একটি স্বনামধন্য এবং ঐতিহ্যবাহী স্কুলের প্রধান শিক্ষক এই উত্তরপত্রের কথা জানালেন। তিনি জানান, নষ্ট পুকুরকে মজার পুকুর ভেবে বা জেনে লেখা এই আবেদনপত্রটি লিখে শিক্ষার্থী শিক্ষকের কাছ থেকে নম্বরও আদায় করে নিয়েছে। প্রায় দু্ই পাতার আবেদন দেখে শিক্ষক নম্বর দিয়ে দিয়েছেন। শিক্ষার্থী পাতা ভরে লিখেছে, এতেই শিক্ষক খুশি। কিন্তু ওই দুইপাতায় শিক্ষার্থী কী লিখলো, শিক্ষক তা পড়ে দেখেননি। এক শিক্ষার্থীর এই অবস্থা দেখে প্রধান শিক্ষক অবাক হননি। তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়েই বলেন- আমাদের শিক্ষকদের জ্ঞানের সীমাও একই পর্যায়ে নেমে আসছে। তার সঙ্গে আলোচনার সময় ওই স্কুলের অন্যান্য শিক্ষকও এসে যোগ দেন। তারাও জানালেন- নবম, দশম শ্রেণিতে সাধারণ গণিত পড়ানো, দেখানোর মতো শিক্ষক কমে আসছে। তাদের মতে, সাধারণের ধারণা ছিল যে শিক্ষার্থীরা অংকে দুর্বল তারা মানবিক বা বাণিজ্য শাখায় যাবে, তাদের জন্য উচ্চতর গণিত নয়। তারা অপেক্ষাকৃত সহজ সাধারণ গনিত পড়বে। কিন্তু এখন চলতি পাঠ্যক্রমে উচ্চতর গণিতের চেয়ে সাধারণ গণিতই কঠিন। এখানে পরিমিতি ও ত্রিকোনোমিতি যোগ হয়েছে। অংকে ভীতি আছে যাদের তাদের এই কঠিন গণিত কষেই মানবিক বা বাণিজ্য বিভাগে পড়তে হচ্ছে। মুশকিল হলো সৃজনশীল পদ্ধতির এই গণিত পড়ানো, দেখানোর শিক্ষক সুলভ নেই।
যে শহরের স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, সেই শহরের আরও কয়েকটি স্কুলে যাওয়ার সুযোগ হয়, সেখানেও শিক্ষকদের সঙ্গে আলাপ হয়। তাদের কথা- আমরা শিক্ষার ওপর একটি মাখনের প্রলেপ মেখে রেখেছি। বাইরে থেকে দেখে মনে হবে শিক্ষার ওপর তেমনই মেধার স্তর জমছে। আসল অবস্থা কিন্তু তা নয়। মাখনের নিচে পচন ধরেছে। ধরেছে ক্ষয়। তারা আফসোস করেই বললেন- শিক্ষার্থীরা এখন কোনও বিষয়ের সম্পূর্ণ পাঠ নিচ্ছে না। তারা সহজপাঠ বা গাইড থেকে ধারণা নিয়ে নিচ্ছে মাত্র। ওই ধারণা থেকেই উত্তরপত্র উৎরে যেতে পারছে তারা। বাংলা, ইংরেজি, সমাজ, বিজ্ঞান কোনও বিষয়েই বিস্তারিত পাঠ না করায়, শিক্ষা বা জ্ঞানের অপূর্ণতা থেকেই যাচ্ছে তাদের। শিক্ষার্থী, অভিভাবকরা দেখছে গাণিতিক হিসেবে কোনও বিষয় কত নম্বর উঠছে। একশ’র কাছাকাছি নম্বর পেয়েও শিক্ষার্থীর যে দুইআনা জ্ঞানও লাভ হলো না, এই বোধদয় তৈরি হচ্ছে না কারও। শিক্ষকরাও মূলবই থেকে বিচ্ছিন্ন। তারাও সহজপাঠ, গাইড-বই দেখে প্রশ্ন করছেন, উত্তরপত্র মেলাচ্ছেন, ফলে তারাও শ্রেণিকক্ষে গিয়ে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান বা শিক্ষার মূল সড়কে নিয়ে যেতে পারছেন না। তৈরি হচ্ছে না প্রয়োজনীয় উপযুক্ত শিক্ষক। শিক্ষকরাই বলছেন, এখন শিক্ষার পাঠ্যক্রম ও পাঠের যে অনুশীলন চলছে তাতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর জ্ঞানের আনুপাতিক তফাৎ কমে আসছে। এই লক্ষণটি কেবল মাধ্যমিকে নয়, উচ্চমাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষার বেলাতেও প্রযোজ্য। যা আতঙ্কের এবং সর্বনাশেরও। আতঙ্ক এই জন্য যে, এমনিতেই ইংরেজি, বাংলা, মাদ্রাসার মিশ্র মাধ্যমে শিক্ষা নিয়ে একটি প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে। এই শিক্ষা বাজারমুখি, বিদেশমুখি। মাতৃভাষা ও সংস্কৃতিচ্যুত এই শিক্ষা নিয়ে জাতির মেরুদণ্ড কখনোই সোজা হওয়ার কথা না, মেরুদণ্ড নেতিয়ে পড়ারই কথা। সেই নেতিয়ে পড়ার ভঙিমাটি স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকায় আতঙ্ক এবং সর্বনাশের ভয় কাউকে কাউকে আঁকড়ে ধরছে। যারা এখনও ভীত নন, তারা হয়তো অন্য প্রাণী। কোনও বিনাশেই তাদের চেতন হয় না, বোধহীন। এই বোধহীন সম্প্রদায়ের সংখ্যাগরিষ্ঠতাও আতঙ্কের আরেক কারণ বটে।
লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি