X
রবিবার, ১৯ মে ২০২৪
৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

শাপলা চত্বর ও শাহবাগের দূরত্ব

মো. সামসুল ইসলাম
০৫ মে ২০২৪, ২০:১৬আপডেট : ০৫ মে ২০২৪, ২০:১৬

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান সম্প্রতি এক আলোচনা অনুষ্ঠানে দেশে শাপলা চত্বর ও শাহবাগের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যুদ্ধ চলমান বলে মন্তব্য করেছেন।

আমার মনে হয় রেহমান সোবহানের বক্তব্য নিয়ে বিতর্কের কোনও অবকাশ নেই। যারা সামাজিক মাধ্যমে যুক্ত তাদের অনেকেই প্রতিনিয়ত এই ‘যুদ্ধ’ দেখছেন, আবার কেউ কেউ এই ‘যুদ্ধে’ অংশগ্রহণ করছেন। দেশ-বিদেশের অনেক ঘটনাকে বা ইস্যুকে শাহবাগ ও শাপলা চত্বরের সমর্থকরা ব্যবচ্ছেদ করেন, তাদের মতামত জানান। দুই দলেরই রয়েছে সুবিশাল সমর্থকগোষ্ঠী। আসলে দেশ অনেকটাই বিভক্ত। তবে সামাজিক সাংস্কৃতিক এই বিভক্তি কমানোর বুদ্ধিবৃত্তিক উদ্যোগ বুদ্ধিজীবীদের তরফ থেকে একেবারেই কম।

তবে উত্তর আধুনিক পৃথিবীতে শাপলা চত্বর আর শাহবাগের সহাবস্থান অসম্ভব নয়। ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠা মাল্টিপল মডার্নিটি বা পোস্ট সেক্যুলারিজমের ধারণা সমাজে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে আধুনিকতার ভিন্ন ভিন্ন ধারণার অস্তিত্বকে স্বীকার করে এবং একই সঙ্গে সেক্যুলারিস্ট এবং ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে আলোচনা উৎসাহিত করে। ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক এবং ইউরোপেও আমরা বিভিন্ন মাত্রায় এর প্রচেষ্টা দেখি।

শাহবাগ বা শাপলা চত্বরের উদ্ভবের ইতিহাস আমরা জানি। তবে বর্তমান আদর্শিক অবস্থান অনুসারে শাহবাগের সমর্থকরা হচ্ছেন মোটাদাগে সেক্যুলারিস্ট, বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। এর বিপরীত মতাদর্শের অনুসারীরা হচ্ছেন শাপলা চত্বরের সমর্থক– ধর্মীয় গোষ্ঠী, ডানপন্থি ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। আপাতদৃষ্টিতে এই বিভাজন সরল মনে হলেও একদিকে বিশ্ব রাজনীতি অপরদিকে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে দলবদলের ঘটনা ঘটছে। সর্বশেষ নববর্ষ বা নারী আম্পায়ার নিয়ে শাহবাগ ও শাপলা চত্বরের মধ্যে ফেসবুক বিতর্কে অনেক বামকেও শাপলা চত্বরের সমর্থক হতে দেখা গেছে।

প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক উক্তি- ‘অতি বাম অতি ডান সবই এক হয়ে গেছে, কীভাবে হলো জানি না’। এক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য যা অতিমাত্রায় সত্য! শাহবাগ থেকে শাপলা চত্বরের সমর্থক বা শাপলা চত্বর থেকে শাহবাগের সমর্থক প্রায়শই দৃষ্টিগোচর হয়।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় এই মেরুকরণ বা সামাজিক বিভক্তি থেকে জাতির মুক্তি নেই। আমরা দেখছি এর ফলে শিক্ষাব্যবস্থা বিশেষত কারিকুলাম প্রণয়ন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, মানবাধিকারের ভিন্ন ভিন্ন সংজ্ঞা পাওয়া যাচ্ছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে। অথচ পারস্পরিক সংলাপ, সমঝোতার মাধ্যমে এ ধরনের যুদ্ধাবস্থা থেকে আগামী প্রজন্মকে রেহাই দেওয়া যেত। কিন্তু দুই পক্ষই তাদের অবস্থানে অনড়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে স্বাধীন জ্ঞানচর্চা, গবেষণা একেবারেই অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় আক্রমণের বা ট্রলের শিকারের ভয়ে অনেকেই লেখালেখি বাদ দিয়েছেন– বুঝেশুনে গবেষণা করছেন।

মানবীয় যোগাযোগের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে এবং একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে আমি যোগাযোগের দৃষ্টিভঙ্গিতে এই দূরত্ব দেখার চেষ্টা করছি এবং কীভাবে এ দূরত্ব কমিয়ে আনা সম্ভব এ ব্যাপারে কিছুটা আলোকপাত করছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে কোনোপক্ষকেই আক্রমণ করছি না এবং এ ব্যাপারে কোনও বিতর্কে অংশগ্রহণ করা আমার একেবারেই কাম্য নয়।

নির্মোহ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে  দুপক্ষেরই কিছু সমস্যা দৃষ্টিগোচর হয়। আমরা যদি শাপলা চত্বরের কথা বলি তাহলে আমি বলবো যে তারা যেভাবে সব ইস্যুতে প্রতিক্রিয়া দেখান তা অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রয়োজনীয়। পোস্ট মডার্ন, গ্লোবালাইজড, ক্যাপিটালিস্ট সিস্টেমে বাস করে রিলিজিয়াস পিউরিটানিজমের প্রত্যাশা বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে। ইসলাম তো একটি প্রতিষ্ঠিত ধর্ম– এটি ঠুনকো কিছু নয়। ধর্মকে শুধু পরকালীন মুক্তির উপায় হিসেবে দেখার ফলে আমাদের দেশে ধর্মকে জাগতিক উন্নয়নের মুখোমুখি দাঁড় করে দিয়েছে। ম্যাক্স ওয়েবার দেখিয়েছেন প্রোটেস্টান্ট ওয়ার্ক এথিক কীভাবে ইউরোপে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটিয়েছে। ইউরোপ বা আমেরিকাতে সেটি কীভাবে কাজ করছে তা নিয়ে এখনও অনেক গবেষণা হচ্ছে। কিন্তু ধর্মকে উৎপাদনশীলতা বা  শ্রম এসবের সঙ্গে সংযুক্ত না করে শুধু ধর্মীয় প্রতীক রক্ষার আন্দোলনে ব্যস্ত থাকার কারণে দেশে দুর্নীতি বা এলিটদের নিপীড়ন বন্ধের ক্ষেত্রে ধর্মের কোনও প্রভাব নেই।

অপরদিকে শাহবাগের সমর্থকদের একাংশের বর্তমান সমস্যা হচ্ছে দেশে তরুণদের মধ্যে ধর্মীয় আগ্রহকে ৯/১১ পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত না করে শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করা। এটি ভুল বোঝাবুঝিকে চরমে পৌঁছে দিয়েছে। তরুণরা আসলে বিভিন্ন মুসলিম কালচারাল সিম্বলকে ব্যবহার করে প্রাচ্যে এবং পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশের ক্রমবর্ধমান ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে মুসলিম আইডেন্টিকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইছে। ভুলে গেলে চলবে না তারা মধ্যপ্রাচ্য, মিয়ানমার প্রভৃতি দেশে গণহত্যাকে নিজের চোখে দেখছে। যা কিছু ধর্মীয় তাই খারাপ- শাহবাগের একাংশের এই প্রবণতা দেশের ধর্মবিশ্বাসী এক বিশাল জনগোষ্ঠীকে তাদের কাছ থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে।

তবে এই দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়ে দুই দলকে কাছাকাছি আনতে হবে। তত্ত্বীয়ভাবে এটা ভালোভাবেই সম্ভব। বিশ্বে বিভিন্ন দেশে সোশ্যাল আইডেন্টিটি থিউরি,  ডেলিবারেটিভ ডেমোক্র্যাসি বা ইনক্লুসিভ গভর্ন্যান্সের ধারণার প্রয়োগ একই ধরনের পরিস্থিতিতে ভালো ফলাফল দিয়েছে। পারস্পরিক আলোচনা ও সহিষ্ণুতা দুপক্ষের মধ্যে একটা উইন উইন সিচুয়েশন তৈরি করতে পারে।

অন্য ভূখণ্ডের মতাদর্শের প্রতি আন্তরিক বিশ্বাস আমাদের পারস্পরিক দূরত্ব অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রথমে কমিউনিজম ক্যাপিটালজম দ্বন্দ্ব, পরবর্তীতে ওয়ার অন টেরর, সালাফিজম, এনজিওভিত্তিক উন্নয়ন মডেল, মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসরত প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি প্রভৃতি বাংলাদেশিদের আদর্শিক বিভাজনকে জটিল করেছে। বাঙালি বা বাংলাদেশি এমনকি শাহবাগ ও শাপলা চত্বর এখন মনোলিথিক কোনও আদর্শ নয়। আলাদাভাবে এদের ভেতরেও রয়েছে বিভিন্ন বিভক্তি।

ধর্ম যেহেতু একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, তাই ধর্মের ব্যাপারে দুপক্ষকেই সংযমী হতে হবে। পারস্পরিক সমঝোতার দু-একটি উদাহরণ আমি দিতে পারি। তা হলো মাদ্রাসাসহ ইসলামিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ফাইন্যান্সিংয়ের ব্যাপারে দেশের শিক্ষাবিদ ও সুশীল সমাজের ইন্টেলেকচুয়াল ইনপুট।

আমাদের দেশে যে পদ্ধতিতে ওয়াজের মাধ্যমে টাকা উঠিয়ে ইসলামি প্রতিষ্ঠান চালানো হয়, অন্য কোনও দেশে বা ধর্মে আছে কিনা আমার জানা নেই। মুসলিম বিভিন্ন দেশের এবং বিভিন্ন ধর্মের প্রতিষ্ঠানসমূহের অর্থায়ন নিয়ে আমাদের জ্ঞান খুবই অল্প। এ ব্যাপারে গবেষণায় সেক্যুলাররা সাহায্য করতে পারেন। অপরদিকে দেশে বেসামাল দুর্নীতি ঠেকানোর ক্ষেত্রে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও জ্ঞানের প্রসার ভূমিকা রাখতে পারে।

সবশেষে বলা যায়, শাহবাগ এবং শাপলা চত্বরের দূরত্ব কমিয়ে আনার ব্যাপারে দেশের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। তার বিভিন্ন দেশের উদাহরণ বিশ্লেষণ করে এর জন্য প্রয়োজনীয় তাত্ত্বিক কাঠামো নির্মাণ বা নির্বাচন করতে পারেন। আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা ও গবেষণার ঘাটতির কারণে রাজনীতিবিদরা বা নীতিনির্ধারকরা এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা পান না।

লেখক: কলামিস্ট, বিভাগীয় প্রধান, সাংবাদিকতা বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।

ই-মেইল: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কানে ঝুলছে বাংলাদেশের দুল!
কান উৎসব ২০২৪কানে ঝুলছে বাংলাদেশের দুল!
ধোনি-জাদেজার লড়াই ছাপিয়ে প্লে অফে বেঙ্গালুরু
ধোনি-জাদেজার লড়াই ছাপিয়ে প্লে অফে বেঙ্গালুরু
বৃষ্টি নিয়ে সুখবর, থাকতে পারে সোমবার পর্যন্ত
বৃষ্টি নিয়ে সুখবর, থাকতে পারে সোমবার পর্যন্ত
হীরকজয়ন্তীর পর সংগঠনে মনোযোগ দেবে আ.লীগ
হীরকজয়ন্তীর পর সংগঠনে মনোযোগ দেবে আ.লীগ
সর্বশেষসর্বাধিক