নিখোঁজ প্রধান শিক্ষক

তুষার আবদুল্লাহসাংগঠনিক কাজে স্কুল-কলেজে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে। আমাদের সংগঠনের যে কাজ তাতে  প্রতিষ্ঠান প্রধানের সম্মতি বা অনুমোদনের প্রয়োজন পড়ে। প্রতিষ্ঠান প্রধান বলতে আমরা প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষকেই জানি। এই জানাটিই সঙ্গত। কিন্তু মাঠে কাজ করতে গিয়ে দেখছি আমাদের জানা এবং বিশ্বাসের বিষয়টিই অসঙ্গত। আমরা হয়তো ভুল জেনে এসেছি। সংগঠনের যে কাজ সেটি বিদ্যায়তন প্রধানের হয়তো পছন্দ হলো, তিনিও চান তার শিক্ষার্থীরা এমন সৃজনশীল কাজের সঙ্গে যুক্ত হোক। কিন্তু তিনি চাইলেই ওই কার্যক্রমকে তার বিদ্যায়তনে স্বাগত জানাতে পারছেন না। তাকে মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয় গভর্নিং বডি’র। সেখানকার সবুজ সংকেত না পেলে তিনি কোনও কাজেই 'হ্যাঁ' বলতে পারেন না। অনেক প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষ বিষয়টি নিজেদের কাঁধে না নিয়ে সরাসরি গভর্নিং বডি'র কাছে তুলে দেন।
গভর্নিং বডি’র যে কোনও সদস্যকে পটাতে পারলেই বিদ্যায়তনে সংগঠনের কাজ স্বচ্ছন্দে করা যাচ্ছে। আমরা দুই- একটি ক্ষেত্রে শতভাগ বিদ্যায়তন প্রধানের ওপর নির্ভর করায়, গভর্নিং বডি তাতে মনক্ষুন্ন হয়েছে, ফলে ওই বিদ্যায়তনের চৌকাঠ পেরোতে পারিনি আমরা। এই অভিজ্ঞতা অবশ্যই বেসরকারি বিদ্যায়তনে। সরকারি বিদ্যায়তনে প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষের স্বাধীনতা এখনও অক্ষুন্ন আছে। দুই একটি ক্ষেত্রে হয়তো আঞ্চলিক উপ-পরিচালক শিক্ষার ছড়ি ঘুরানোর প্রতাপ এবং প্রভাব আছে। আবার বিভিন্ন সংস্থা বা বিভাগের অধীনে যে বিদ্যায়তনগুলো আছে সেখানেও দেখতে পেয়েছি বেশিরভাগ প্রধান শিক্ষকরা কত পরাধীন। কত অসহায়। ওই সংস্থা বা বিভাগের মধ্যম বা তারচেয়ে নিচের কর্মকর্তার দাপটে প্রধান শিক্ষকরা নিজের মতো করে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। প্রধান শিক্ষক এসব বিদ্যায়তনে সামান্য গোবেচারা কর্মচারি হয়েই আছেন।

আমরা যখন চৌকাঠ পেরোনোর অনুমতি পাই, তখন কোনও আনুষ্ঠানিকতাতেই আর প্রধান শিক্ষককে পাওয়া যায় না। কোনও আয়োজনে উদ্বোধনী বা সমাপনী পর্বের সভাপতিত্ব দূরে থাক, মঞ্চের কাছাকাছি আসা কিংবা অনুষ্ঠানস্থলে আসার ডাক পান না তিনি। প্রধান শিক্ষক নিজে থেকে অনুষ্ঠানস্থলে আসবেন সেই দুঃসাহসটি চাকরি ও জীবিকার প্রয়োজনে তার পক্ষে দেখানো সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই এমন অনেক আয়োজন আছে যেখানে প্রধান শিক্ষককে আমন্ত্রণ জানাতে গিয়ে আমাদের বিব্রত হতে হয়েছে। বিব্রত হয়েছেন সম্মানিত সেই শিক্ষকও। এই আচরণ বেসরকারি ও বিভিন্ন বিভাগের আওতাধীন বিদ্যায়তনের বেলাতেই ঘটেছে। কারণ গভর্নিং বডি’র প্রতাপশালী সদস্যদের সামনে দাঁড়ানোর প্রশস্ত বুক এবং মেরুদণ্ড এখন আর শিক্ষকদের মাঝে অবশিষ্ট নেই।

অভিযোগ, অনুযোগ শিক্ষার মান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মেধাবীরা শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিচ্ছে না। বিশেষ করে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে তো নয়ই। এই তিন স্তরের শিক্ষকতা এমনতেই স্বল্প সম্মানীর। বাজারের অন্য চাকরি জুটাতে না পেরে অনেকে বাধ্য হয়েই এই পেশায় আসেন। এখানে চাকরি জুটাতে গিয়ে তাদের গোড়াতেই গভর্নিং বডি'কে নানা ভাবে তুষ্ট রাখতে হয়। চাকরি জুটলে তা রক্ষার জন্যও তোষণ না করে উপায় থাকে না। তোষণ না করার পরিণাম কী হয়- তার সাম্প্রতিক কিছু নজির রাষ্ট্র দেখেছে। যেখানে প্রধান শিক্ষককে কান ধরে ওঠবস করতে হয়, সেখানে গভর্নিং বডি'র সামনে মঞ্চে ওঠার দুঃসাহস দেখাবেন কে?

অথচ আমরা দেখেছি পুরো বিদ্যায়তন ওঠবস করছে প্রধান শিক্ষকের নির্দেশনায়। প্রধান শিক্ষকের মেধা ও ব্যক্তিত্বের কাছে অন্যান্য শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরাই শুধু নয়, প্রভাবশালী অভিভাবকরাও কতটা নতজানু ছিল। কোনও কোনও এলাকা আলোকিত করে রাখতেন প্রধান শিক্ষকেরা। সেই আলো নিভে গেছে গভর্নিং  বডি'র ছুঁড়ে দেওয়া ঢিলে। আমাদের পরিচিত প্রধান শিক্ষকরা লজ্জায় অপমানে হয়তো স্বেচ্ছায় নির্বাসনে গেছেন। বিদ্যায়তনে অবস্থান করেও কোনও প্রধান শিক্ষক তার ব্যক্তিত্বকে কী পুরনো কোনও আলমিরাতে লুকিয়ে রেখেছেন? আমরা যদি কেবল শিক্ষার গাণিতিক হিসেবে তুষ্ট না থাকি, চাই মান সম্মত শিক্ষা, সত্যিকারের সুশিক্ষা, তবে অবশ্যই শিক্ষকের সম্মানকে ফিরিয়ে আনতে হবে। শিক্ষার বাতি জ্বালানোর দিয়াশলাই রাজনৈতিক প্রভাবে তপ্ত কোনও গভর্নিং বডি'র  হাতে নয়, রাখতে হবে শিক্ষকের কাছেই। আর এই কাজটির জন্য বিদ্যায়তনগুলোতে আমরা ফিরে পেতে চাই পরিচিত সেই প্রধান শিক্ষকদের। আসুন আমরা সবাই এক যোগে তাদের স্বাগত জানিয়ে বলি- স্যার, ম্যাডাম আপনারা ফিরে আসুন। আলো জ্বালান, আমরা যে নিভে যাচ্ছি।

লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি