রাস্তায় ট্রাফিক আইন অমান্য করেছে। আদালতে মামলা হলো। তড়িৎ গতিতে তার বিচারও হলো। আমাদের দেশে কি এটা সম্ভব? আমেরিকার ঘটনাটি ভাবুন তো একবার। বিচার ব্যবস্থার প্রতি কি শ্রদ্ধা সবার। সেই শিশুটির কথা একবার ভাবুন– অবলীলায় সে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলো। আমাদের দেশে, আমাদের শিশুদেরকে কি আমরা এইভাবে তৈরি করতে পারছি? বাবা-মা অন্যায় করেছে কোনও ছেলে-মেয়ের সাহস হবে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার? অথচ অন্যায় তো অন্যায়ই... এই শিক্ষা কি আমাদের শিশুদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে?
শহরের ভেতরে গাড়ি চালানোর স্পিড লিমিট ২৫ কিলোমিটার। সেটা ভঙ্গ করার অপরাধে শাস্তি পেলো আমেরিকার গাড়ি চালক। আর আমাদের দেশে কিসের স্পিড লিমিট? কিসের কী? গাড়ি আমার। কাজেই আমার ইচ্ছা মতো আমি গাড়ি চালাবো। আপনি বলার কে? বিশেষজ্ঞদের মতে, সড়ক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সরকার বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও একাধিক কারণে তা কাজে আসছে না। কারণ গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো– সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে সরকারের পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ধীর গতি, অনেক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে পরিবহন মালিক শ্রমিক সংগঠনগুলোর বিরোধিতার পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সীমাহীন দুর্বলতা। অথচ কে না জানে একটি দেশ কতটা সভ্য, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কতটা ভালো তা দেশটির যে কোনও শহর কাঠামো বিশেষ করে রাস্তা ঘাটের পরিবেশ দেখলেই বুঝে নেওয়া যায়। বাংলাদেশের কোনও শহরেই কি এরকম পরিবেশ আছে? স্পিড লিমিটের কথা না হয় বাদই দিলাম, প্রকাশ্য দিবালোকে পথচারীকে চাপা দিয়ে গেলো কোনও যান-বাহন, পথচারীর মৃত্যু হলো। এমন পরিস্থিতিতে কি দোষী ব্যক্তির সাজা হয়? এসব কথা ভেবে আমেরিকার সেই ছোট্ট শিশুটির কাছে নিজেদেরকে খুবই তুচ্ছ মনে হচ্ছে। সে তার বাবাকেও অপরাধী বলার নৈতিক শিক্ষা অর্জন করেছে। সেখানে নিজ দেশে আমরা বড়রা বরং সত্যকে অবলীলায় গোপন করি। যেনো সত্যকে গোপন করতে পারাটাই বড় যোগ্যতা।
এখন প্রশ্ন হলো– সত্যটা শেখাবে কে? সহজ উত্তর পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অথচ আমাদের দেশে দুটি ক্ষেত্রেই নাজুক পরিস্থিতি। নীতি, নৈতিকতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ের বৈষম্য দিনে দিনে প্রকট হয়ে উঠছে। ফলে মূল্যবোধের অবক্ষয়ে সমাজ কাঠামো ভেঙে পড়ছে। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?
জাতীয় একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে দেখলাম গত ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২২৮ দিনে সারাদেশে মোট ১ হাজার ৪৮১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২ হাজার ১১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। আরেকটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনে দেখলাম সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে বাংলাদেশের গড়ে আর্থিক ক্ষতি হয় ৪০ হাজার কোটি টাকা। ভাবুন তো একবার কী ভয়াবহ পরিস্থিতি। দুর্ভাগজনক হলেও সত্য এই সহস্রাধিক দুর্ঘটনায় এতো মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটলো অথচ এর কোনও বিচার হয়নি। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত অসহায় এই মানুষগুলোর অনেকেই কোনও না কোনও পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম সদস্য ছিলেন। তাদের আয়-রোজগারের ওপরই পরিবারের সদস্যদের ভরন, পোষণ, লেখাপড়া, চিকিৎসা ব্যয় সহ সবকিছুই চলত। এখন তারা নেই। অসহায় পরিবারগুলোর কথা ভাবুন তো একবার। কেমন আছে পরিবারগুলো? কেউ কি তাদের খোঁজ-খবর রাখেন? এমন যদি হতো অব্যাহত সড়ক দুর্ঘটনার সুষ্ঠু বিচার হচ্ছে। দোষী ব্যক্তিরা শাস্তি পাচ্ছে। তাহলেও না হয় ভরসার একটা জায়গা খুঁজে পাওয়া যেতো।
তাহলে সারাংশে কী দাঁড়াচ্ছে– সারাদেশে এভাবেই সড়ক দুর্ঘটনায় অসহায় মানুষের মৃত্যুর মিছিল বাড়তেই থাকবে? আজ ২২ অক্টোবর রবিবার সড়ক নিরাপত্তা দিবস। পত্র-পত্রিকায় দিবসটির গুরুত্ব তুলে ধরে একাধিক রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে। জানি না এতে কার কী লাভ হবে? আবারও যুক্তরাষ্ট্রের সেই শিশুটির কথা মনে পড়ছে। কী অবলীলায় সে সত্য প্রকাশ করলো। সত্য প্রকাশে সে তার বাবাকে ছাড় দিলো না। সত্য প্রকাশে এমনই সাহসী মানুষ চাই। সাহসী মানুষ...
লেখক: নাট্যকার, সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক ও সম্পাদক, আনন্দ আলো।