পাহাড়ের মানুষের কষ্ট, পাহাড় ক্ষত-বিক্ষত হওয়া নিয়ে বিচলিত ছিলাম বরাবরই। কিন্তু আমার মনের সেই বিচলতা প্রকাশ্যে আনিনি। তবে আশপাশের অনেককেই বিচলিত হতে দেখেছি। নিয়মিত দৌড়ে তারা পাহাড়ে গেছেন। দোস্তি-সই পাতিয়েছেন তাদের সঙ্গে। সভা-সেমিনার কম করা হয়নি। নানা দিবসে প্রেস রিলিজ কম লেখা হয়নি। কিন্তু যেই মানুষগুলো নিয়মিত পাহাড়ে দৌড়ে গেছেন, তারা পাহাড় হত্যা থামাতে পারেননি। ব্যর্থ হয়েছেন পাহাড়ের মানুষের জীবন রক্ষায়। ভূমি বিরোধের মিমাংসার কোন ছক আঁকতে পারেননি। পাহাড় এবং পাহাড়ের মানুষের হত্যাকারীরা তাদের কাজটি প্রকাশ্যেই করে গেছেন। গুঞ্জন আছে, যারা পাহাড়ের কষ্টের কথা বলে চোখ মুছেছেন-পাহাড়ের মানুষদর উচ্ছেদ করা, পাহাড়ের দখল নেওয়ার সঙ্গে তাদের প্রচ্ছন্ন যোগাযোগ আছে। কেউ কেউ পাহাড়ের মালিকও হয়েছেন। কারো কারো পর্যটনের ব্যবসা হয়েছে। আর একটি অংশ জঙ্গলে শিকার করতে যাওয়ার বিকল্প শখ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন পাহাড়ের মানুষের সঙ্গে কিছু সময় কাটানোকে। এর পেছনে ওই জনগোষ্ঠীর খাদ্যাভ্যাসের বিশেষ ‘তরল’ ওই তাদের আকৃষ্ট করেছে বেশি। অনেকের নানা বিদেশ ভ্রমণ, সুশীলের সনদপত্রে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে পাহাড় এবং পাহাড়ের সরল মানুষ।
পাহাড় যে কেবল এবারই প্রথম ধসে পড়লো তা নয়। ২০০৭ সালে ধসে পাড়েছিল। সেইবারও মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়ে ছিল শতকের কোঠা। এবার দেড়শ পেরোলো। ভয়াবহতা এবার বেশি একারণে যে চট্টগ্রামসহ পার্বত্য তিনজেলায় পাহাড় ধস হয়েছে। রাঙ্গামাটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে মূলজনপদ থেকে। সংকট দেখা দিয়েছে খাবার এবং জ্বালানির। মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি পাহাড়ি জনপদ। আমি এইকথা বলতে চাই না যে, এই দুর্যোগে কেন সেই সুশীলরা বা দুঃসাহসী যাত্রীরা পাহাড়ের মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন না। আমি তাদের কাছে বা কারো কাছেই সেই দাবিটি করছিনা। রাষ্ট্র তার পদ্ধতিমতো চেষ্টা করছে দুর্যোগ মোকাবিলায়। দুর্যোগ থেকে স্বাভাবিক জীবন আবারো ফিরে আসবে পাহাড়ে। কিন্তু পাহাড়ের মানুষের জীবনের ঝুঁকি কিন্তু কমবে না একরত্তি। তাদের দুর্ভোগ, পাহাড় হত্যা থেকে সরে আসবেনা হত্যাকারীরা। দেখুন, প্রকৃতিকে পোষ মানাতে গিয়ে আমরা যে পেরে উঠছি না। হেরে যাচ্ছি প্রকৃতির কাছে এই বোধটুকুও কিন্তু আমরা হারিয়ে বসে আছি। প্রকৃতি ঠিকই তাকে হত্যার প্রতিশোধ নিচ্ছে। আমরা আবার যদি তাকে হত্যার চেষ্টা করি, হয়তো তাকে জয় করতে পেরেছি বলে উল্লাসে মেতেও উঠবো, কিন্তু এক সময় দেখবো প্রকৃতির প্রতিশোধ দশ দিক থেকে ধেয়ে আসছে আমাদের দিকে। প্রকৃতি ঠিকই তার নিজ সন্তানকে আগলে রাখবে, ধ্বংস হবো আমরা যারা তাকে দখল করতে, হত্যা করতে হাত বাড়াই, পা বাড়াই। তাই ছোট্ট একটু আবেদন-পাহাড়কে, পাহাড়ের মানুষদের তাদের মতোই থাকতে দিন। পাহাড় এবং পাহাড়ের মানুষদের নিয়ে অযথা ভাবনা ‘বিলাস’এর প্রয়োজন নেই। ওদের ভালো থাকার উপায় ওদের নিজেদেরই জানা আছে।
লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি