X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে বিতর্ক ফৌজদারি অপরাধ

মো. জাকির হোসেন
২৬ মার্চ ২০২৪, ০০:০৮আপডেট : ২৬ মার্চ ২০২৪, ১৭:৫১

পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর দিন আজ। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার বিপরীতে জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করে বক্তৃতা-বিবৃতি প্রদান শুরু করে। অথচ ’৭১-এর ২৬ মার্চ পর্যন্ত সাধারণ মানুষ দূরে থাক, রাজনীতিবিদরাও মেজর জিয়াকে চিনতো না। ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করার পর মানুষ জিয়াউর রহমানের নাম জানতে পারে। আকস্মিক স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে কোনও দেশ স্বাধীন হয়েছে, বিশ্বের ইতিহাসে এমন একটিও নজির নেই। স্বাধীনতার ডাক দেওয়ার পূর্বে দীর্ঘ সময় ধরে প্রেক্ষাপট তৈরি করতে হয়, প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয়।

মানুষের চিন্তা, চেতনা ও ভাবনাকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করতে হয়। জীবন বলিদানসহ চরম আত্মত্যাগের জন্য দেশবাসীকে দীক্ষিত করতে হয়। এজন্য রাজনৈতিক নেতা থাকতে হয় যিনি জীবনের মায়া, পরিবারের প্রতি স্নেহ-ভালোবাসাকে অবলীলায় তুচ্ছ করতে পারেন। অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করতে প্রস্তুত থাকেন। আরাম-আয়েশের জীবন বিসর্জন দিয়ে কারাগারকে বাসস্থান মেনে নিতে পারেন। জনতার মনের কথা পড়ার মতো সক্ষমতা রাখেন। জনতার আদালতে অতল দেশপ্রেমের প্রমাণ দিয়ে উতরে যেতে পারেন। এমন গুণে গুণান্বিত একজন সর্বজনস্বীকৃত মহান নেতারই শুধু এখতিয়ার রয়েছে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার। কোনও সামরিক কর্মকর্তার নয়। তদুপরি জিয়া বিচিত্রায় তার নিজের লেখা প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন পাকিস্তান থেকে সোয়াত জাহাজে করে আনা অস্ত্রশস্ত্র খালাসের দায়িত্ব তার ওপর অর্পিত ছিল।

স্বাধীনতার ঘোষণা যে কেউ দিতে পারে না। এটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বিষয়। স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারেন এমন একজন নেতা, যিনি তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে একটি জাতির মুক্তির জন্য লড়াই করে আসছিলেন। মার্কিন সাংবাদিক সিরিলডন টাইম ম্যাগাজিনে লিখেছিলেন, ‘মাতৃভূমিকে পশ্চিম পাকিস্তানের একটি উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধের পর্যায়ে নিয়ে আসার ঘটনা শেখ মুজিবের একদিনের ইতিহাস নয়, ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এটি তাঁর লক্ষ্য ছিল।’ এ দীর্ঘ যাত্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে কারাগার হয়ে উঠেছিল বঙ্গবন্ধুর আবাস। বিচারে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে অন্তত দুইবার। তবু দমে যাননি। বরং নিজের ও পরিবারের চাওয়া-পাওয়া, স্বপ্ন-সাধকে বিসর্জন দিয়ে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির স্বপ্নকে বুকে ধারণ করে জীবন বাজি রেখে সাহসী থেকে দুঃসাহসী হয়ে উঠেছেন।

পারিবারিক জীবনের কিছু উপলক্ষ থাকে যখন পরিবার প্রধানের উপস্থিতির বাইরে মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগত ও পরিবারের স্বপ্নকে কোরবানি করেছেন। স্ত্রীর সন্তান জন্মদানের সময় বঙ্গবন্ধু জেলে, সন্তানের বিয়ের সময়ও বঙ্গবন্ধু কারাগারের চার দেয়ালে বন্দি। দীর্ঘ কারাবাসে পিতৃস্নেহ বঞ্চিত সন্তানের কাছে বঙ্গবন্ধু অচিন হয়ে উঠেছেন কখনও। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়ার বিপজ্জনক ঝুঁকি যেমন নিয়েছেন, তেমনি ভয়ানক ষড়যন্ত্র আর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন অনেকবার।

ছয় দফা ঘোষণার পর অনেকেই ধরে নিয়েছিল মুজিবের রাজনীতি ও গ্রহণযোগ্যতা এখানেই শেষ। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর মতো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে অভিযোগ তুলে ছয় দফার সমালোচনায় মেতে ওঠেন। ডানপন্থি দলগুলো ছয় দফাকে পাকিস্তান ধ্বংস করার ভারতীয় ষড়যন্ত্র বলে অভিযোগ তুলে। অন্যদিকে কিছু বামপন্থি ছয় দফার ভেতরে সিআইএ’র সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করে। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরেও ছয় দফার প্রবল সমালোচনা হয়। দলের পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা ছিলেন চরমভাবে ছয় দফাবিরোধী। এই বিরোধিতা এতই প্রকট ছিল যে দলের মধ্যেই ভাঙন শুরু হয়। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লাহ খানের নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সব নেতা ও পূর্ব পাকিস্তানের আব্দুস সালাম খানের মতো অনেকেই দল থেকে বেরিয়ে ১৯৬৭ সালের মে মাসে নতুন রাজনৈতিক ফ্রন্ট পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম) গঠন করেন। আর পূর্ব বাংলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ তাঁর অনুসারীদের নিয়ে দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে দেন।

’৭০-এর যে নির্বাচন দেশে-বিদেশে বাংলার জনগণের বৈধ নেতৃত্বের স্বীকৃতি এনে দেয়, স্বাধীনতার আন্দোলনকে চূড়ান্ত যৌক্তিক রূপ দেয়, সে নির্বাচনের সময়ও বঙ্গবন্ধুকে কম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়নি। নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভাসানীর ‘ভোটের বাক্সে লাথি মারো, পূর্ব বাংলা স্বাধীন করো’ স্লোগানে নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা মারাত্মক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছিলো বঙ্গবন্ধুর জন্য। আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে বঙ্গবন্ধুকে ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট’, ‘ভারতের এজেন্ট’ বলে অপপ্রচারও চালানো হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু ৬ দফার পক্ষে যদি গণ-আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারতেন তাঁর ফাঁসি কি অবধারিত ছিল না?

২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা আকস্মিক বিষয় নয়। দীর্ঘ সংগ্রাম, আত্মত্যাগ, মৃত্যু, কারাজীবন, নিপীড়ন, নির্যাতনের রক্ত পিচ্ছিল পথ বেয়ে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের মাহেন্দ্রক্ষণ। পৃথিবীর ইতিহাসে কত স্বাধীনতার সংগ্রাম ব্যর্থ হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। বঙ্গবন্ধু ধাপে ধাপে জাতিকে প্রস্তুত করেছেন মুক্তিযুদ্ধের জন্য। পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা ভেবেছেন বঙ্গবন্ধু। স্বাধীন বাংলাদেশের আন্দোলনকে মুক্তিযুদ্ধের পর্যায়ে নিয়ে যেতে বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলনকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে রূপ দিয়েছেন। এরপর জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে রূপ দিয়েছেন। স্বায়ত্তশাসনকে স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ দিয়ে অর্জন করেছেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সমর্থনপুষ্ট পাকিস্তান এবং সেই সঙ্গে পাকিস্তানের বিরোধিতা মানে ‘ইসলামের বিরোধিতা’ এই আবেগের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার আন্দোলন গড়ে তোলা কতটা কঠিন তা বিএনপি নেতারা অনুধাবন করেন কি?’ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ছিষট্টির ৬-দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ পাকিস্তানের মৃত্যুঘণ্টা ঘোষণা করে। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমে বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে গ্রেফতারের আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ও তাঁকে গ্রেফতারের সংবাদ ওই সময়ের অসংখ্য আন্তর্জাতিক প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। এসব আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের মধ্যে অন্যতম হলো– বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, দিল্লির দ্য স্টেটসম্যান, ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান ও দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, নিউ ইয়র্ক টাইমস, আয়ারল্যান্ডের দ্য আইরিশ টাইমস, আর্জেন্টিনার বুয়েনস আয়ারস হেরাল্ড, ব্যাংকক পোস্ট, বার্তা সংস্থা এপি।

এছাড়াও ভারত, ব্রাজিল, ক্যানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, জাপান, হংকং, নরওয়ে, তুরস্ক, সিঙ্গাপুরসহ অনেক দেশের বহু সংবাদপত্রে স্থান পায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার খবর। উদাহরণস্বরূপ সে সময়ের দু-একটি সংবাদ শিরোনাম উল্লেখ করছি–  নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়ার ছবি ছাপিয়ে পাশেই লেখা হয় “স্বাধীনতা ঘোষণার পরই শেখ মুজিব আটক”, ব্যাংকক পোস্ট-এর খবরে বলা হয়, “শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ নাম দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে”, ভয়েস অব আমেরিকার খবরে বলা হয়: “... ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ শুরু করেছে। মুজিবুর রহমান একটি বার্তা পাঠিয়েছেন এবং সারা বিশ্বের কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন।” ’৭১-এর ২৬ মার্চ যুক্তরাষ্ট্র সময় সকাল সাড়ে সাত ঘটিকার এবিসি টেলিভিশনের সংবাদে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার কথা প্রচার করা হয়।

২৬ মার্চ দিবাগত রাতে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান রেডিও এবং টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। সে ভাষণে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী আখ্যা দেন। শেখ মুজিবকে পুরোপুরি দোষারোপ করে তিনি বলেছিলেন, ‘Sheikh Mujib has declared independence of East Pakistan. He is a traitor. This time he will not go unpunished’. 

সাবেক বিএনপি নেতা বর্তমান এলডিপি প্রধান কর্নেল (অব.) অলি তার রচিত– ‘Revolution, Military Personnel and The War of Liberation in Bangladesh’ গ্রন্থে তার চাকরিকালীন বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন সংযোজন করেছেন। গোপনীয় প্রতিবেদনটি লিখেছেন প্রয়াত বিএনপি নেতা মেজর জেনারেল মীর শওকত আলী। তৎকালীন ব্রিগেড কমান্ডার মীর শওকত আলী অলি আহমদ সম্পর্কে লিখেছেন– “He in fact was the first officer who took risk and on his own initiatives informed Gen. Ziaur Rahman regarding Declaration of Independence on night 25/26 March 71”. যার অর্থ দাঁড়ায়, ‘বস্তুত তিনিই (কর্নেল অলি) প্রথম কর্মকর্তা, যিনি ঝুঁকি নিয়ে নিজ উদ্যোগে একাত্তরের ২৫/২৬ মার্চ রাতে স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়ে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে অবহিত করেন’।

মীর শওকতের এই প্রতিবেদনটি পরবর্তী সিনিয়র অফিসার হিসেবে জিয়াউর রহমান নিজেই সত্যায়িত করেছেন। বঙ্গবন্ধু নিজেই একাধিক বক্তৃতায়, ১৯৭২ সালে গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনের বক্তৃতায় ও বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে চট্টগ্রামে ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণার কথা উল্লেখ করেছেন। ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি The New York Times বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই একইদিন নিউ ইয়র্কের WNEW-TV-তে The David Frost Show তে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়ে একটি সাক্ষাৎ প্রচার করা হয়। ১৯৭২ সালের ৮ এপ্রিল বাংলাদেশ অবজার ও মর্নিং নিউজে পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা বিষয়ে প্রতিবেদন ছাপা হয়।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশ গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা বিষয়ে বলেন, ‘…কিন্তু তারা অতর্কিতে ২৫ মার্চ তারিখে আমাদের আক্রমণ করলো। তখন আমরা বুঝতে পারলাম যে আমাদের শেষ সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। আমি ওয়্যারলেসে চট্টগ্রামে জানালাম বাংলাদেশ আজ থেকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। এই খবর প্রত্যেককে পৌঁছে দেওয়া হোক, যাতে প্রতিটি থানায়, মহকুমায়, জেলায় প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে উঠতে পারে। সেই জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশও দিয়েছিলাম।‘

১৯৭২ সালের ৭ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা বিষয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘…রাত্রে আমি চট্টগ্রামে নির্দেশ পাঠালাম আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। তোমরা বাংলার সব জায়গায় ওয়্যারলেসে এ খবর দিয়ে দাও। পুলিশ হোক, সৈন্যবাহিনী হোক, আওয়ামী লীগ হোক, ছাত্র হোক, যে যেখানে আছে, পশ্চিমাদের বাংলা থেকে খতম না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাও। বাংলাদেশ স্বাধীন। তারা আমার কথামতো খবর পৌঁছে দিয়েছিল।‘

বাংলাদেশ রাইফেলস-এর তৃতীয় দলের শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠানে ১৯৭৪ সালের ৫ ডিসেম্বর ঢাকার পিলখানায় বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা বিষয়ে বলেন, ‘আমি বাধ্য হয়ে এই বাংলাদেশ রাইফেলসের চট্টগ্রাম বাহিনীর হেড কোয়ার্টারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করার চেষ্টা করি। সেখানে আমার মেসেজ পাঠিয়ে দেই। তারা সেই মেসেজ বাংলার গ্রামে গ্রামে পৌঁছে দেয়।‘

সর্বোপরি, ’৭১-এর ১০ এপ্রিল প্রণীত বাংলাদেশের জন্মসনদ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার কথা উল্লেখ রয়েছে। এটি বাংলাদেশের ক্রান্তিকালীন প্রথম সংবিধান। এই ঘোষণাপত্রের ভিত্তিতেই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার বৈধতা অর্জন করে এবং এরই ভিত্তিতে পরিচালিত হয় নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ।

স্বাধীনতার এ ঘোষণাপত্রটি অনুমোদন করেছে ’৭০-এর নির্বাচনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত গণপরিষদ। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তারিখে ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান ও সে ঘোষণাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদনের বিষয় উল্লেখ রয়েছে। ঘোষণায় উল্লেখ রয়েছে,“ … বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান”।

ঘোষণায় আরও বলা হয়েছে, “বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি এবং এর দ্বারা পূর্বাহ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি;… আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে আমাদের এই স্বাধীনতার ঘোষণা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর বলে গণ্য হবে”।

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাকিস্তানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করা ও স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির আইনগত দলিল। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে অস্বীকার করা মানে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্যদের প্রতি অনাস্থা, পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা ও বাংলাদেশ সৃষ্টির ঘোষণাকে মেনে না নেওয়া। সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

অন্যদিকে, সংবিধানের ৭ক।(১)(খ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এই সংবিধান বা ইহার কোন বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে- তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং ঐ ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হইবে’।  

অনুচ্ছেদ ৭ক(২) -এর চলিত ভাষা ডিলিট করে এটা যোগ করে দিলে হবে-  অনুচ্ছেদ ৭ক।(২)-এ উল্লেখ করা হয়েছে ‘কোন ব্যক্তি (১) দফায় বর্ণিত- কোনও কার্য করিতে সহযোগিতা বা উস্কানি প্রদান করিলে; কিংবা কার্য অনুমোদন, মার্জনা, সমর্থন বা অনুসমর্থন করিলে-তাহার এইরূপ কার্যও একই অপরাধ হইবে’।

আর ৭ক(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত অপরাধে দোষী ব্যক্তি প্রচলিত আইনে অন্যান্য অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত হইবে’।

আমাদের দণ্ডবিধি অনুযায়ীও জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক বলা অপরাধ। দণ্ডবিধির ৪১৬ ধারায় বলা হয়েছে জ্ঞাতসারে এক ব্যক্তিকে অপর ব্যক্তিরূপে প্রতিস্থাপিত করা প্রতারণা।

জিয়ার শাসনামলে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত “বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র”তে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের নামটিই লেখা। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলে ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র’ পনেরো খণ্ডের সিরিজ গ্রন্থের ২০০৪ সালের পুনর্মুদ্রণকৃত তৃতীয় খণ্ডের প্রথম পৃষ্ঠায় মেজর জিয়াউর রহমান ২৭ মার্চ ১৯৭১ তারিখে প্রথম স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন মর্মে বর্ণনা করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা ডা. এম এ সালাম ২০০৪ সালে পুনর্মুদ্রিত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র গ্রন্থ সিরিজের তৃতীয় খণ্ডটি বাজেয়াপ্ত এবং বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাস বিকৃতকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন।

২০০৯ সালের ২১ জুন আমাদের উচ্চ আদালত রায়ে বলেন, জিয়াউর রহমান নন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক। সেই সঙ্গে ২০০৪ সালে পুনর্মুদ্রিত ‘বাংলাদেশ স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র’-এর তৃতীয় খণ্ডের প্রথম পৃষ্ঠায় ‘মেজর জিয়ার প্রথম স্বাধীনতা ঘোষণা’ শিরোনামে মুদ্রিত বর্ণনা ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তারিখে প্রণীত স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিধায় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫০-এর সঙ্গেও সাংঘর্ষিক এবং সংবিধান পরিপন্থি মর্মে ঘোষণা করেন এবং জিয়াউর রহমানকে ২০০৪ সালে স্বাধীনতার ঘোষক উপস্থাপন করে প্রকাশিত “বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্র”- এর তৃতীয় খণ্ড বাতিল ঘোষণা করেন। এই খণ্ডটি দেশ-বিদেশের সব স্থান থেকে বাজেয়াপ্ত ও প্রত্যাহারেরও নির্দেশ দেন। আদালত রায়ে বলেন, যারা এরকম ইতিহাস বিকৃতির সঙ্গে জড়িত তারা সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। যারা বিকৃত ইতিহাস রচনা করেছেন সেই প্রত্যয়ন কমিটির বিরুদ্ধে ধোঁকাবাজি ও সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগে সরকার চাইলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা সংক্রান্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে আদালতের রায়ে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে গ্রেফতারের পূর্বেই শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। প্রয়াত বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদের লেখা ‘এরা অব শেখ মুজিব’ গ্রন্থের কথা উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা করেছেন। রায়ে আদালত উল্লেখ করেন, ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত তৎকালীন লে. কর্নেল জিয়াউর রহমানের লেখা জাতির জনক শিরোনামের প্রবন্ধের উল্লেখ করে আদালত বলেন, জিয়াউর রহমান ওই প্রবন্ধে ২৫ মার্চের বিস্তারিত বিবরণ দেন। কিন্তু কোথাও নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেননি। ১৯৭৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়াউর রহমানের দেওয়া ভাষণের উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সম্পর্কে জিয়াউর রহমান তার ভাষণে বলেন ‘কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে আপনাদের উদ্দেশে কথা বলার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।’ কিন্তু তিনি ওই ভাষণেও নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেননি।

স্বাধীনতার ঘোষক ও ঘোষণা পাঠ করা সমার্থক নয়। এই দুটি শব্দের মধ্যে কোনও তুলনাই হতে পারে না। তা ছাড়া যে কেউ চাইলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতেও পারেন না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার একমাত্র আইনগত, বৈধ ও নৈতিক অধিকার ছিল বঙ্গবন্ধুর এবং উপযুক্ত সময়ে তিনি সেই ঘোষণা দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক কেবল মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধেই অবস্থান নয়, এটি ফৌজদারি অপরাধও।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ইমেইল: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাফাহ শহরে নতুন করে  ইসরায়েলি হামলায় ১৩ ফিলিস্তিনি নিহত
রাফাহ শহরে নতুন করে ইসরায়েলি হামলায় ১৩ ফিলিস্তিনি নিহত
টিভিতে আজকের খেলা (২৯ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৯ এপ্রিল, ২০২৪)
টিপু-প্রীতি হত্যা মামলার অভিযোগ গঠন বিষয়ে আদেশ আজ
টিপু-প্রীতি হত্যা মামলার অভিযোগ গঠন বিষয়ে আদেশ আজ
যশোরে তীব্র গরমে মরে যাচ্ছে মাছের পোনা, ক্ষতি ‌‘২০ কোটি টাকা’
যশোরে তীব্র গরমে মরে যাচ্ছে মাছের পোনা, ক্ষতি ‌‘২০ কোটি টাকা’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ