X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রামের শহর যাত্রা...

রেজানুর রহমান
২৩ মার্চ ২০২৪, ১৩:০৩আপডেট : ২৪ মার্চ ২০২৪, ১৮:৫০

একটা টেলিভিশন সেট দরকার। এলইডি টেলিভিশন সেট। কোথাও নেই। আশপাশের বাড়ি থেকে খুঁজে এসে আমার এক সহকর্মী জানালেন, এলাকার মানুষজন এখন আর আগের মতো টেলিভিশনে অনুষ্ঠান দেখেন না। সবার হাতে মোবাইল ফোন। মোবাইল ফোনে টেলিভিশন অনুষ্ঠান দেখে। অথচ একসময় একটি টেলিভিশন সেট ছিল যেকোনও পরিবারের অনেক আগ্রহ ও আনন্দের জায়গা। কোনও পরিবারে টেলিভিশন সেট আসা মাত্রই ওই পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি আশপাশের পরিবারেও আনন্দের বন্যা বয়ে যেত। পাড়া, প্রতিবেশী আগ্রহ ভরে নতুন টেলিভিশন সেট দেখতে আসতেন। নিজেদের টেলিভিশন সেটের সঙ্গে মিলিয়ে ‘ছোট-বড়’ মন্তব্য করতেন। টেলিভিশন সেটটি ঢেকে রাখার জন্য বিশেষ কাপড়ের ব্যবস্থা করা হতো। অনেকে রঙিন সুতা দিয়ে সাদা কাপড়ে ফুল, ফল, নদী, মাছ, লতা পাতার ছবি এঁকে টেলিভিশন সেট খুব যত্ন করে ঢেকে রাখতেন। সকাল-সন্ধ্যা-রাত্রি ঘুমাতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত টেলিভিশন সেটটিকে ঘিরেই পরিবারের সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। পরিবারের যে যেখানেই থাকুক না কেন একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সবাই টেলিভিশন সেটটির সামনে হাজির হতেন। একসঙ্গে অনেক আগ্রহ নিয়ে টেলিভিশনে অনুষ্ঠান দেখতেন। সেই অনুষ্ঠান নিয়ে হয়তো তুমুল আলোচনা হতো পরিবারের সদস্যদের মধ্যে।

নাটক নিয়েই মূলত আলোচনা বেশি হতো। কে কেমন অভিনয় করেছে, কার অভিনয় ভালো ছিল, কার অভিনয় জমেনি? এমন আরও অনেক বিষয় শুধু বাসাবাড়িতেই নয়, অফিসে আদালতেও কাজের ফাঁকে ফাঁকে আলোচনা হতো। সেই টেলিভিশন সেট এখন অনাগ্রহের বিষয়।  

আমার এক সহকর্মী অনেক খুঁজে চারকোনা আকারের একটি পুরনো টেলিভিশন সেট নিয়ে এলো। কিন্তু আমার প্রয়োজন এলইডি টেলিভিশন। নাটকের একটি চরিত্র টেলিভিশনে খবর দেখবেন। পুরনো টেলিভিশন সেট তো এখন আর কেউ ব্যবহার করেন না। কিন্তু আমার ধারণা ভুল। বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রাম আর এখন সেই গ্রাম নেই। শহরের বাতাস পেয়েছে গ্রামগুলো। শহর হয়ে ওঠার প্রাণান্তকর চেষ্টা প্রতিটি গ্রামের। হ্যারিকেন, হ্যাজাগ বাতি, কুপির আলোকে সরিয়ে দিয়ে প্রায় প্রতিটি গ্রামে বৈদ্যুতিক বাতির ঝলসানো আলো। শহরের অনেক সুবিধা এখন গ্রামেও পাওয়া যায়। কিন্তু গ্রামগুলো শহর হওয়ার প্রতিযোগিতায় একটু যেন খেই হারিয়ে ফেলছে। গ্রামীণ বলে কিছুই যেন থাকছে না।

কালিগঞ্জ এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী একটি গ্রামে আমার ঈদের নাটকের শুটিং করতে এসেছি। ২০ বছর আগে এই এলাকায় একবার শুটিং করতে এসেছিলাম। তখনকার দিনে গ্রামটি ছিল অনেক সুন্দর। দিগন্তজুড়ে ফসলের মাঠ ছিল। বাড়ি ছিল অনেক কম। আর এখন ফসলের মাঠ হারিয়ে গেছে। শুধুই বাড়ি আর বাড়ি। রাস্তার পাশে হোটেল, রেস্তোরাঁ আর গেরস্থালি পণ্যের দোকান, সেলুন, কম্পিউটার শেখার ছোট ছোট দোকান। আড্ডাবাজ মানুষের সংখ্যাই বেশি। সবার হাতে মোবাইল ফোন। চায়ের দোকানের সামনে তুখোড় আড্ডার সঙ্গে চায়ের কাপে ঝড় তোলেন অনেকে। ২০ বছর আগে এমনটা দেখিনি। ২০ বছর পর একটা বদল তো আশা করাই যায়। তাই বলে বদলের চিত্রটা এমন হবে আমি আশা করিনি। আশা করিনি শীতলক্ষ্যার মতো খরস্রোতা একটি নদীকে গিলে খাবে ইটের ভাটা। নদীটি যেন মরা খালের চেহারা পেয়েছে। কোথাও কোথাও নদীর বুকে বড় বড় ভবন উঠেছে। মনে হলো অচিরেই হয়তো মরা খালটিও হয়তো থাকবে না। তখন হয়তো ওই গানটির কথাই মনে পড়বে– এই খানে এক নদী ছিল জানলো না তো কেউ।

শুটিংয়ের প্রয়োজনে রাত্রিবাস ওই গ্রামে। রাস্তার পাশের দোকানগুলো অনেক রাত পর্যন্ত খোলা থাকলো। নামাজের সময় দেখলাম একসঙ্গে তিনদিক থেকে আজান হচ্ছে। ভোরেও তিনদিক থেকে পবিত্র আজানের শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো। আজান শেষে এলাকার একজন বিশিষ্ট ব্যক্তির মৃত্যুর সংবাদ প্রচার করা হলো। এরপর প্রচার করা হলো– আপনার সন্তানকে দ্রুত মক্তবে পাঠান এই ঘোষণা। বারবার এই ঘোষণা তিনটি মাইকেই শোনা গেলো। মাইকের এই ঘোষণা শুনে মনে হলো সারা দেশে মসজিদকে কেন্দ্র করে একটি নয়া জাগরণ দেখা দিয়েছে।

সম্মানিত ব্যক্তিটির মৃত্যুর সংবাদটি নিমিষেই এলাকার মানুষ জেনে গেলো। আপনার সন্তানকে দ্রুত মাদ্রাসায় পাঠান, এই ঘোষণা শুনেও মনটা আনন্দে ভরে গেলো। কিন্তু পাশাপাশি আমার খুব শুনতে ইচ্ছে করছিল– আপনার সন্তানকে নিয়মিত স্কুলে পাঠান এই ঘোষণাটিও। কারণ মসজিদ কেন্দ্রিক সংবাদ প্রচারের এই প্রক্রিয়াটি দেশের প্রতিটি এলাকায় বেশ সরব। শুধু ধর্মীয়ভাবে এটিকে ব্যবহার না করে, ন্যায়-নীতি শিক্ষায়ও ব্যবহার করা যেতে পারে। ধর্মে সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে কোনও বিধিনিষেধ নেই। কাজেই মসজিদের এই মাইকগুলো নামাজ, মক্তব, মাদ্রাসার কথা বলার পাশাপাশি স্কুলের কথা যদি প্রচার করে তাহলে কী ধর্মের কোনও ক্ষতি হবে?

জানি না কে কীভাবে বিষয়গুলোকে বিশ্লেষণ করবেন। দেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে ভোরের পরিবেশ দেখে অনেক জিজ্ঞাসার জন্ম হয়েছে। বাংলাদেশের গ্রাম এখন আর সেই গ্রাম নাই। অনেক বদলে গেছে। মসজিদ-মাদ্রাসার ব্যাপক ভূমিকা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এটি ভালো লক্ষণ। কিন্তু আমরা কী সুকৌশলে দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতিকে ভুলে যাওয়া, অথবা ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি?

কিছু কিছু উদ্যোগ দেখে খুব অবাক লাগে। একটি পরিবারের কথা জানি। তিন ছেলে-মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় চিকিৎসক হয়েছেন। মেজ ছেলে মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে আলেম হয়েছেন। ছোট মেয়ে পড়ে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। তিন ভাই-বোনের মধ্যে নীতিগত ভাবনার বিরাট ফারাক। কেউ কাউকে মানতে চাইছে না। সারা দেশের একই অবস্থা। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় গড়ে ওঠা শিক্ষার্থীরা মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের তেমন একটা পাত্তা দিতে চায় না। অন্যদিকে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় গড়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের এড়িয়ে চলে। মসজিদ কেন্দ্রিক যে সংস্কৃতি গড়ে উঠছে সেখানে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্ব নেই বললেই চলে। আমি জানি না এই বৈপরীত্য একটি দেশের অগ্রযাত্রায় কতটা সুফল বয়ে আনবে। তবে এটুকু বুঝি এমন বৈপরীত্য দেশের জন্য সুখকর নয়।

লেখাটি শেষ করি। তুষের আগুন সম্পর্কে কার কী ধারণা আমি জানি না। তুষের আগুন ভেতরে ভেতরে পোড়ায়। সেটা সহজে দেখা যায় না। যখন দেখা যায়, বোঝা যায়, তখন কিছুই করার থাকে না। আমরা যেন শিক্ষাদীক্ষা ও সামাজিক অগ্রগতি অগ্রযাত্রার ক্ষেত্রে তুষের আগুন অতিক্রম করছি। এটি মোটেই শুভ লক্ষণ নয়। ‘আকালমান্দ কে লিয়ে ইশারাই কাফি হে...’

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
যাত্রাবাড়ীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
যাত্রাবাড়ীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
শেখ জামালের জন্মদিন আজ
শেখ জামালের জন্মদিন আজ
জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস আজ
জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস আজ
উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় আরও ৩ নেতাকে বহিষ্কার বিএনপির
উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় আরও ৩ নেতাকে বহিষ্কার বিএনপির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ