ফার্সি সুফিবাদী সাধকেরা যেমন, শরিয়তি হিংস্রতা থেকে বাঁচার জন্যে প্রতীকী ভাষার আশ্রয় নিয়েছিলেন, বাংলার বাউল-ফকিরদেরও তাই করতে হয়েছে সংঘাত এড়ানোর জন্যে। সুফিবাদের জন্ম খিলাফতের সময় থেকেই, অর্থাৎ অন্তত তেরো শ’ বছর আগে। আমাদের চর্যাপদের জন্ম তার শ’ দুয়েক বছর পরেই। এ থেকে এটাই বোঝা যায় যে, ভাববাদী সাধকদের সঙ্গে, বিশাল বস্তুবাদী সমাজের সংঘর্ষ চিরকালীন। মানুষকে একটি শৃঙ্খলা অথবা শৃঙ্খলে বাঁধার প্রচেষ্টায় যত কড়াকড়ি আরোপিত হয়েছে, ভিন্নমতের সাধকদের ততবেশি গোপনীয়তার আশ্রয় নিতে হয়েছে।
লালন সাঁইজিকে সাধারণভাবে বাউল হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বাউল ও বৈষ্ণব যে এক নয়, তা বোঝাতে, দুদ্দুশাহকে গানের ভেতর দিয়ে তা প্রকাশ করতে হয়েছে। কিন্তু মজার বিষয় হলো, লালন সাঁইজি তার সমগ্র রচনার ভণিতায় একবারও নিজেকে বাউল বলে উল্লেখ করেননি। বরং বহু গানের ভণিতায়, ফকির লালন অথবা লালন ফকির হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তা হলে কি বাউল ও ফকির এক নয়? আসলে, লালন সাঁইজি প্রচলিত ধর্মভেদ, জাতপাতের বিচার, আশরাফ, আতরাফ ইত্যাদি সব মুছে দিয়ে, মানুষমাত্রেই এক হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। আর বলতে চেয়েছেন, এই মানুষেই সব বর্তমান। তাহলে কি তিনি ধর্মদ্রোহী ছিলেন? তাই যদি হবেন তবে—আল্লাহতত্ত্ব, নবীতত্ত্ব, কৃষ্ণতত্ত্ব, গৌরতত্ত্ব কেন আসবে তাঁর গানে? তবু সবকিছু ছাড়িয়ে, আত্মতত্ত্বই তাঁর গানের অথবা সাধনের প্রধান বিষয়।
‘আপন ঘরের খবর নে না’, বা ‘আপনারে চিনতে পারলে রে, যাবে অচেনারে চেনা’, ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’, ‘বাড়ির কাছে আরশিনগর’ এই সব অতিপ্রচলিত গানগুলো বিশ্লেষণ করলেই, আত্মা ও পরমাত্মার মিলনের যে পথ অনুসরণ করেছেন, তা অনেকাংশে বোঝা যাবে। তার সাধনপদ্ধতি আমার আলোচ্য বিষয় নয়। আমার আলোচ্য বিষয় সেই লালন সাঁইজিকে নিয়ে, যার গানের বাণী শুনে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বলে উঠেছিলেন, ‘কে এই নিরক্ষর মহাকবি?’
রবীন্দ্রনাথের ওপর লালনের প্রভাব পড়েছিল, এ কথা অনেক বিজ্ঞজন আলোচনা করেছেন। হয়তো বা ছিলও। কিন্তু আমার মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের গভীর গোপনে আজন্ম এক বাউলচেতনা সুপ্ত ছিল। এটা নিয়েই পরের পর্বে লিখতে চাই।
লেখক: কবি ও কলামিস্ট