স্কুলে পড়ার সময় পাড়ার কলেজ পড়ুয়া আর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বড় ভাই ও আপাদের সুন্দর মনে হতো। এই সুন্দর তাদের অবয়বের সৌন্দর্য নয়। তাদের পথচলার গতি ও কথা বলার অভিব্যক্তির সৌন্দর্য আমাকে আকৃষ্ট করতো। এই সুন্দরের অভিযাত্রীদের কণ্ঠে ছিল স্লোগান। রাজনৈতিক আদর্শে মুখরতা ছিল যাদের চোখেমুখে, সেখানে এখন অদ্ভুত আঁধার। সেই আঁধারই দেখতে পাচ্ছি বেশি। তবে সেই আঁধারঘেরা সত্য কিন্তু সুন্দরকে নয়, মিথ্যে ও অসুন্দরকেই দেখাচ্ছে স্পষ্ট।
সত্যি বলতে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোর এখন আর কোনও আদর্শিক স্লোগানে মুখরিত হয় না। তারা মুখর থাকে কিংবা তাদের মন জপতে থাকে কোনও না কোনও নেতার নাম। তারা জপতে থাকে প্রাপ্তি সংখ্যা। কত দখল হলো, পকেট উপচে উঠতে আর কত বাকি, এসব নিয়েই মাতামাতি হয়। ক্ষমতাবলয়ের আশেপাশে যারা থাকে, সেই তরুণ-তরুণীরা না হয় প্রাপ্তিযোগের নামতা পড়ছে। অন্যরা তাহলে কি আদর্শিক স্লোগানে মুখর রেখেছে শিক্ষাঙ্গন কিংবা দেশ? আমার কাছে মোটেও তা মনে হয় না।
যারা রাজনীতি করছেন তারা কোনও না কোনও প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত। ব্যক্তির ভাগ-বাটোয়ারার পাশাপাশি দলকে ক্ষমতায় নেওয়ার স্বার্থ আছে। এই রাজনীতিবিদরা ছাত্রছাত্রী বা তরুণগোষ্ঠীকে ওই প্রকল্পগুলোর কর্মী হিসেবে ব্যবহার করছেন। একেকটি ক্ষণস্থায়ী প্রকল্প। উদ্দেশ্যবিধেয় শেষ প্রকল্পও ‘ফুড়ুৎ’। এরা ছাত্রছাত্রীদেরকে রাজনীতির দীর্ঘ অনুশীলনে নামাতে চান না। চোখে কোনও আদর্শের বীজ বুনে দিতে চান না। তারা তরুণদের চোখে পরিয়ে দিচ্ছেন অস্থায়ী ব্যবহারের লেন্স। সেই লেন্সধারীদেরকে দেখে আসছি— ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের নামে ক্ষমতাবলয়ের বিভিন্ন প্রকল্পের পার্টটাইম কর্মী হিসেবে নিরন্তর ঘাম ঝরাচ্ছেন। সেই ঘামের বিনিময়ে কিন্তু তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার তৈরি হচ্ছে না।
আদর্শিক ক্যারিয়ারের বিষয়টি এখন অবশ্য অচল। কারণ কোনও পেশা বা চাকরিতে আদর্শের প্রয়োজন নেই। অচল হয়ে পড়েছে জ্ঞানচর্চাও। কয়েক পাতা তথ্য বা গাইডে চোখ বুলিয়ে নিলেই চাকরির প্রতিযোগিতায় নেমে পড়া সম্ভব। আর চাকরি বলতেই আমাদের তরুণদের বড় একটি অংশ সরকারি চাকরিকেই জেনেবুঝে আসছে। বেসরকারি খাতেও যে চাকরির বড় বাজার পড়ে আছে, সেদিকে তাদের আগ্রহ নেই। না থাকার বড় কারণ বেসরকারি চাকরির লড়াইটা আরও শক্ত। চাকরি পাওয়ার পর টিকে থাকার যুদ্ধ আরও চ্যালেঞ্জের। আমাদের তরুণরা সেই চ্যালেঞ্জ নিতে চাইছে কই? কিছু তরুণ নিজেরাই উদ্যোক্তা হয়ে মাঠে নামলেও তাদের পেছনে ভিড় কই? সবাই তো সরকারি চাকরির পেছনেই ছুটছে। কোটা থাকুক কিংবা না থাকুক, সরকারি চাকরির সোনার হরিণই যেন তাদের চাই।
দেশ বিভিন্ন সংকটের মুখে পড়ে। সেই সংকট থেকে দেশ ও জাতিকে বের করে নিয়ে আসার জন্য পথে নামে ছাত্র সংগঠন। তারাই মুক্তির পথ দেখায়। বায়ান্ন থেকে একাত্তর। তারপর নব্বই। এই উদাহরণগুলো সামনে রেখে আমরা গৌরববোধ করি। এই সময়কাল ছিল আদর্শিক রাজনীতির। এখনকার ছাত্র সংগঠনের সামনে সেই স্মৃতিচারণ করে আমরা মানসিক সুখবোধ করি। কিন্তু আমাদের ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল সেই গৌরবে প্রণোদিত হোক তা চাই না। আমরা চাই, তারা আমাদের বিভিন্ন প্রকল্পের কর্মীই থাকুক।
সাম্প্রতিক কোটাবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রলীগের ভূমিকা নিয়ে যে অভিযোগগুলো উঠে আসছে, তারা আন্দোলনকারীদের প্রতিপক্ষ হিসেবে যে দাঁড়াচ্ছে, তা কিন্তু নিজেদের দায় থেকে নয়। তাদেরকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। ব্যবহার করা হচ্ছে কোনও না কোনও প্রকল্পের প্রয়োজনে। আবার কোটাবিরোধী আন্দোলনে যারা মাঠে পড়ে আছেন, সেই শিক্ষার্থীদের পেছনে কি কোনও প্রকল্প নেই? আছে। আমাদের শিক্ষার্থীরা মূলত কোনও আদর্শের সঙ্গে নেই। কোনও শুদ্ধ রাজনীতির সঙ্গে নেই। আছে প্রকল্পকর্মী হিসেবে। আমি এই কর্মীদের চাকরিচ্যুতি বা ছাঁটাইয়ের দাবি জানাই। এই ছাঁটাই দাবির আন্দোলন জোরদার হোক।
লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি