প্লেয়িং ফিল্ড কতটা লেভেল?

প্রভাষ আমিনবাংলাদেশ এবার একটু আগেই নির্বাচনি মহাসড়কে ওঠে গেছে। ২০১৮ সালের শেষ দিকে বা ২০১৯ সালের শুরুর দিকে দেশে অনুষ্ঠিত হবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। হিসেবে এখনও প্রায় দেড় বছর বাকি। কিন্তু চারদিকে নির্বাচনি হাওয়া, নির্বাচন নিয়ে আলোচনা। মূলত গত বছর অক্টোবরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের পর থেকেই বইতে শুরু করেছে নির্বাচনি হাওয়া। সময় যত যাচ্ছে, ততই সে হাওয়া গতি পাচ্ছে। গত রবিবার নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপ ঘোষণার মধ্য দিয়ে নির্বাচনি প্রক্রিয়ার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলো বলা যায়। কিন্তু নির্বাচন কমিশন ঘোষিত এই রোডম্যাপ নিয়ে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি যেভাবে বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছে, তাতে বুঝতে অসুবিধা হয় না, নির্বাচন নিয়ে মৌলিক জটিলতাগুলো এখনও রয়েই গেছে। নির্বাচনি গাড়ি রোডম্যাপ ধরে পুরো গতিতে আগাতে হলে আগে এই জটিলতাগুলো মেটাতেই হবে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন, প্রার্থীবিহীন নির্বাচনের দায় কাঁধে নিয়েই জাতি এগুচ্ছে একাদশ নির্বাচনের দিকে। আরও একটি এ ধরনের নির্বাচনের দায় বহন করার সামর্থ্য আওয়ামী লীগের নেই, বিএনপির নেই; বাংলাদেশেরও নেই। আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলে দিয়েছেন, আর কোনও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন হবে না। তার মানে শেখ হাসিনাও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথাই বলছেন। কাউন্সিলের পর আওয়ামী লীগের নানা আয়োজনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ এটা ভালো করেই জানে, আরো একটি একতরফা নির্বাচন দেশে-বিদেশে তাদের গ্রহণযোগ্য গুরুতরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। তাই যে কোনও মূল্যে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার চেষ্টা করবে আওয়ামী লীগ। প্রকাশ্যে না হলেও আড়ালে এই চেষ্টাকরারই কথা। উল্টোদিকে বিএনপিকেও আগামী নির্বাচনে অংশ নিতেই হবে। গত নির্বাচন বর্জন করে তারা যে ভুল করেছে, তা পুনরাবৃত্তি করার সামর্থ্য তাদেরও নেই। গত নির্বাচনে অংশ না নেওয়াটা যে ভুল ছিল আনুষ্ঠানিকভাবে সেটা স্বীকার না করলেও, সেটা বিএনপি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
গত নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপি জনরায় পেতেও পারতো। জাতীয় নির্বাচনের আগে পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তারা তেমন ইঙ্গিত পেয়েছিল। সেটা না হলেও বিএনপি সংসদে বিরোধী দল হিসেবে শক্তিশালী অবস্থান নিয়ে থাকতে পারতো। তখন তারা সংসদের ভেতরে-বাইরে সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারতো। নির্বাচন বর্জন করলেও ঠেকাতে পারেনি বিএনপি। তাই তারা এখন না ঘরকা, না ঘাটকা। নির্বাচন যতই প্রশ্নবিদ্ধ হোক, এই নির্বাচন দিয়েই তো আওয়ামী লীগ দেশ চালাচ্ছে। বিএনপি ঠেকাতেও পারেনি, অস্বীকারও করতে পারছে না। অনিচ্ছায় হলেও বর্তমান সরকারকে মেনে নিতে হয়েছে বিএনপিকে। বিএনপি কোনও বিপ্লবী দল নয়, বিএনপি একটি ক্ষমতামুখী, নির্বাচনমুখী দল। তাদের নেতাকর্মীরাও নির্বাচন করতে চান, ক্ষমতায় যেতে যান। অত ত্যাগী নেতাকর্মী বিএনপিতে নেই যে তারা বছরের পর বছর বসে থাকবে। তাই দল টিকিয়ে রাখতে হলেও বিএনপিকে আগামী নির্বাচনে যেতেই হবে। আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করার ব্যাপারে দু’দলের এই বেপরোয়া অবস্থানের কথাও দুদল জানে। তাই দুই দলই কৌশলের খেলায় নেমেছে। প্রতিপক্ষকে কতটা কম ছাড় দিয়ে নির্বাচনে আনা যায়, সেই চেষ্টা যেমন আওয়ামী মহলে আছে; আবার সরকারের সঙ্গে বার্গেন করে কতটা সুবিধা আদায় করা যায়, সে চিন্তায় অস্থির বিএনপিও। এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচনের ব্যাপারে অনড়। আবার বিএনপিও শেখ হাসিনার অধীনে কোনও নির্বাচনে না যাওয়ার ব্যাপারে অনড়। বাস্তবতা হলো আলোচনার ভিত্তিতে, দুই পক্ষকেই কিছু না কিছু ছাড় দিতে হবে।

কিন্তু বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যেভাবে নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপ প্রত্যাখ্যান করেছেন, তাতে নির্বাচনে যাওয়ার ব্যাপারে আন্তরিকতার ঘাটতি রয়েছে। আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যে সমঝোতার যে ঘাটতি, তার দায় তো নির্বাচন কমিশনের নয়। নির্বাচন যার অধীনেই হোক, যেভাবেই হোক, যে দলই অংশগ্রহণ করুক বা না করুক; নির্বাচন কমিশনকে তো যথাসময়ে নির্বাচন করতেই হবে। কোনও দল নির্বাচনে না এলে তো নির্বাচন কমিশন তাদের জন্য বসে থাকতে পারবে না। আমরা নির্বাচন কমিশনকে যতই গালাগাল করি, এটাই বাস্তবতা। নির্বাচন বর্তমান সরকারের অধীনে হবে নাকি সহায়ক সরকারের অধীনে হবে; সে সিদ্ধান্ত তো রাজনৈতিক। এখানে নির্বাচন কমিশনের কিছুই করার নেই। সংবিধান সংশোধন করা হবে কী হবে না, সে সিদ্ধান্তও রাজনৈতিক। নির্বাচন কমিশনের মূল দায়িত্ব যথাসময়ে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে একটি নিরপেক্ষ, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করা। আর ২০১৮ সালের শেষে নির্বাচনের জন্য এখন থেকেই নির্বাচন কমিশনকে প্রস্তুতি শুরু করতে হবে। নির্বাচন কমিশন সে কাজটিই গুছিয়ে করেছে। নির্বাচন কমিশন তাদের রোডম্যাপে সাত দফা কার্যক্রম ঘোষণা করেছে- ১. আইনি কাঠামো পর্যালোচনা ও সংস্কার, ২. নির্বাচন প্রক্রিয়া সহজীকরণ ও যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সবার পরামর্শ গ্রহণ, ৩. সংসদীয় এলাকার সীমানা পুননির্ধারণ, ৪. নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও সরবরাহ, ৫. বিধি-বিধান অনুসরণপূর্বক ভোটকেন্দ্র স্থাপন, ৬. নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন এবং নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিরীক্ষা ও ৭. সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট সবার সক্ষমতা বাড়াতে কার্যক্রম গ্রহণ। নির্বাচনটি কেমন হবে, সেটা তো এখনই বলা যাবে না, তবে নির্বাচন করতে হলে এই কাজগুলো করতেই হবে। নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন এবং সীমানা পুননির্ধারণ ছাড়া তো নির্বাচন করা সম্ভব নয়। আর এই কাজগুলোর জন্য তো নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে না। ধরে নিচ্ছি, মির্জা ফখরুলের কথা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন রোডম্যাপ ঘোষণা করলো না, অপেক্ষা করলো রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য। আর সেই সমঝোতা হলো নির্বাচনের চার মাস আগে। তখন চার মাসের মধ্যে কি নির্বাচন কমিশন অতি আবশ্যক কাজগুলো শেষ করতে পারবে?

তবে খেলার জন্য যেমন সমান মাঠ দরকার, নির্বাচনের জন্যও দরকার। খেলায় সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে অর্ধেক গেলে প্রান্ত বদল করা হয়। তাই তো নির্বাচন এলেই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। যদিও নির্বাচনের এখনও প্রায় দেড় বছর বাকি, তবুও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আছে কিনা? এই প্রশ্নটি ঘুরেফিরে আসছে। এই প্রশ্নের উত্তর হলো, নেই। সরকারি দল আওয়ামী লীগ অনেক আগেই নির্বাচনি প্রচারণা শুরু করে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী প্রায় সব আয়োজনেই নৌকার পক্ষে ভোট চাইছেন। এমনকি রাষ্ট্রীয় সুবিধা নিয়ে ঢাকার বাইরে গিয়েও তিনি নৌকার পক্ষে ভোট চাইছেন। শেখ হাসিনা যেমন প্রধানমন্ত্রী, একই সঙ্গে তিনি আওয়ামী লীগের সভানেত্রীও। তাই নৌকার পক্ষে তার ভোট চাওয়াটা অন্যায় বা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু প্রশ্নটা হলো, অন্য সব দল তাদের মার্কার পক্ষে ভোট চাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে কিনা? বাস্তবতা হলো পাচ্ছে না। গত সপ্তাহে জেএসডি নেতা আ স ম আব্দুর রবের বাসায় কয়েকটি রাজনৈতিক দলের এক বৈঠকে পুলিশ বাধা দিয়েছে। বিএনপি তো অনেকদিন ধরেই ঢাকায় কোনও সমাবেশ করার অনুমতি পাচ্ছে না। সমাবেশ তো অনেক পরের কথা, বিএনপি নেতাকর্মীরা আসলে ব্যস্ত আদালতের বারান্দায়। বেগম খালেদা জিয়া, মির্জা ফখরুলসহ অনেকের বিরুদ্ধে অনেক মামলা আছে। বিএনপির কেউ অপরাধ করলেও ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ এর অজুহাতে কারো বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না, এমন সরলীকরণে আমি বিশ্বাসী নই। কিন্তু চারবছর আগের নাশকতার ঢালাও মামলায় বিএনপি লাখ লাখ নেতাকর্মীকে হয়রানি করা হচ্ছে, এটা তো সত্যি। তাই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে হলে, বিএনপি নেতাকর্মীদের হয়রানি বন্ধ করতে হবে। তাদের সভা-সমাবেশ করে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরার সমান সুযোগ দিতে হবে। স্বভাবতই রোডম্যাপ ঘোষণার অনুষ্ঠানেও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের প্রশ্নটি এসেছিল।

কিন্তু সিইসি সেই অনুষ্ঠানে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করার এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের নেই বলে জানিয়ে দিয়েছেন। কাগজে-কলমে হয়তো প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্য ঠিকই আছে। কিন্তু দায়িত্বশীল পদে বসে সব কথা সমানভাবে বলা যায় না। স্মরণ করুন, বিএনপির সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী বাবার কোলে থেকে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত নওশিনের পরিবারকে সান্তনা জানাতে গিয়ে বলেছিলেন, আল্লাহর মাল আল্লা নিয়ে গেছেন। আমরা কিন্তু কাউকে সান্তনা জানাতে গেলে এই কথাগুলো বলি। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চেয়ারে বসে এই কথা বলা যায় না। দুদিন আগে ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হক বলেছিলেন, তিনি ঘরে ঘরে মশারি খাটিয়ে দিয়ে আসতে পারবেন না। সত্যিই তো মেয়রের পক্ষে তো নগরবাসীর ঘরে ঘরে গিয়ে মশারি খাটাতে পারবেন না। কিন্তু এই মন্তব্য করে আনিসুল হক সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন এবং পরদিন তাকে দুঃখপ্রকাশ করতে হয়েছে। তাই কিছু কিছু পদ আছে, সেখানে বসে সব কথা সোজাসাপ্টা বলা যায় না। কিছুটা কৌশলী হতে হয়। ধরে নিচ্ছি, প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্যই ঠিক। তাহলে তফসিল ঘোষণার আগে পর্যন্ত কী হবে? আওয়ামী লীগ অবাধে ভোট চেয়ে যাবে, আর বিএনপি মামলার দৌড়ের ওপর থাকবে; এটা যদি চলতে থাকে, তাহলে নির্বাচন কিভাবে অবাধ হবে?

তফসিলের তিনমাসে কি নির্বাচন কমিশন তার আগেই পিছিয়ে থাকা বিএনপিকে এই গ্যাপটি মেটানোর সুযোগ দিতে পারবেন। তফসিলের তিনমাস সমান সুযোগ নিশ্চিত করা হলেই তো আর লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হলো না। এখন যে প্রচারণায় আওয়ামী লীগ এগিয়ে থাকছে, বিএনপি প্রতিনিয়ত পিছিয়ে যাচ্ছে; এটা কিভাবে লেভেলে আসবে? খেলা শুরুর আগে প্রতিপক্ষের প্লেয়ারের পা ভেঙে দিলে খেলার মাঠ যতই লেভেল হোক, তার পক্ষে জেতা সম্ভব নয়। তাই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হতে হবে সারাবছরের, শুধু নির্বাচনের তিন মাস সময়ের নয়। তফসিল ঘোষণার আগে নির্বাচন কমিশনের কিছু করার নেই, এটা যেমন সত্যি, আবার এটাও তো সত্যি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো নিবন্ধন নেয় নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে, নির্বাচন কমিশনের কাছে তারা হিসাব-নিকাশ দেন। তাই কোথাও বঞ্চিত হলে তারা তো নির্বাচন কমিশনের কাছেই প্রতিকার চাইবে। নির্বাচন কমিশন যদি অসহায় আত্মসমর্পণ করে বসে থাকেন, তাহলে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো কই যাবে? আর নির্বাচন কমিশন তো শুধু তফসিলের তিনমাসের জন্য নিয়োগ পান না। তারা পাঁচবছরের জন্য নিয়োগ পান। তাই তাদেরকে নজরদারি করতে হবে সবসময়ই। আইনে না থাকলেও তারা তো সরকারের কাছে সব রাজনৈতিক দলের জন্য সমান সুযোগ দেওয়ার অন্তত অনুরোধ করতে পারে। একদম হাত পা গুটিয়ে তফসিলের জন্য বসে থাকলে তো নির্বাচন কমিশনের ওপর কারো আস্থা থাকবে না।

নির্বাচন কমিশনের কাজ তো নির্বাচন পরিচালনা করা। কিন্তু নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ করার মূল কাজ রাজনৈতিক দলগুলোর। তারা যদি আন্তরিকতা নিয়ে, সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসে তাহলেই শুধু সম্ভব সব জটিলতা নিরসনের, প্লেয়িং ফিল্ডকে সত্যিকারের লেভেল করা।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

probhash2000@gmail.com