জার্মানি, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, স্পেন, পর্তুগালসহ বেশকিছু দেশের পতাকায় ছেয়ে গেছে দেশের আকাশ। বিশেষ করে ব্রাজিল-আর্জেন্টিয়ায় বিভক্ত দেশ। ঘরে-বাইরে-অফিসে আড্ডায় ব্রাজিল আর্জেন্টিনার গোত্র তৈরি হয়ে গেছে। বিশ্বকাপ খেলা দেশের জার্সি দাপুটে ভাবে দখল নিয়েছে এবারের ঈদ ফ্যাশনে। ছেলে-মেয়ে উভয়ের পোশাকেই। ছাদে, গাড়িতে পতাকা উড়ছে, মহল্লার দেয়ালে পতাকা ও তারকা খেলোয়াড়ের পতাকা আঁকা হয়েছে। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার রঙে বদলে ফেলা হয়েছে বাড়ির রঙ। দেয়াল, ছাদ দখল নিয়ে ঘরে, মহল্লায় সম্প্রীতির বদলে রঙ-রূপই বেশি। বাড়িতে মহল্লায় যে পক্ষের শক্তি বেশি, তারাই ছাদ ও দেয়ালের দখল নিচ্ছে। কেবল দখলই না অন্যপক্ষকে খেলা নিয়ে, নিজ দল নিয়ে উচ্চারণের সুযোগই দিতে চান না তারা। এই আচরণ পরিবারের মধ্যে, বন্ধুদের মধ্যেও ঘটছে। শুধু কথা বলতে না দেওয়ায় নয়, এক পক্ষ অন্যপক্ষকে আক্রমণ করছে বিদ্বেষের সঙ্গে। দেশ, নির্দিষ্ট খেলোয়াড়ের ব্যক্তিগত জীবন পেরিয়ে যিনি বা যারা দলটিকে সমর্থন করছেন, হেয় করা হচ্ছে তাদেরও। আমরা ফেসবুকের দেয়ালেও এই উন্মাদপনা দেখতে পাচ্ছি। এবার ঈদলগ্নে আর্জেটিনা-ব্রাজিলের খেলা থাকায় ঈদ উদ্যাপনের চেয়ে ফেসবুকে দুই পক্ষের বিদ্বেষ লড়াই দেখা যাচ্ছে। একপক্ষ, অন্যপক্ষকে আক্রমণ করার ধরন দেখে বোঝা যাচ্ছে সহিষ্ণুতা থেকে কত দূরে চলে যাচ্ছি আমরা। ব্যক্তিগতভাবে আমরা মস্তিষ্ক ও মননে কতটা বর্ণবাদ পুষে রাখি, তা দেখা যাচ্ছে ফেসবুকে। লাতিন আমেরিকা বা ইউরোপের দেশ নিয়ে এতটা উন্মাদপনা বা বাড়াবাড়ি আর কোনও দেশে আছে কিনা জানি না, তবে বাংলাদেশের সমর্থকদের এই উন্মাদনা কোনও কোনও দলের নিজ দেশেই নাকি নেই। ফুটবল নিয়ে আবেগ, ভালোবাসার বিপক্ষে নই আমি। তবে, ব্যাপারটি মাত্রা ছড়িয়ে যাওয়াতেই আপত্তি। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল যখন বিশ্বকাপে খেলছে তখন কতজন তার বাড়ি লাল-সবুজে রাঙিয়েছেন। দেশের আকাশ জাতীয় পতাকায় কতটা ঢাকা পড়ে, সেই হিসাব কষে দেখতে গিয়ে লজ্জিত হই। আরও বিস্মিত হয়ে যাই যখন দেখি, যেই দেশটিকে সমর্থন করা হচ্ছে সেই দেশ সম্পর্কে সমর্থকের কোনও জানাশোনা নেই। কোন মহাদেশের দেশ এটিও ঠিক জানেন না অনেকেই। তার চেয়েও বড় কথা মেসি, নেইমার ছাড়া দলের অন্য খেলোয়াড়ের পরিচয় নেই বড় একটি অংশের। তবে কেন সমর্থন? আশপাশের সবাই করছে তাই।
প্রতি বিশ্বকাপে আরেকটি গোত্র পাওয়া যায়। তাদের মন ও মস্তিষ্কে কোনও একটি দলের প্রতি সমর্থন আছে ঠিকই। কিন্তু পরিবার, মহল্লা, বন্ধুমহল ও কাজের জায়গায় কোনদিক দলে ভারী ও বিশেষ কোনও ব্যক্তি কোন দলটি করছেন বা কোন দলের হয়ে কথা বললে নগদ ফায়দা মিলবে, সেই দল সমর্থন করেন তারা। অতএব বাড়ি, অফিস ও সমাজে তাদের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান আছে। আমাদের রাজনীতির সমর্থনের বেলাতে সমাজ ও রাষ্ট্রেও আমরা এমন মুখোশ মানুষ দেখতে পাই। ফুটবল-ক্রিকেটের এমন আসরগুলোর মধ্য দিয়ে আমরা এমন মানুষগুলোকে আরও জ্বলজ্বলে দেখতে পাই। কিংবা নিজেরাই নিজেদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ি হয়তো। তবে যদি বলি আনন্দের কথা। আনন্দ কিন্তু তাকেই বলে, যে আনন্দে উপভোগের আগ্রাসন নেই। আছে সর্বজনীনতা।
লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি