একইভাবে ইংরেজির Joint Secretary শব্দের বাংলা ‘যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক’। ব্যাকরণ মানলে এটি লেখা উচিত ‘যুগ্মসাধারণ সম্পাদক’। অর্থাৎ যুগ্ম, উপ, সহ-এসবই পরবর্তী শব্দের সাথে যুক্ত হওয়ার কথা। কিন্তু অধিকাংশ লোক ও প্রতিষ্ঠানই লেখে যুগ্ম মহাসচিব, সহ সম্পাদক, উপ সহকারী প্রকৌশলী ইত্যাদি। বড়জোর কেউ মাঝখানে একটা হাইফেন ব্যবহার করেন।
বাংলা একাডেমি বিবিধ পরিবর্তন এনে কিছু বানান আমূল পাল্টে দিয়েছে। প্রমিত/শুদ্ধ বানান দেখার জন্য তাদের সবশেষ বানান অভিধানটি খুললে আপনি বিভ্রান্ত হবেন। যেরকম বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে ‘ঈদ’ ও ‘ইদ’ নিয়ে। ফেসবুকও বেশ গরম এই ইস্যুতে। দেখা যাচ্ছে, দীর্ঘ ‘ঈ’ দিয়ে ‘ঈদ’ লেখার পক্ষেই জনমত প্রবল। বাংলা একাডেমি আরও অসংখ্য শব্দের বানান পরিবর্তন করেছে, কিন্তু সেসব নিয়ে ফেসবুক সরগরম হয়নি। এর একটা কারণ সম্ভবত এই যে, ‘ঈদ’ শব্দটির সাথে ধর্মীয় অনুভূতি জড়িত এবং শৈশব থেকেই আমরা ‘হ্রস্ব ই তে ইঁদুর, দীর্ঘ ঈ তে ঈদ’ পড়ে ‘ঈদ’ শব্দটির একটি বানানের সাথে পরিচিত হয়ে উঠেছি। এখন কেউ যদি ঈঁদুর লেখা শুরু করে, সেটা নিশ্চয়ই আমরা মানব না। কবিতা-গল্প-গানেও ‘ঈদ’ লেখা হয় দীর্ঘ ‘ঈ’ দিয়ে। ফলে বাংলা একাডেমি যতই বলুক এটির শুদ্ধ/প্রমিত বানান ‘ইদ’, মানুষ সেটি মানছে না বা মানতে চাচ্ছে না। বরং গণমাধ্যমও এখনও ‘ঈদ’ লিখছে।
যদিও বাংলা একাডেমি বলেনি যে, এখন থেকে ‘ইদ’ লিখতে হবে। বরং তারা লিখেছে,‘ইদ শব্দটি ঈদ-এর সংগততর ও অপ্রচিলত বানান। আর ঈদ শব্দটি ইদ-এর প্রচলিত ও অসংগত বানান। ’ অর্থাৎ তারা শুধু নিয়মটা বলেছে এবং ‘ঈদ’ বানানটিই যে প্রচলিত, সেটিও বলেছে। এখানে সমস্যার কোনও কারণ দেখি না। অনেক প্রচলিত ভুলই আমরা করে থাকি প্রতিনিয়ত। যেমন ‘অপর্যাপ্ত’ শব্দের অর্থ প্রয়োজনের তুলনায় বেশি। কিন্তু আমরা শব্দটি ব্যবহার করি প্রয়োজনের তুলনায় কম অর্থে।
বাংলা একাডেমির নিয়ম অনুযায়ী সকল বিদেশি শব্দের বানান হ্রস্ব-ই কার দিয়ে লিখতে হবে। যেমন আমরা এখন লিখি স্পিকার, স্পিড, গ্রিস ইত্যাদি। কিন্তু শ্রীলংকা ঠিকই দীর্ঘ ‘ঈ’ কার দিয়ে। কেউ কেউ ফেসবুকে নিজের বিদেশি নামের বানান উল্লেখ করে লিখেছেন, এখন বাংলা একাডেমি কি আমার নামও বদলে দেবে? অবশ্যই না। এই এখতিয়ার বাংলা একাডেমি কেন, কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানেরই নেই। ব্যক্তির নামের ক্ষেত্রে কোনও ব্যাকরণ প্রযোজ্য নয়। যেমন আমার নামের তিনটি শব্দই (আমীন আল রশীদ) আরবি। আমি লিখি দীর্ঘ ‘ঈ’ কার দিয়ে। বাংলা একাডেমির কি সাধ্য আছে যে আমার নামটি আমিন আল রশিদ করবে? বাংলা একাডেমি সে কথা বলেও না।
বাংলা একাডেমি কেন, আমরা যেকোনও প্রতিষ্ঠানেরই যৌক্তিক ও গঠনমূলক সমালোচনা করতে পারি। কিন্তু মনে রাখা দরকার, বাংলা একাডেমিই রাষ্ট্রের একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যাদেরকে বানান রীতি ঠিক করার এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। আমি হয়তো বাংলা ভাষা নিয়ে অল্পবিস্তর পড়ালেখা করে নিজেকে পণ্ডিত ভাবতে পারি, কিন্তু এও ঠিক যে, বাংলা একাডেমির বানান নির্ধারণ কমিটিতে যারা রয়েছেন, তারা আমার চেয়ে বেশি পণ্ডিত। বেশি পণ্ডিত বলেই তারা কমিটিতে আছেন; আমি নেই।
পাশাপাশি এও ঠিক, বাংলা একাডেমি বানান সংস্কার বা হালনাগাদ করার নামে বেশ কিছু জায়গায় বিভ্রান্তিও তৈরি করেছে। একই বিষয়ে তারা একটি নির্দেশনা দিয়ে, নিচে পাদটিকায় ব্যতিক্রম উল্লেখ করে কিছু শব্দ জুড়ে দিয়েছে। অর্থাৎ এই নিয়মের বানান হবে এই, কিন্তু ব্যতিক্রম হলো এই। এই ব্যতিক্রমগুলোই ঝামেলা পাকায়। কিন্তু বাংলা একাডেমি এই ঝামেলা মেটাতে পারছে না অথবা তারা সেই চেষ্টাটি হয়তো করছে।
প্রশ্ন হলো ইংরেজিকে কেন আমরা আন্তর্জাতিক ভাষা বলে মানি? কেন এই ভাষাটি সারা পৃথিবীতে চলে? কেন এই ভাষাটি সব ভাষাভাষী মানুষকে শিখতে হয়? কারণ, এই ভাষাটি তুলনামূলকভাবে সহজ এবং এখানে ব্যতিক্রম বলে কিছু নেই। এখানে যুক্তাক্ষর নেই, হ্রস্ব ‘ই’ কার দীর্ঘ ‘ঈ’ কার, হ্রস্ব ‘উ’ কার দীর্ঘ ‘ঊ’ কারের বিভ্রান্তি নেই, হাইফেন নেই, সমাসবদ্ধতা নেই, উনিশ লিখবা না ঊনিশ-তা নিয়ে সংশয় নেই। তারা Nineteen-ই লিখবে। কিন্তু বাংলায় একই শব্দের বিবিধ বানান মানুষকে বিভ্রান্ত করে। প্রচলিত অপ্রচলিতর টানাপড়েন এই সমস্যা আরও বাড়িয়ে দেয়।
এখন এই সমস্যা উত্তরণে বাংলা একাডেমি যদি দীর্ঘ ‘ঈ’ কার, দীর্ঘ ‘উ’ কার উঠিয়ে দেয়, তিনটি শয়ের (শ, ষ, স) বদলে একটি শ, দুটি ন-এর (ণ, ন) বদলে একটি ন লিখতে বলে তাহলে শত শত বছর ধরে বাংলা ভাষায় যেসব সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলোর কী পরিণতি হবে? স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা থেকে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দ উঠিয়ে দেওয়া হবে নাকি তাদের ব্যবহৃত বানানগুলো হালনাগাদ করে নতুন করে পাঠ্যবই ছাপানো হবে? যদি তা না হয়,তাহলে ক্ল্যাসিক সাহিত্যে একজন শিক্ষার্থী একরকম বানান দেখে যখন আধুনিক সাহিত্যে ভিন্নতা দেখবেন, সেটি কি তাকে বিভ্রান্ত করবে না? পরীক্ষায় খাতায় সে কী লিখবে, ‘ঈদ’ না ‘ইদ’?
এ কথা অস্বীকার করার তো সুযোগ নেই যে, ভাষার পরিবর্তন হচ্ছে এবং হবে। যে কারণে বলা হয়, ভাষা হচ্ছে প্রবহমান নদীর মতো। আমাদের বর্ণমালায় একসময় ‘লি’ ও ‘ডাবল লি’ নামে দুটি বর্ণ ছিল। অপ্রয়োজনীয় বলে সে দুটি বাদ দেয়া হয়েছে। এখন তিনটি স, দুটি ন, দীর্ঘ ঈ কার, দীর্ঘ ঊ কার থাকবে কি থাকবে না, তা নিয়েও গবেষণা হচ্ছে। যেমন পাখী, শাড়ী, বাড়ী এরইমধ্যে পাখি, শাড়ি, বাড়ি হয়ে গেছে। সুতরাং ‘ঈদ’ যদি ‘ইদ’ হয় তাতে ক্ষতি কী?
দুয়েকটি শব্দ ছাড়া ‘ঞ’ প্রয়োজন হয় না। সুতরাং বর্ণমালার মধ্যে এই বর্ণটি রাখার কী প্রয়োজন? হয়তো ভবিষ্যতে ‘ঞ’ বাদ পড়ে যাবে। এভাবে ধীরে ধীরে ৫০টি থেকে বাংলা বর্ণমালা হয়তো ৪০টিতে নামিয়ে আনা যাবে। তবে সেখানেও চ্যালেঞ্জ আছে।
যেমন ক্ষতি বানান ‘ক্ষ’ দিয়ে হলেও এখন ক্ষেত (জমি) লেখা হচ্ছে ‘খ’ দিয়ে (খেত)। এতে কিছুটা বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। কেননা খেত বানানটি দেখলে মনে হতে পারে, এট খেতেন-এর আরেক রূপ। বাংলা একাডেমি বোধ হয় ‘ক্ষ’ বর্ণটিও তুলে দিতে চাচ্ছে। যদি তাই হয় তাহলে ‘ক্ষমা’কে ‘খমা’ লিখতে হবে, ‘ক্ষত’-কে ‘খত’। সেটি নিয়েও নতুন তর্ক শুরু হবে। আবার যদি তিনটির জায়গায় একটি স চালু করা হয় তখন ‘শব’ (মরদেহ), ‘সব’ (সমস্ত), ‘ভাসা’ (ভেসে যাওয়া অর্থে), ‘ভাষা’ (ভাষা অর্থে)-এরকম অনেক শব্দের বানান নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হবে। অর্থাৎ সহজ করতে গিয়ে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে।
সাপ্তাহিক যায়যায়দিন এবং পরে শফিক রেহমান যখন এটিকে দৈনিকে রূপান্তরিত করলেন (আমিও ওই টিমের একজন সদস্য ছিলাম) সেখানে অনেক ইংরেজি শব্দের বানান (যেমন কৃকেট) যেমন যায়যায়দিন তার নিজস্ব স্টাইলে লিখত, তেমনি অনেক শব্দের সুন্দর বাংলা থাকার পরও ইংরেজি ব্যবহার করত (যেমন অ্যাডভাইজর)। এসব নিয়ে শফিক ভাইয়ের সঙ্গে আমরা অনেক তর্ক করেছি।
প্রথম আলোও অনেক শব্দ তার নিজস্ব স্টাইলে লেখে যেটি বাংলা একাডেমির সাথে মেলে না। ফলে এ বিষয়েও একটা সমাধানে আসা দরকার যে, কোনও প্রতিষ্ঠান চাইলেই তার নিজের মতো করে বানান লিখতে পারে কি না? যদি পারে তাহলে বাংলা একাডেমি থাকার কোনও প্রয়োজন আছে কি না? কারণ আজ যায়যায়দিন ও প্রথম আলো নিজস্ব ভাষারীতি তৈরি করবে, তো কাল সমকাল ও কালের কণ্ঠও এটা করবে। এভাবে সব প্রতিষ্ঠান নিজস্ব রীতিতে লিখবে এবং ভাষার ক্ষেত্রে একটা ভয়াবহ নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে। বাংলা ছাড়া আর কোনও ভাষায় এরকম চর্চা আছে কি না আমার জানা নেই। বরং ইংরেজিতে Minister শব্দের ভিন্নতর বানান না থাকলেও বাংলায় কেউ হয়তো মন্ত্রীকে মন্ত্রি লিখবেন। যেমন মন্ত্রী শব্দের বানান মন্ত্রী হলেও, মন্ত্রিসভা লিখতে গেলে এখানে হ্রস্ব ‘ই’ কার দিতে হয়। এত জটিলতার কী দরকার? সুতরাং বাংলা ভাষার এসব প্রশ্ন নিয়ে খুব খোলামেলা আলোচনা হওয়া দরকার। তবে ফেসবুকে এ নিয়ে মানুষ যে প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে, সেটিও খারাপ না। বরং আলোচনা উঠেছে বলেই তর্কের একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। অতএব তর্ক চলুক। তবে বানানরীতিতে বড় ধরনের কোনও পরিবর্তন আনলে সে বিষয়ে গণশুনানি/জনমত গ্রহণ এবং গণমাধ্যমে বিষয়টির ব্যাপক প্রচার করা দরকার। না হলে বাংলা একাডেমি কোন বানানে কী পরিবর্তন আনলো, তা সাধারণ মানুষ জানবে না এবং ‘ঈদ’ ও ‘ইদ’ নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হতেই থাকবে।
মনে রাখা দরকার ভাষা একইসঙ্গে বিজ্ঞান ও কাণ্ডজ্ঞান-যার মূল উদ্দেশ্য যোগাযোগ। সুতরাং বিজ্ঞান ও ব্যাকরণের দোহাই দিয়ে যা খুশি তাই করা যেমন সঙ্গত নয়, তেমনি আবার অধিকতর কমিউনিকেটিভ বা যোগাযোগবান্ধব করার জন্য যে যার মতো বানান লিখবেন, সেটিও ভয়ঙ্কর। সে কারণেই একটা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ থাকা জরুরি এবং এখন পর্যন্ত সেই প্রতিষ্ঠানটির নাম বাংলা একাডেমি। এই প্রতিষ্ঠানের নিশ্চয়ই অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। আমরা বরং সেই সীমাবদ্ধতাগুলো নিয়ে আলোচনা করতে পারি। কী করে সেই সীমাবদ্ধতা দূর করা যায়, কিভাবে যোগ্য, সৎ ও আন্তরিক লোকেরা প্রতিষ্ঠানটির গুরুত্বপূর্ণ পদে বসতে পারেন, সেই বিষয় নিয়ে আমরা বরং কথা বলতে পারি। ঈদ না ইদ এটা কোনও বড় তর্কের বিষয় নয়।
লেখক: সাংবাদিক ও লেখক।