বাংলাদেশ বেতারে, সেই রেডিও পাকিস্তান আমল থেকেই, প্রধানত দুটি বিষয়ে রয়্যালটি প্রদানের নিয়ম ছিল।
১. গানের জন্যে গীতিকবিকে দেয় রয়্যালটি। এই ক্ষেত্রে, ২৫টি গান জমা দিয়ে যারা অনুমোদিত হতেন, তাদের সঙ্গে, মহামান্য রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে আঞ্চলিক পরিচালক ‘অমনিবাস রয়্যালটি কন্ট্রাক্ট’, সংক্ষেপে ওআরসি স্বাক্ষর করতেন। দেশের যেকোনও কেন্দ্র থেকে, এই গীতিকবির, বেতারের ভাষায় ‘গীতিকার’-এর, যেকোনও গান প্রচারিত হলে, প্রতিবারের জন্যে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা হতো। প্রতি তিন মাসে, সব কেন্দ্র থেকে একটি প্রতিবেদন আসতো সেই কেন্দ্রে, যে কেন্দ্রে তিনি ওআরসি স্বাক্ষর করে তালিকাভুক্ত হয়েছেন। তাতে দেখা যেতো, প্রতি তিন মাসে, সব কেন্দ্র থেকে প্রতিবার প্রচারের হিসেব মিলিয়ে, ভালোই একটি অঙ্ক গীতিকবি লাভ করতেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ১৯৮০’র দশক পর্যন্ত এই নিয়ম যথাযথভাবে চালু ছিল। তারপর ক্রমেই অনিয়ম ঘটা শুরু হয়। সবচেয়ে বেশি অনিয়ম ঘটছে, বিভিন্ন আঞ্চলিক কেন্দ্র এবং ইউনিট থেকে প্রতিবেদন আসায়। আর প্রতি তিন মাসে, নিয়ম অনুযায়ী সবার কাছে রয়্যালটির অর্থ পৌঁছে যাওয়া তো এখন কল্পনারও অতীত।
আমি ঢাকা কেন্দ্রের সঙ্গে তালিকাভুক্ত। প্রতি তিন মাসে তো দূরের কথা, তাগাদা না দেওয়া পর্যন্ত, বছর গড়িয়ে গেলেও, কোনও খবর থাকে না। তার ওপর দেখা যায়, একমাত্র বাণিজ্যিক কার্যক্রম ছাড়া কোনও কেন্দ্র বা ইউনিট থেকে কোনও প্রতিবেদনই আসে না। ফলে আমার মতো বঞ্চিত হন সকল গীতিকবি। ওইসব কেন্দ্র বা ইউনিট থেকে প্রতিবেদন না আসার বিষয়ে কারও যেন কোনও দায়-দায়িত্বই নেই। কখন কী প্রচারিত হচ্ছে তার জন্যে ‘লগ’ লেখার ব্যবস্থা আছে, যেটা সাধারণত সম্পন্ন করা হয় বেতনভুক্ত স্টাফ বা মাসিক চুক্তিভুক্ত ক্যাজুয়াল কন্ট্রাক্টের ভিত্তিতে নিয়োজিত ব্যক্তিদের দিয়ে। হিসাবটি মিলিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেন বেতারের কর্মচারী। সেটাতে স্বাক্ষর করে পাঠান একজন আধিকারিক। কেন এটা নিয়মিত হবে না? খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জনবলের অভাব! প্রশ্ন হলো, জনবলের অভাব? না-কি জনবোঝার চাপ? অর্থাৎ স্টাফ বা ক্যাজুয়াল হিসেবে লোক ঠিকই আছে, কিন্তু তারা এমন সুপারিশ থেকে নিয়োগ পান যে অফিসে আসার ধার না ধারলেও, মাসিক চুক্তির টাকা ঠিকই পেয়ে যান। শোনা যায় যে, সেটাও তাদের বাসায় পৌঁছে দিলে তারা বেশি খুশি হয়। এই কারণে লগ লেখা থেকে শুরু করে, প্রতিবেদন পাঠানো, কোনোটাই সম্পাদিত হয় না।
২. এই রয়্যালটির আওতায় আসেন নাট্যকারবৃন্দও। তাদের রচিত নাটকের জন্যেও তাঁদের রয়্যালটি কন্ট্রাক্ট স্বাক্ষর করতে হয়। এই নাটক প্রথম প্রচারের জন্যে তিনি একটি অঙ্কের সম্মানী পেয়ে থাকেন। তারপরে এর পুনঃপ্রচারের জন্যে, সে যেকোনও কেন্দ্র থেকেই হোক, তারা সম্মানী পাবেন, এটাই নিয়ম। বর্তমানে পান কিনা তা অবশ্য বলতে পারবো না।
তবে, তৃতীয় একটি বিষয় এসেছে, যেটা সর্বভুক। তা হলো ক্রিকেট খেলার সম্প্রচার। রয়্যালটি হেডে যে টাকা আসে, তার প্রায় সবই মিইয়ে যায় এই খেলার রয়্যালটি। ফলে অতি স্বল্পপরিমাণ যে অর্থ গীতিকবি বা নাটক লেখক পেয়ে থাকেন, তাতে টান পড়ে যায়। গীতিকবিরা বছরের পর বছর না পেলেও, খেলা প্রচারের টাকা যথাসময়ে, ঠিকই কান মুচড়ে নিয়ে যায় প্রাপকেরা। এ বিষয়ে আরো বিস্তৃত লেখার ইচ্ছে রইলো।
লেখক: কবি ও কলামিস্ট