তিনটি সভা ও কয়েকটি জিজ্ঞাসা

মো. জাকির হোসেনগত ৪ মে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি অয়োজিত ‘আইনের শাসন ও গণতন্ত্র’ শীর্ষক মতবিনিময় সভা, ৭ মে জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘সর্বগ্রাসী লুণ্ঠন বাংলাদেশের বিপুল সম্ভাবনাকে ধ্বংস করেছে’ শীর্ষক আলোচনা সভা এবং চট্টগ্রামে ‘চলমান রাজনীতি, আগামী নির্বাচন ও জনগণের প্রত্যাশা’ শীর্ষক আলোচনা-মতবিনিময় সভায় বক্তাদের দেওয়া বক্তব্য আমাকে এ কলাম লিখতে অনুপ্রাণিত করেছে।  সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি অয়োজিত মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. কামাল হোসেন বলেছেন, ‘এ দেশে স্বৈরাচার কোনোদিন টিকে থাকতে পারবে না।  গণতন্ত্রের পরিবর্তে স্বৈরতন্ত্র কোনোদিন প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না।  এটা আমার বিশ্বাস।  এটা আমরা বহুবার প্রমাণ করেছি।  কিন্তু দুঃখ লাগে ৪৬ বছর পরে আবার আমাদের দেশে আন্দোলনের কথা বলতে হচ্ছে।  স্বৈরতন্ত্র এখানে চিরস্থায়ী থাকতে পারবে না, নির্বাচনকে সুষ্ঠু হতে হবে’।  কামাল হোসেনের বক্তব্যের মর্মার্থ হলো, এ সরকার স্বৈরাচার, এ সরকারকে হটাতে আন্দোলনে নামতে হবে।  একই সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেছেন, ‘আজকে দুঃখ লাগে, এর চেয়ে কম দুঃশাসন, অরাজকতা যখন দেশে ছিল, তখন জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। অথচ আজকে এত অন্যায়, অনাচার হচ্ছে।  আর কত সর্বনাশ দেখার জন্য আমরা অপেক্ষা করব?’ অধ্যাপক আসিফ নজরুলও একই সুরে এ সরকারকে স্বৈরশাসক অভিহিত করেছেন এবং আন্দোলনের মাধ্যমে এখনও সরকার ক্ষমতাচ্যুত না হওয়ায় অনেক দুঃখ পেয়েছেন।
যার হাত ধরে বাঙালি মুক্তির স্বপ্ন দেখতে শিখেছিল, যার হাত ধরে বাঙালি একটি স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছে, বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার প্রাণভোমরা জাতির সেই স্থপতিকে যারা সপরিবারে হত্যা করলো, সে খুনিদের বয়ান মতে খুনিদের যিনি উৎসাহিত করেছিলেন, শাসক হিসাবে তাদের পুরস্কৃত করেছিলেন, খুনের বিচার সাংবিধানিকভাবে বন্ধ করেছিলেন, জাতির পিতার নাম-নিশানা মুছে দিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে তার নাম উচ্চারণ পর্যন্ত নিষিদ্ধ করেছিলেন, প্রহসনের বিচারে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহেরসহ শত শত মানুষকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেছেন, স্বাধীনতা ও বাংলাদেশবিরোধীদের রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসন করেছেন ও মন্ত্রী বানিয়েছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের চলমান বিচারকাজ বন্ধ করেছিলেন ও দণ্ডপ্রাপ্তদের মুক্ত করে দিয়েছিলেন, অর্থ-বিত্ত ও পদ-পদবির লোভ দেখিয়ে রাজনীতিকে কলুষিত করে রাষ্ট্র ও রাজনীতির স্থায়ী ক্ষতি করেছিলেন, তা কি দুঃশাসন ও অরাজকতা ছিল না? দলীয় কার্যালয়ে বসে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে পরিকল্পিতভাবে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলা, লক্ষ্যভ্রষ্ট গ্রেনেড হামলায় ২৪জন নেতাকর্মীকে হত্যা, অপরাধীদের আড়াল করতে ফরমায়েশি তদন্ত কমিটি গঠন করে গ্রেনেড হামলার সঙ্গে পাশ্ববর্তী দেশকে জড়িয়ে আজগুবি তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি, জজ মিয়া নাটক সাজিয়ে গ্রেনেড হামলার অপরাধীদের বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেওয়ার অপচেষ্টা, আপিল বিভাগে কারসাজি করে বঙ্গবন্ধু হত্যার চূড়ান্ত বিচার পাঁচ বছর ধরে রুদ্ধ করে রাখা কি অরাজকতা, দুঃশাসন ছিল না? আগুন আন্দোলন করে যে শতাধিক মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করা হলো, এটি কি অরাজকতা নয়? রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা, সভা-সমাবেশে বাধা দেওয়া, দুর্নীতি লুটপাট কি শুধু এ সরকারের সময় হয়েছে? না এটি আমাদের রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে সব সরকারের সময়ই কম-বেশি হয়েছে?
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী আরও মারাত্মক কথা বলেছেন।  তিনি বলেছেন, ‘আমি তো দেশে গণতন্ত্র দেখি না, দেখি একনায়কতন্ত্র।  একজনের ইশারা ছাড়া গাছের পাতাও নড়ছে না’।  অন্যদিকে, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, ‘দেশে যে গণতন্ত্র আছে, তা ভেজাল।  যেখানে ভেজাল, সেখানে কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে আইনের শাসন? এই ভেজাল গণতন্ত্র থেকে মুক্তি পেতে হলে দরকার সম্মিলিত চেষ্টা’।  এ চারজনের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে একটি বিষয় স্পষ্ট হয় যে, একই মতবিনিময় সভায় কেউ বলছেন দেশে স্বৈরশাসন ও গাছের পাতাকে কথা শোনানোর মতো একনায়কতন্ত্র চলছে, আর কেউ বলছেন গণতন্ত্র আছে, তবে তা ভেজাল বা ত্রুটিযুক্ত।  এ ত্রুটি সারাতে পারলেই অনেক সাধের গণতন্ত্র আবার পূর্ণাঙ্গ অবয়বে হাজির হবে বাংলার জমিনে।  তার মানে সরকারের চরিত্র নিয়ে বক্তাদের মধ্যেই মতের অমিল রয়েছে।  ত্রুটিযুক্ত গণতন্ত্রের উপস্থিতিতে কেমন করে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে?
এবার দেখা যাক এ সরকারকে নিয়ে অন্যেরা কী বলছেন।  যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী দৈনিক ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ২০০৬ সাল থেকে বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোকে চারটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে গণতন্ত্রের র‌্যাংকিং প্রকাশ করে আসছে। ক্যাটাগরি চারটি হলো পূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, হাইব্রিড শাসন ও কর্তৃত্বপূর্ণ শাসন।  ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গণতন্ত্র সূচকে ২০১৫ সাল থেকেই বাংলাদেশ হাইব্রিড ক্যাটাগরিতে অবস্থান করছে।  ২০১৫ সালে ৮৬তম অবস্থানে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪তম আর ২০১৮ সালের ৩০ জানুয়ারি প্রকাশিত সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৯২তম।  ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ২০১৭ সনের প্রতিবেদনে ১৬৭ দেশের র‌্যাংকিং প্রকাশ করেছে।  র‌্যাংকিং অনুযায়ী ১-১৯ পর্যন্ত পূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশ, ২০-৭৬ পর্যন্ত রাষ্ট্রগুলো ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক, ৭৭-১১৫ পর্যন্ত তালিকার দেশগুলো হাইব্রিড, আর ১১৬-১৬৭ পর্যন্ত তালিকাভুক্ত রাষ্ট্রগুলো কর্তৃত্বপূর্ণ শাসনের অধীন।  এর অর্থ হলো ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশ স্বৈরশাসনের তালিকাভুক্ত নয়।  যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে জরিপ ও গবেষণা করে আসছে দীর্ঘদিন যাবত। বাংলাদেশেও ২০০৮ সাল থেকে জরিপ পরিচালনা করে আসছে সংস্থাটি।  ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত আইআরআই ধারাবাহিকভাবে সিরিজ গবেষণা ও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ওপর জরিপ পরিচালনা করেছে। সর্বশেষ জরিপের ফল প্রকাশিত হয়েছে এই বছরের এপ্রিল মাসে।  প্রত্যেকটি গবেষণা ও জরিপের ফল শেখ হাসিনা ও তার সরকারের জনপ্রিয়তার ইঙ্গিত দিচ্ছে।  এসব জরিপের শিরোনাম হচ্ছে ‘শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে’, ‘শেখ হাসিনা দলের চেয়ে বেশি জনপ্রিয়’, ‘শেখ হাসিনার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে’, ‘শেখ হাসিনার সরকার সঠিক পথে চলছে’ ইত্যাদি।  আইআরআই-র পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশি জনগণের আওয়ামী লীগ এবং দলের প্রধান শেখ হাসিনার প্রতি দৃঢ় সমর্থন ও ব্যক্তিগত ভালোবাসা রয়েছে।  তাদের এই আদর্শভিত্তিক আবেগপ্রবণ ভালোবাসার পেছনে দু’টি কারণ লক্ষ করা গেছে।  এর একটি হচ্ছে—স্থানীয় পর্যায়ে ব্যাপক উন্নয়ন, অন্যটি হচ্ছে শেখ হাসিনা ও তার দলের ইতিহাস।  আর এই দুইয়ের সমন্বয়ই তৈরি করেছে আওয়ামী লীগের প্রতি জনগণের টেকসই সমর্থন।  এপ্রিলে প্রকাশিত সর্বশেষ জরিপ রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়, আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির মূল কারণ হচ্ছে তিনি দেশবাসীর জীবনমান উন্নয়নের জন্য প্রচুর কাজ করেছেন এবং তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।  এ ছাড়া জরিপে অংশ গ্রহণকারীরা নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা, নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষার বিস্তার, নেতৃত্ব এবং ব্যক্তিগত শিক্ষা ও দেশপ্রেমের জন্য শেখ হাসিনার প্রশংসা করেছেন। 
বৈশ্বিক রাজনীতির আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘পিপলস অ্যান্ড পলিটিকস’ ১৭৩ জন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে অনুসন্ধান করে যে ফল প্রকাশ করেছে, তাতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে বিশ্বের তৃতীয় সৎ ও পরিচ্ছন্ন সরকার প্রধান এবং বিশ্বের চতুর্থ কর্মঠ সরকার প্রধান হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।  ওই অনুসন্ধানে সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন ও সৎ সরকার প্রধান বিবেচিত হয়েছেন জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল।  দ্বিতীয় হয়েছেন সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন।  পিপলস অ্যান্ড পলিটিক্সের গবেষণা অনুযায়ী বিশ্বে সবচেয়ে পরিশ্রমী রাষ্ট্রপ্রধান হলেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।  দ্বিতীয় পরিশ্রমী হিসেবে বিবেচনা তারা করেছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানিকে।  তৃতীয় পরিশ্রমী রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান হলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান। চতুর্থ কর্মঠ সরকার প্রধান হলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।  পিপলস অ্যান্ড পলিটিকস বিশ্বের ৫ জন সরকার রাষ্ট্রপ্রধানকে চিহ্নিত করেছেন, যাদের দুর্নীতি স্পর্শ করেনি, বিদেশে কোনও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই, উল্লেখ করার মতো কোনও সম্পদ নেই।  বিশ্বের সবচেয়ে সৎ এই পাঁচজন সরকার প্রধানের তালিকায় তৃতীয় স্থানে আছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সিঙ্গাপুরভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘দ্য স্ট্যাটিসটিক্স ইন্টারন্যাশনাল’ সম্প্রতি তাদের এক জরিপে বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বেছে নিয়েছে।  এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, দক্ষ নেতৃত্ব, রাষ্ট্রনায়কোচিত গুণাবলি, মানবিকতা ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবায়নসহ ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত থাকার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচন করে।  শেখ হাসিনা অন্তত পক্ষে ৩০টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও পদকে ভূষিত হয়েছেন।  এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সর্বোচ্চ পুরষ্কার ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ, ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন ও তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নে বিশেষ অবদানের জন্য জাতিসংঘ ‘আইসিটি টেকসই উন্নয়ন পুরস্কার’, নারী ও শিশু শিক্ষা উন্নয়নে বিশেষ অবদানের জন্য ইউনেস্কো ‘শান্তিবৃক্ষ পদক’ পুরস্কার, দারিদ্র্য, অপুষ্টি দূর করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করায় জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)-র ‘ডিপ্লোমা অ্যাওয়ার্ড পদক, ক্ষুধার বিরুদ্ধে আন্দোলনের স্বীকৃতিস্বরূপ এফএও কর্তৃক ‘সেরেস পদক’, ‘মাদার তেরেসা পদক’, ইংল্যান্ডের হাউস অব কমন্সের স্পিকার এর ‘গ্লোবাল ডাইভারসিটি এ্যাওয়ার্ড’, জাতিসংঘ ‘মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল অ্যাওয়ার্ড’  যুক্তরাষ্ট্রের ‘পার্ল এস বাক পদক’ ও  অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি,  জাপানের বিখ্যাত ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়সহ আধা ডজন বিশ্ববিদ্যলয়ের সম্মানসূচক ‘ডক্টর অব লজ’ ও ‘ডি লিট’ ডিগ্রি। সম্প্রতি শেখ হানিা নারী নেতৃত্বে সফলতার স্বীকৃতি হিসেবে সম্মানজনক ‘গ্লোবাল উইমেনস লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন।
সিনিয়র সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহ বলেছেন, ‘আইনের শাসন ও গণতন্ত্র নিয়ে দেশে অনেক আলোচনা হয়েছে।  দেশে এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে।  আতঙ্কের কারণে মানুষ কথা বলতে পারছে না, মানুষ রাস্তায় নামছে না।  কেমন যেন একটা ভীতির চাদর বিছানো চারপাশে।’ আসিফ নজরুলও একইভাবে বলেছেন, ‘যারা ভিন্নমতের, সরকারের সমালোচনা করেন, তাদের বেলায় আইনের অপপ্রয়োগ হয় ঠিকই।’ মতবিনিময় সভায় তো এ দু’জনসহ সব অলোচকই সরকারের কট্টর সমালোচনা করলেন, আতঙ্কিত হয়ে সরকারের প্রশংসা করতে তো দেখলাম না।  আতঙ্কের কারণে মানুষ যেখানে কথাই বলতে পারছে না, পত্রিকায়, টক শো-তে  সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহ, অধ্যাপক আসিফ নজরুল তো হামেশাই সরকারের কড়া সমালোচনা করছেন।  তাদের তো আতঙ্কিত হতে দেখিনি।  তাহলে তাদের দু’জনের সঙ্গে সরকারের কি কোনও গোপন সমঝোতা রয়েছে?
প্রেসক্লাবের সভার শিরোনাম হচ্ছে ‘সর্বগ্রাসী লুণ্ঠন বাংলাদেশের বিপুল সম্ভাবনাকে ধ্বংস করেছে’।  সম্ভাবনা ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটি দেশকে জাতিসংঘ কিভাবে স্বল্পোন্নত থেকে প্রমোশন দিয়ে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা দিলো?  গোল্ডম্যান স্যাকসের মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতি আশু সম্ভাবনার সর্বোচ্চ ১১টির মধ্যে রয়েছে।  ফ্রান্সভিত্তিক বাণিজ্যিক ঋণ ও বিমা গ্রুপ কোফেইস এর গবেষণায় অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ব্রিকস (ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চীন ও সাউথ আফ্রিকা) রাষ্ট্রগুলোকে পেছনে ফেলে বিশ্বের সম্ভাবনাময় সেরা ১০টি দেশের তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের নাম।  জেপি মর্গান এক কদম এগিয়ে দেশটিকে অগ্রসরমাণ দেশগুলোর মধ্যে ফ্রন্টিয়ার ফাইভে উন্নীত করেছেন।  সিটি গ্রুপের উৎসাহব্যঞ্জক গবেষণা অনুযায়ি বাংলাদেশ এখন থ্রিজি অর্থাৎ থ্রি গ্লোবাল গ্রোথ জেনারেটর গ্রুপে।  সিএনএন মানির এক পূর্বাভাসে বলা হয়েছে ২০১৯ সালে প্রবৃদ্ধিতে দ্বিতীয় হবে বাংলাদেশ।  'ওয়ার্ল্ডস লারজেস্ট ইকোনমিস' শীর্ষক এই পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ৯ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে ২০১৯ সালে সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশের তালিকায় প্রথম স্থানে থাকবে ইরাক।  ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে বাংলাদেশ থাকবে দ্বিতীয় অবস্থানে। খোদ জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংক এখন বিভিন্ন সদস্য দেশকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অনুসরণ করতে বলছে।  নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের সরল স্বীকারোক্তি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বকে চমকে দেওয়ার মতো সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ।  বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিমের মতে, বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের উচিত কিভাবে দারিদ্র্য দূর করতে হয়, তা বাংলাদেশের কাছ থেকে শেখা।  তার মতে, টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে এ দেশ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের কাছে অনুকরণীয় হতে পারে।  বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রশংসা করে জিম ইয়ং কিম বলেছেন, ধারাবাহিকভাবে ৬ শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা বিশ্বে বিরল।
এদিকে, গত ৩ মে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ৫১তম বার্ষিক সভায় সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট তাকিহিকো নাকাও বাংলাদেশের ও বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ গত দশ বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি দ্বিগুণ করেছে।  অর্থনীতিতে ঈর্ষনীয় সাফল্য অর্জন করেছে।  বাংলাদেশের প্রকৌশলীরা মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার মতো শীর্ষস্থানীয় জায়গায় কাজ করছে।  এটি অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য গর্বের বিষয়।  দেশটিতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন ও দারিদ্র্যবিমোচনে অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার।’ তিনি আরও বলেন, ‘গত ফেব্রুয়ারিতে আমি বাংলাদেশ সফরে গিয়ে সেখানকার স্থানীয় ও প্রান্তিক পর্যায়ের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো, অর্থনৈতিক উন্নয়নের অগ্রগতি দেখে এসেছি, সত্যিই সেটা অভানীয় ও ঈর্ষণীয়।  শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উচ্চ ধারা এশিয়ার অনেক দেশের জন্যই শিক্ষণীয়।  এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার দেশ হিসেবে বাংলাদেল সবার জন্য অনুকরণীয়।’ জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, এডিবি কিংবা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বিষয়ে পূর্বাভাসদাতা কোনও সংস্থা আওয়ামী লীগের অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন নয়।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, ‘আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীককে ফেল করাতে হবে।  নৌকা এবার তলিয়ে যাবে।  আর ভাসবে না।  এ জন্য সবাইকে এক হতে হবে।’ আসিফ নজরুল বলেছেন, ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে বাংলাদেশের সংবিধানও থাকে না, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও থাকে না।’ আর কামাল হোসেন বলেছেন, ‘নির্বাচন হলে ১০ শতাংশের বেশি ভোট ক্ষমতাসীন দল পাবে না।’ তাদের সবার বক্তব্যে একটি বিষয় সুস্পষ্ট যে, সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবির আড়ালে এদের গোপন এজেন্ডা হলো, যেকোনও মূল্যে নৌকার পরাজয়। তাহলে কে ক্ষমতায় আসবে? বিএনপি? বিএনপি যদি সরকার গঠন করে, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ হবে? বঙ্গবন্ধু কি জাতির পিতা থাকবেন? বাঙালির মুক্তির সনদ ৬-দফা দিবস ও বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ ৭ই মার্চ রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হবে? বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘেষণাপত্র যেখানে বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসাবে উল্লেখ করেছে, তা নিশ্চিত করা হবে? যে মুজিবনগর সরকারের হাত ধরে বাংলাদেশের গোড়াপত্তন, সে সরকারের স্বীকৃতি ও মুজিবনগর দিবস উদযাপন করা হবে? মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র—‘জয় বাংলা’ উচ্চারিত হবে? যদি না হয়, এবং নিশ্চিত করেই বলা যায় তা হবে না, তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন হলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার নিশ্চয়তা আছে?
একজন রাজনীতিবিদ সম্পর্কে জনশ্রুতি—আছে তিনি সরব হলে কিংবা হঠাৎ গায়েব হয়ে গেলে একটা কিছু ঘটার ইঙ্গিত বহন করে।  বাংলাদেশের শনির দশা নেমে আসে।  তিনি সরব হয়েছেন। বালাইষাট।  সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হোক, আর সমৃদ্ধ সোনার বাংলার পানে যাত্রা আব্যাহত থাকুক।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

ই-মেইল: zhossain@justice.com