কোটা সংস্কার আন্দোলন ও দুঃখ ভারাক্রান্ত ঘোষণা

মো. জাকির হোসেনকোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে যে এত কিছু হচ্ছে আমি মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিলাম। আর পণ করেছিলাম– না ফেসবুক না পত্রপত্রিকা, কোথাও কোটা নিয়ে কিছু লিখবো না। পরিস্থিতি এমন হলো যে, পণ ভাঙতেই হলো। কলম ধরতেই হলো। কোটার আন্দোলন একেবারে শুরু থেকে গত কয়েক মাসে কতবার যে এ বিষয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। সব প্রশ্নই ছিল একটি কোটাকে কেন্দ্র করে। জেলা কোটা, নারী কোটা, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কোটা কিংবা প্রতিবন্ধী কোটা নিয়ে কোনও প্রশ্ন ছিল না। সকলেই একটাই প্রশ্ন করেছে মুক্তিযোদ্ধা কোটা আমি যৌক্তিক মনে করি কিনা? দুই লক্ষ মুক্তিযোদ্ধার জন্য ৩০ শতাংশ কোটা কেন? আমার যুক্তির পর প্রশ্নকারীরা পাল্টা প্রশ্ন করেছে, মুক্তিযোদ্ধারা কোটার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছেন কিনা? কেউ কেউ তো এমন প্রশ্নও তুলেছেন এটি সংবিধান সম্মত কিনা? আমি আমার মতো যুক্তি দিয়েছি। তারা যুক্তিতে খুশি হয়েছে বলে মনে হয়নি। শেষে এমনও বলেছি, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর যখন কেবল নামেই বাংলাদেশ, আদতে বাংলাদেশ মিনি পাকিস্তানের সংস্করণে রূপ নিয়েছিল, তখন থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারি চাকরিতে কেবল প্রান্তিকীকরণই হয়নি, অনেককে জবরদস্তি চাকরি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের স্থলে স্বাধীনতা বিরোধীদের পুনর্বাসনের প্রক্রিয়াটি চলেছে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে। এ অবস্থার ভারসাম্য আনার জন্যও মুক্তিযোদ্ধা কোটার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি।

কোটা আন্দোলনের সঙ্গে কিছুটা ‘ঝুটা’ আছে, 'কোটাধারীরা'ও আছে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে হামলার ধরন ও বর্বরতার মাত্রা,কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর বক্তৃতার বিকৃত উপস্থাপন, সড়ক ও সেতুমন্ত্রীর সঙ্গে সমঝোতার প্রেক্ষিতে ৭ মে পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণার পরও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া, সমঝোতার ধারাবাহিকতায় কোটা সংস্কারের বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রী জনপ্রশাসন মন্ত্রালয়কে নির্দেশ দেয়ার পরও আন্দোলনকারীদের তা আমলে না নেওয়া,একজন আন্দোলনকারী নিহত হওয়ার মিথ্যা খবর রটানো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাতি নিভিয়ে আক্রমণ পরিচালনার মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে আন্দোলনকে উসকে দেওয়ার ষড়যন্ত্র, কোটা আন্দোলন নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক মামুন আহমেদের সঙ্গে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ফোনালাপ ও তাকে আন্দোলন সংগঠিত করতে তারেক জিয়ার পুনঃপৌণিক পরামর্শ কোটা আন্দোলনে ইঙ্গিত দেয়।

কৃষিমন্ত্রীর যে বক্তব্যটি বিকৃত করা হয়েছিল তা ছিল এরকম, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানেরা সুযোগ পাবে না, রাজাকারের বাচ্চারা সুযোগ পাবে? তাদের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংকুচিত হবে?’ তিনি বলেন, ‘রাজধানীকেন্দ্রিক একটি এলিট শ্রেণি তৈরির চক্রান্ত চলছে। তারই মহড়া গতকাল (রোববার) আমরা দেখলাম।’ কৃষিমন্ত্রী আরও বলেন, ‘পরিষ্কার বলতে চাই। মুক্তিযুদ্ধ চলছে, চলবে। রাজাকারের বাচ্চাদের আমরা দেখে নেবো। তবে ছাত্রদের প্রতি আমাদের কোনও রাগ নেই। মতলববাজ, জামায়াত-শিবির, তাদের এজেন্টদের বিরুদ্ধে সামান্য শৈথিল্য দেখানো হবে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলবো, এদের ক্ষমা নেই, ক্ষমা করা যাবে না। হয় তারা থাকবে, নতুবা আমরা থাকবো।’ কৃষিমন্ত্রীর বক্তব্যে এটা স্পষ্ট তিনি ঢালাওভাবে সকল আন্দোলনকারীকে ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলেননি।

তবে এটা সত্য, অর্থমন্ত্রীর অতিকথন দল ও দেশের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। কোটা সংস্কার নিয়ে যখন আন্দোলন তুঙ্গে তখন অর্থমন্ত্রী বেফাঁসভাবে বলে বসলেন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়কে ভ্যাট দিতে হবে। আরেকবার ভ্যাট আরোপের ঘোষণা কি পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল মন্ত্রী মহোদয় বোধকরি বেমালুম ভুলে গেছেন। মন্ত্রীর বক্তব্যের পরপরই ভ্যাটের প্রতিবাদ করতে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্যাট আরোপ করা হবে না মর্মে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরও শিক্ষার্থীরা আর ক্যাম্পাসে ফিরে না গিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনে যুক্ত হয়ে রাজপথে অবস্থান নেয়। সড়ক পরিবহন মন্ত্রী আন্দোলনকারীদের সাথে বসে ঠিক করলেন মে’র প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী সংস্কারে বিষয়ে ঘোষণা দেবেন, আর অর্থমন্ত্রী বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে বললেন, আগামী বাজেটের পর কোটা সংস্কারে হাত দেওয়া হবে। মন্ত্রীর অতিকথন এখানেই শেষ নয়। সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান ৫৬ শতাংশ কোটা ‘বোধহয়’ অনেক বেশি হয়ে গেছে বলেও মন্তব্য করে নতুন করে সংশয় সৃষ্টি করলেন।

প্রধানমন্ত্রী যেখানে সুস্পষ্ট করে বললেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনও কর আরোপ করা হবে না, অর্থমন্ত্রী নতুন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে বললেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্যাট বসানো হবে না, তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকরা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যে ফি ও চার্জ নেয়, সেখান থেকে যে মুনাফা হয় তার ওপর মালিকদের আয়কর দিতে হবে। মন্ত্রী সম্ভবত অবগত নন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মালিক নেই, আছে ট্রাস্টি বোর্ড। তিনি আরও অবগত নন যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০ অনুযায়ী ট্রাস্টিদের মুনাফা নেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। কেউ যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ স্থানান্তর করে, তবে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

যাইহোক, অবশেষে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন সরকারি চাকরিতে কোনও কোটা থাকবে না। তিনি বলেন, ‘কোটা থাকলেই সংস্কার। আর না থাকলে সংস্কারের কোনও ঝামেলাই নাই। কাজেই কোটা পদ্ধতি থাকারই দরকার নাই। আর যদি দরকার হয়, আমাদের কেবিনেট সেক্রেটারি তো আছেই। তাকে তো আমি বলেই দিয়েছি, সংশ্লিষ্ট যাদের নিয়ে বসে ওই কমিটি কাজ করবে এবং সেখান থেকে তারা বিষয়টি দেখবে। কিন্তু আমি মনে করি, এই ধরনের আন্দোলন বারবার হবে। বারবার শিক্ষার সময় নষ্ট হবে।’

প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা স্পষ্টতই কষ্টের ইঙ্গিত দেয়। যেহেতু আন্দোলনকারীরা কোটা সংস্কার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর ষোষণা ছাড়া রাজপথ ছাড়বে না এবং কমিটির পরীক্ষা-নিরীক্ষা পর্যন্ত সময় দিতে রাজি নয়, তাই জনদুর্ভোগ লাঘবে তড়িঘড়ি করে কোটা বিলুপ্তির ঘোষণা দেওয়া ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর আর কোনও পথ খোলা ছিল না। তদুপরি,এ আন্দোলন থেকে সুবিধা আদায়ের জন্য কিছু রাজনৈতিক দল ও সুশীল তৎপর ছিল। তিনবার ক্ষমতায় থাকার পরও কোটা সংস্কার বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ না নিয়ে এখন আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে, তলে তলে আন্দোলনে বাতাস দিয়ে ফায়দা লোটার চেষ্টা করছিল বিএনপি। শাপলা চত্বরের ঘটনা কি আমরা ভুলে গেছি? এবারের নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত থাকায় সরকার হটানোর কোনও সুযোগই বিএনপি-জামায়াত হাতছাড়া করবে না তা সহজেই অনুমেয়। এত মানুষ একসঙ্গে জমায়েত হয়ে এভাবে অরক্ষিত ছিল, ফলে কোনও নাশকতা ঘটাও অমূলক ছিলে না। আর তেমন কিছু হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে, এটাও প্রধানমন্ত্রী বিবেচনায় নিয়েছিলেন।

আন্দোলনকারীগণ বেশ ক’টি বিষয় আমলে নিতে ব্যর্থ হয়েছেন-

এক. কোটা পদ্ধতি বাংলাদেশের জন্যই কেবল অনবদ্য নয়। পৃথিবীর অনেক উন্নত রাষ্ট্রেও কোটা পদ্ধতি রয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রশ্ন হছে সব মিলিয়ে ৫৬ শতাংশ কোটা থাকবে কিনা? কোটার সঙ্গে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য ও ক্ষমতায়নের বিষয় জড়িত। কাজেই কোন ক্যাটাগরিতে কত শতাংশ কোটা কমানো হবে, তার জন্য যাচাই-বাছাই না করে কমালে তা হটকারি সিদ্ধান্ত হতে পারে। আন্দোলনকারীরা যে কোটা ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার দাবি করেছেন তা কোন গবেষণা, দেশব্যাপী সেমিনার-সিম্পোজিয়াম কিংবা লক্ষ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রীর কংগ্রেসে গৃহীত সিদ্ধান্ত নয়। কাজেই ১০ শতাংশকে সর্বজনগ্রাহ্য ও বিজ্ঞানভিত্তিক মনে করার কোনও কারণ নেই।

দুই. মুক্তিযোদ্ধা কোটা চিরস্থায়ী নয়। রাষ্ট্র মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসিত করার ব্যর্থতার দায় থেকে হয়তো তৃতীয় প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধার নাতিদের সুযোগ দিয়েছে। তৃতীয় প্রজন্মের পর এ সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া যেতে পারে। এ জন্যও আলোচনা করার প্রয়োজন ছিল।

তিন. বাংলাদেশ রাষ্ট্র একটি ক্রান্তিকাল পার করছে। যে সময় আন্দোলন চলছে তখন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ও মিয়ানমারের মন্ত্রী বাংলাদেশ ভ্রমণ করছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চীন-ভারতের বৈরী সম্পর্ক ও বাংলাদেশের উভয় রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা অনেকটাই স্পর্শকাতর। খুব সাবধানে হিসাব-নিকাশ কষে পা ফেলতে হচ্ছে সরকারকে। অন্যদিকে, বারো লক্ষাধিক রোহিঙ্গা সংকট ক্রমেই দীর্ঘস্থায়ী ও গুরুতর হওয়ার আশঙ্কা জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে সরকার ও রাষ্ট্রের ওপর। বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ দুই দেশের মেহমানকে ঘিরে সরকারের পুরো মনোযোগ ছিল। এসব বিবেচনায় না নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট ঘোষণা ছাড়া রাজপথ না ছাড়ার ধনুকভঙ্গ পণ অবিমৃশ্যকারিতা ছিল।

তারপরও বলবো, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মওদুদ আহমদরা যতই বলুক এ আন্দোলন জয়-পরাজয়ের নয়,বরং জীবন-জীবিকার জন্য ছিল। আমরা ভুলে যাইনি অসাম্প্রদায়িক,উন্নত ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ গড়ার আপনার নিরলস প্রচেষ্টায় আপনার ওপর ২১ বার হত্যা প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে, আর প্রতিবারই আপনি ফিনিক্সের মতো জেগে উঠেছেন। আমরা এও ভুলে যাইনি বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় তখন মাথাপিছু আয় ছিল ৫০-৬০ ডলারের মতো এবং তা ছিল প্রায় স্থবির। মানুষের জীবনের গড় আয়ু ছিল ৫০ বছরেরও কম। বেকারত্বের হার ছিল ২০-৩০ শতাংশ। শিক্ষার হার ২০ শতাংশ। সব মিলিয়ে দেশটির টিকে থাকা নিয়েই শঙ্কা ছিল। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো ও বড় পরাশক্তির ধারণা হয়েছিল যে সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া বাংলাদেশ মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারবে না। হেনরি কিসিঞ্জারের নেতৃত্বাধীন এক কমিটি মনে করেছিল, এটি হবে আন্তর্জাতিক এক তলাবিহীন ঝুড়ি। এখানে যতই সাহায্য ঢালা হোক না কেন, তা কোনও কাজেই লাগবে না। দেশটিতে দ্রুতই দুর্ভিক্ষ ও মহামারি দেখা দেবে। ওই সময়ে সিআইএ’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এত অল্প জায়গায় এত মানুষের বাস এবং এত দারিদ্র্যের কারণে দেশটি তার প্রতিবেশী এবং বিশ্বের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হতে পারে। বঙ্গবন্ধু সব কিছু উপেক্ষা করে অতি অল্প সময়ের মধ্যে দেশটির ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ করে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার শক্ত পাটাতন তৈরি করে দেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী চরম অস্থির, অনিশ্চিত সময়ে মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনকালে বঙ্গবন্ধু যে রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে তুলেছিলেন, জাতি গঠনে তিনি যে দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন, শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞানে আধুনিক ও উন্নত জীবন গঠনে তিনি যে পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন তার চেয়ে উন্নততর নীতি, কাঠামো, পরিকল্পনা কেউ দিতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দীর্ঘ দুই দশক পর আপনি গভীর মমতায়, দূরদর্শিতায়, সাহসিকতায় বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে আন্তরিক ও নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। নেতৃত্বের গুণাবলি, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অর্থনৈতিক নীতিকৌশলে পরিবর্তন ও চরম ঝুঁকিপূর্ণ ও দুঃসাহসিক পররাষ্ট্রনীতির কারণে আপনি নিজেও সমসাময়িক বিশ্বের অন্যতম অলোচিত নেতা হয়েছেন এবং বাংলাদেশকেও মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। একটি দেশের বৈশ্বিক পর্যায়ে উন্নয়ন সংক্রান্ত মর্যাদার এক ধাপ উত্তরণ সেই জাতির জন্য গৌরবজনক ঘটনা অবশ্যই। স্বল্পোন্নত দেশের নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশকে একসময় দরিদ্র দেশের মডেল হিসেবে গণ্য করা হতো। আর আজ পুরো বিশ্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল। খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ, স্যাটেলাইট ও পরমাণু ক্লাবে যোগদান ও ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণের মতো মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়নে বাংলাদেশের সাফল্য এখন বিশ্বের উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর কাছে রীতিমতো রহস্য। ঈর্ষান্বিত অনেক উন্নত রাষ্ট্রও। প্রতিনিয়তই মিলছে তার স্বীকৃতি। খোদ জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংক এখন বিভিন্ন সদস্য দেশকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অনুসরণ করতে বলছে। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের সরল স্বীকারোক্তি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বকে চমকে দেওয়ার মতো সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ‘বিশ্ব লিঙ্গবৈষম্য প্রতিবেদন অনুসারে, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ বিশ্বে অষ্টম। এক্ষেত্রে অনেক উন্নত দেশের থেকেও বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ শুধু সবার ওপরে নয়, বাংলাদেশ অন্যদের থেকে অনেক এগিয়ে গেছে। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল যখন দরিদ্র মানুষ উপভোগ করতে পারে তখন একে আন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন বলে। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনেমিক ফোরামের আন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন সূচকে বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৪তম, আর দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলংকার চেয়ে এগিয়ে। আপনার হাত ধরে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে বাংলাদেশ এ কথা অস্বীকার করার মতো অকৃতজ্ঞ আমরা নই।

কোটা সংস্কার আন্দোলন এখন যে মোড় নিয়েছে তা থেকে উত্তোরণের উপায় এখন কেবল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার হাতে। কোটা বিলুপ্তির সময় এখনও আসেনি। এখনও বৈষম্য রয়ে গেছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে সমান সুযোগ দূরে থাক,রাষ্ট্র এখনও কিছু কিছু জায়গায় মৌলিক অবকাঠামোই তৈরি করতে পারেনি। কাজেই এসব পিছিয়ে থাকা গোষ্ঠীর জন্য কোটা দরকার। মুক্তিযোদ্ধা কোটা বিলুপ্তিরও সময় হয়নি এখনও। সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন করতে পারেনি, তাই তাদের সন্তানরা লেখাপড়ার সুযোগ পায়নি। সুতরাং মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের এবং তাদের সন্তানদের ক্ষেত্রেও এ সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। তৃতীয় প্রজন্মের পর এটি বন্ধ করা সঠিক হবে না। এ সংখ্যা হ্রাস করা যেতে পারে এবং তা কেবলমাত্র শহীদ, যুদ্ধাহত ও পিছিয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য সীমিত রাখা যেতে পারে।

যারা আন্দোলন করেছে তারা কোটাধারীদের দ্বারা কিছুটা বিভ্রান্ত হলেও ওরা এদেশের সন্তান, দেশের ভবিষ্যৎ। আপনি অবগত আছেন অর্জন ও সম্ভাবনার পাশাপাশি ভয়ঙ্কর কিছু চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে বাংলাদেশের জন্য। সম্ভাবনা বিনাশী এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এ প্রজন্মই। আপনি প্রয়োজনে ওদের সঙ্গে কথা বলুন। এরাই তো তারা যারা শঙ্কাহীনচিত্তে আপনাকে নিয়ে স্লোগান দেয়, ‘শেখ হাসিনার হাতে থাকলে দেশ, পথ হারাবে না বাংলাদেশ’। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে এরাই তো আপনাকে প্রেরণা জুগিয়েছে, এরাই তো আগামী নির্বাচনে আপনাকে জয়ী করে আপনার পাশে থেকে, শক্তি, সাহস জোগাবে উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করে সোনার বাংলা গড়তে। আর দুঃখবোধ নয়। এখন কেবলই সামনে এগিয়ে যাবার পালা।

লেখক:  অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

ই-মেইল: zhossain@justice.com