদে কোনও বিরোধী দল নেই। যারা নামে বিরোধী দল তারা আবার সরকারেরই অংশ। ফলে সরকারের কোনও অন্যায় কাজকে সংসদে প্রতিহত করার কোনও চেষ্টা নেই। ব্যালান্সহীন ক্ষমতা সরকারের মধ্যে ক্ষমতাবানদের আরও লাগামছাড়া করেছে। নারায়ণগঞ্জের শ্যামল কান্তি ভক্তকে নিয়ে ওসমান গং পরিবারের কীর্তিকলাপ তারই প্রমাণ।

দ্বিতীয়ত, ক্ষমতাবানদের যে কোনও অপকর্ম ঢাকতে ধর্মকে জড়িয়ে ক্ষমতাবানদের সুরক্ষা দেওয়ার একটা প্রবণতা দৃশ্যমান। শ্যামল কান্তি ভক্তও সেই ধর্ম অবমাননার অভিযোগে দুষ্ট হয়েছেন। কিন্তু মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ার অব্যাহত চাপে শ্যামল কান্তি ভক্ত এই অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেলেও ক্ষমতাবানদের রুষ্টরোষ থেকে মুক্তি পান নাই। আবার আইন, আদালত, পুলিশ সর্বত্রই একটা বৈরিতার মুখে পড়েছেন শ্যামল কান্তি ভক্ত। এটাও নিরঙ্কুশ ক্ষমতা পাওয়া সরকারব্যবস্থার একটা রোগ। এখানে সবাই ন্যায্যতার পাশে না দাঁড়িয়ে ক্ষমতাবানকেই খুশী করতে চায়। ক্ষমতাবানের অন্যায়কেই সুরক্ষা দিতে চায়। কেননা এখানকার রাষ্ট্রীক প্রতিষ্ঠান ও তার চালকেরা জানে এই সরকারের ক্ষমতাবানদের খুশী করলেই নিজেদের লাভ। অখুশী করলে নিজেদের বিপদ। তাই ক্ষমতবানকে খুশী করার নীতিতেই সবাই চলছে। সেটাই শ্যামল কান্তি ভক্তদের মতো মানুষদের দুর্ভোগে ফেলছে।
০৫.
শ্যামল কান্তি সিনড্রোম এখন রাষ্ট্রজুড়ে। এই ক্ষয়রোগের উপশম দরকার। যদি উপশমের ব্যবস্থা না হয়, এই অনায্য শাসন অব্যাহত থাকে তাতে হয়তো রাষ্ট্র, সরকার, শাসকশ্রেণি বা তাদের সহযোগিরা আপাতত একটা সুখ ও স্বস্তির মুখ দেখবে কিন্তু আখেরে এক বড় বিপদ রাষ্ট্রকেই গ্রাস করবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে রাষ্ট্রের এই ক্ষয়রোগ সারানোর উদ্যোগ নেবেটা কে।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক