সুখের কথা হলো, আমরা বুঝতে পেরেছি, আমাদের পুষ্টির ঘাটতি আছে। এই পুষ্টিকে পুঁজি করে বেশিদূর এগুনো যাবে না। তাই পুষ্টির স্বয়ংসম্পূর্ণতার জন্য পথে নেমেছি।
আমাদের কাছে মনে হয়েছে, পুষ্টির ঘাটতি জলদি মেটানোর বড় হাতিয়ার হতে পারে ডিম। এক সময় এই ডিমকে আমরা ভয় পেয়েছি। ডিমে কোলেস্টেরল আছে বলে প্রচার-প্রোপাগান্ডা চালাতেন আমাদের চিকিৎসকরা। তাই ডিম থেকে দূরে রাখা হতো আমাদের; বিশেষ করে যারা হৃদরোগের ঝুঁকিতে আছেন। আমরা কত পুষ্টি বা শক্তি যে অপচয় করেছি, তারই প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে এখন আমাদের। সাদা অংশটি খেয়ে এই সেদিনও আমরা কুসুম ফেলে দিতাম। এখন চিকিৎসকরা ভোল পাল্টেছেন, বলছেন কোলেস্টেরল কমানোর বড় অস্ত্রই নাকি ডিম। শরীরের জন্য আরও অনেক উপকারী উপকরণ লুকিয়ে আছে ডিমে। তাই রাষ্ট্রীয়ভাবে, আন্তর্জাতিকভাবে এখন ডিম নিয়ে মাতামাতি। ডিম নিয়ে রসিকতার দিন শেষ। ডিম খেলে ফল হবে ডিম্ব, এখন এমন বলা যাবে না। বরং ফল পেতেই ডিমের ওপর ভরসা রাখতে হচ্ছে।
রাষ্ট্রও জাতির দুর্দিনে পাশে এসে দাঁড়াতে চেয়েছে। ডিমকে করতে চেয়েছে সুলভ। পোল্ট্রি বাণিজ্যের বিশ্বায়নের অংশ হিসেবে পালন করেছে ডিম দিবস। সেই দিবসে ঘোষণা ছিল এক লাখ ডিম বিতরণের। প্রতিটি ডিম মাত্র তিন টাকা দরে। উদ্যোক্তরা ভেবেছিলেন, আতপ চালের ভিড়ের মতোই নাতিদীর্ঘ লাইন হবে ক্রেতাদের। তাই হয়তো আয়োজনটি সে রকমই ছিল। তারা বুঝতে ভুল করেছেন, মানুষ এখন ভাতের ওপর চাপ কমাতে চায়। অতি ভাত ভক্ষণে খরচ বেশি। অতি ভাতে মস্তিষ্ককে আলসেমি ধরে। তার চেয়ে ডিম ভালো। ছোট্ট একটা ডিম খেয়ে নিলে মস্তিষ্ক চাঙ্গা। ব্যস ভাতে থাকো দেশ নিয়ে, পৃথিবী নিয়ে। কোনও তথ্যের হিসাবে গরমিল তো হবে না। সঙ্গে জ্ঞানের চর্চাটাও হবে তুখোড়। আর শরীর, সে তো ফিটফাট। তাই শহরের মানুষ নেমে এসেছিল তিন টাকা মূল্যের ডিমের আশায়। কতদিকেই তো খরচ বাড়ছে, টাকা চারেক বাঁচিয়ে যদি একটি বেশি ডিম মেলে। লাখ লাখ মানুষ ভিড় জমায় সেই ডিমের স্বপ্নে। কিন্তু শেষমেষ দেখা গেলো, ডিমের সাদা বা বাদামি শরীরে সোনালি রঙ ধরলো। তিন টাকার ডিম চলে গেলো নাগালের বাইরে। জনতা এই প্রহসন মেনে নিতে পারেনি। ডিমের দাবিতে হয়েছে বিক্ষোভ, পুলিশের লাঠিচার্জ। ডিম নিয়ে দাঙ্গা-ফ্যাসাদ। কিন্তু তিন টাকার ডিম? জনমানুষের অসংখ্য চাওয়া-পাওয়ার মতোই অধরাই থেকে গেলো।
জনমানুষ এই অপুষ্টির জন্যই ধরতে পারেন না রাষ্ট্রের এক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অন্য প্রতিষ্ঠানের বিরোধ। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে রাষ্ট্রের কোনও কোনও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের দূরত্ব। এই বিরোধ ও দূরত্বের জন্য যে নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সেই বোধটুকুও হারিয়ে বসে আছে জনগণ। বরং যে যেভাবে রাষ্ট্র সম্পর্কে, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান ও তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়ে ধারণা দেয়, জনগণ তাই মেনে নেয়। পুষ্টিহীনতায় ভোগা জনগণ হারিয়ে বসেছে তার অধিকার নিয়ে সোচ্চার হওয়ার সামর্থ্যটুকুও। জনগণকে সেই অক্ষমতা থেকে বের করে আনার জন্য যে ‘ডিমতত্ত্ব’ প্রয়োগের চেষ্টা হয়েছিল, সেটি নিপুণ হাতে, পরিকল্পিত ও নেক মনে হয়নি বলেই ঘটলো ডিম বিস্ফোরণ।
লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি