ভাই যাবেন?
কোথায়?
প্রেসক্লাব।
চলেন।
মিটারে যাবেন তো?
মিটারের কথা বলা যেন অন্যায়। পাঁচ জনই মিটারের কথা শুনে চরম বিরক্তি দেখিয়ে চলে গেলেন।
এবার এলো আরেকটি অটোরিকশা। চালক বেশ বয়স্ক। ভাবলাম এই লোক নিশ্চয়ই নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন। নিশ্চয়ই মিটারে ভাড়া যাবেন। ওমা তিনি দেখি মিটারের ব্যাপারে আরও বেশি ক্ষুব্ধ। তার ওপর প্রেসক্লাবের দিকে যাব শুনে চরম বিরক্তি প্রকাশ করলেন। এত কম দূরত্বে গিয়ে পোষাবে না। কেন পোষাবে না? প্রশ্ন করেও জবাব পাওয়া গেলো না। ততক্ষণে তিনি অটোরিকশা চালিয়ে চলে গেছেন। এরপর যারা এলো প্রায় সবারই একই আচরণ। মিটারে যেতে চরম অনীহা। একজন তরুণ ড্রাইভার তো মারমুখী হয়ে উঠলেন–আমি মিটারে যাব না। যান আপনার যা খুশি করেন। অন্য একজনকে পুলিশের কথা বলতেই বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন–ডাকেন পুলিশকে। দেখি আমার কী করে? পুলিশ রাস্তাঘাটে কী করে আমরা জানি না। আপনারা জানেন না?
প্রিয় পাঠক, ক্ষমা চেয়েই বলছি ওপরের এই ১৭টি অটোরিকশার ড্রাইভারের আচরণগত চিত্রই হয়তো এই কমিউনিটির আচরণ। কিন্তু রাজধানী শহরে একজন যাত্রীকেও কি পাওয়া যাবে যিনি অটোরিকশার সার্ভিস নিয়ে সন্তুষ্ট? মাঝে মাঝে যখন অটোরিকশা ড্রাইভারদের অনেকের মলিন চেহারা, করুণ, অসহায় মুখ আর ময়লা পোশাক দেখি তখন অবাক হই। এই যে আমরা যাত্রীরা তাদের ওপর এত বিরক্ত, তারা কি সেটা বোঝেন না? তারা মিটারে যেতে চান না। খেয়াল খুশিমতো সিএনজির ভাড়া হাঁকে। কাজেই তাদের তো প্রতিদিনই অনেক লাভ হয়। অথচ তাদের কারও কারও মুখ এত মলিন ও বিষণ্ন থাকে কেন? খোঁজ নিতেই ভয়াবহ তথ্য পাওয়া গেলো। আমাদের এই রাজধানী শহরে সিএনজি অর্থাৎ অটোরিকশার ব্যবসা খুবই জমজমাট ও লাভজনক ব্যবসা। রোড পারমিটসহ একটি নতুন অটোরিকশা কিনতে হলে নাকি ১৭ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হয়। অটোরিকশার এই যে মূল্য, এটা কি একটু অস্বাভাবিক নয়? ঢাকা শহরের অধিকাংশ অটোরিকশার ড্রাইভার দৈনিক নির্ধারিত ভাড়ার বিনিময়ে মালিকের কাছে অটোরিকশা নেন। রোদ, বৃষ্টি, যানজট যাই থাকুক না কেন অটোরিকশার মালিককে নির্ধারিত ভাড়া দিতে বাধ্য থাকেন ড্রাইভারেরা। ফলে দিনের শুরুতেই প্রত্যেক ড্রাইভারেরই মাথায় থাকে মালিকের ভাড়ার টাকা জোগাড় করতে হবে। ফলে মিটারের ওপর কেউই ভরসা করতে চান না। যার যেমন খুশি যাত্রীদের কাছে ভাড়া হাঁকেন। অসহায় যাত্রীরা বাধ্য হয়ে ড্রাইভারের কাছে জিম্মি হয়েই অটোরিকশায় ওঠে আর মনে মনে এই শহরের পরিবেশ, পরিস্থিতির ওপর খেদোক্তি করেন। সরকারের ওপরও ক্ষেপে যান কেউ কেউ।
অন্ধকারের বিপরীতে আলোও আছে। মিটারে চলাচল করতে অভ্যস্ত একজন অটোরিকশা ড্রাইভারের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল কিছুদিন আগে। বললাম–ভাই, যাবেন। মিষ্টি হাসি দিয়ে সেই ড্রাইভার বললেন–চলুন।
গন্তব্যের কথা উল্লেখ করে বললাম–ভাড়া কত!
ড্রাইভার যারপরনাই বিনীত হয়ে বললেন–স্যরি, আমি চুক্তিতে ভাড়া খাটি না। মিটারে যা উঠবে তাই দেবেন।
অভিভূত হলাম তার প্রতি। তার সিএনজি অটোরিকশাটি নতুন। যাত্রীদের সিটে সুন্দর কভার দেওয়া। দেশের গান বাজছে তার অটোরিকশায়।
জিজ্ঞেস করলাম–এই অটোরিকশা কি আপনার?
উত্তরে বললেন না। ভাড়ায় নিয়েছি।
পাল্টা প্রশ্ন করলাম–ভাড়ায় নিয়েছেন। মিটারে পোষায় আপনার?
ড্রাইভারের বিনীত উত্তর–প্রতিদিন মালিকের ভাড়ার টাকা তোলার জন্য চিন্তায় থাকি। তাই সবদিন পোষায় না। কিন্তু আমি তো নিয়মের বাইরে যেতে পারি না। পত্রিকায় একজন গাছপ্রেমিক সিএনজি ড্রাইভারের কথা পড়েছি। তার অটোরিকশার ছাদে সবুজের আচ্ছাদন দেওয়া। তিনিও মিটারে ভাড়া খাটেন।
তার মানে নিয়ম যে কেউ মানছেন না, তা কিন্তু নয়। কিন্তু তাদের সংখ্যা খুবই কম। এখন প্রশ্ন হলো যারা নিয়ম মানছেন তারা কি ভুল করছেন?
বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে ২৭ নভেম্বর থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামে অটোরিকশা ধর্মঘটের খবর পড়ে একটু অবাকই হলাম। হঠাৎ আবার কী হলো? যাত্রীদের জিম্মি করে রাখা পরিবহনের এই সেক্টরটি আর কী চায়? তাদের দাবির ফিরিস্তি দেখে শুধু অবাক নয় বিস্মিতও হলাম। উবার, পাঠাও-এর মতো অ্যাপনির্ভর জনপ্রিয় পরিবহনসেবা বন্ধ করা, মেয়াদোত্তীর্ণ অটোরিকশা অপসারণ করে নতুন অটোরিকশা প্রতিস্থাপন করাসহ আট দফা দাবিতে এই ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম জেলা সিএনজি অটোরিকশা শ্রমিক ঐক্যপরিষদ।
আমি জানি না অটোরিকশা শ্রমিক ঐক্যপরিষদের কর্মকর্তারা অটোরিকশার ক্ষেত্রে যাত্রীদের সীমাহীন দুর্গতি ও চরম বিরক্তির বিষয়টি কখনও গুরুত্ব দেন কিনা। গুরুত্ব দিয়ে থাকলে উবার ও পাঠাওয়ের মতো অ্যাপনির্ভর জনপ্রিয় পরিবহনসেবার বিরুদ্ধে কখনই কথা বলতেন না। তারা কোন সাহসে তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতির বিরুদ্ধে কথা বলছেন? এ কথা তো সত্য উবার ও পাঠাও নামের নতুন পরিবহন ব্যবস্থা জনমনে স্বস্তি এনে দিয়েছে। যদিও তাদের ব্যাপারে যে অভিযোগ নাই তা নয়। তবে এই পরিবহন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে যাত্রীদের বলতে হয় না মিটারে যাবেন নাকি? এই পরিবহন ব্যবস্থাই মিটারে যাওয়ার বিষয়টি স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিশ্চিত করে দেয়। কখনও কখনও সিএনজি অটোরিকশার চেয়েও কম ভাড়ায় উবারে যাওয়া যায়। কাজেই অটোরিকশা শ্রমিক, ঐক্যপরিষদের উচিত নিজস্ব সেক্টরের দাবি-দাওয়া নিয়ে কথা বলা। তারা কেন অন্য সেক্টর নিয়ে কথা বলবে? তার মানে তারা কি চাচ্ছে পরিবহন সেক্টরে তথ্য প্রযুক্তির যে ছোঁয়া লেগেছে তা বন্ধ হোক। যাত্রীরা তাদের কাছেই বছরের পর বছর ধরে জিম্মি হয়ে থাকুক। আমি স্বচ্ছন্দ্য পরিবেশে আধুনিক যানবাহন ব্যবহার করব, সে ক্ষেত্রে বাধা দেওয়ার তো বাস্তবসম্মত কোনও যুক্তি নেই। বরং যদি আমরা দেখতাম অটোরিকশা শ্রমিক ঐক্যপরিষদ যাত্রীদের সীমাহীন দুর্গতির কথা মাথায় রেখে তাদের দাবি-দাওয়ার ক্ষেত্রে যাত্রীবান্ধব সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টির কথা বলছেন। মিটারের ওপর সর্বশেষ গুরুত্ব আরোপ করছেন তাহলে তাদের ধর্মঘটে যাত্রীদেরও সমর্থন থাকতো। যাত্রীরাই তাদের পাশে দাঁড়াতেন।
যাত্রী মানে কে? এই দেশের সাধারণ মানুষ। তাদের জিম্মি রেখে এই দেশে কোনও আন্দোলন কি সফল হয়েছে? অটোরিকশা ধর্মঘটের খবর পড়ে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইতোমধ্যে প্রতিক্রিয়া দিতে শুরু করেছেন। একজনের প্রতিক্রিয়া এমন। ওয়াও! অটোরিকশা ধর্মঘট চলবে। অবিরাম চলুক এই ধর্মঘট! এই মন্তব্যের দু’টি মানে হতে পারে। এক. ধর্মঘটের ব্যাপারে সমর্থন। দুই. ধর্মঘটের ব্যাপারে তুচ্ছতাচ্ছিল্য অর্থাৎ যাত্রীদের পক্ষ থেকে চরম বিরক্তি প্রকাশ। এবার অটোরিকশা শ্রমিক পরিষদকেই বুঝে নিতে হবে এই মন্তব্যের আসল মানে কী?
লেখক: সাংবাদিক, নাট্যকার, কথাসাহিত্যিক