সৌদি নারীর স্বাধীনতা এবং আমাদের নারী শ্রমিক

বিনয় দত্তমধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে আলোচিত খবর সৌদি নারীদের স্বাধীনতার দ্বার উন্মোচন হচ্ছে। নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি, ফুটবল মাঠে বসে খেলা দেখার অধিকার এবং সরাসরি সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার সুযোগ– এই কথা সৌদিতে কিছুদিন আগে অলীক মনে হলেও এখন অনেকখানি সম্ভব। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের নেতৃত্বে এইসব সম্ভব হচ্ছে ধীরে ধীরে।
তেলভিত্তিক অর্থনীতির ওপর নির্ভরতা কমাতে সৌদি সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছেন। এরমধ্যে পর্যটন ও শিল্পায়নে গুরুত্ব দেওয়া, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা, আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি আর নারীদের অধিকারের বিষয়ে ধাপে ধাপে অনেকটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এরমধ্যে যে ঘটনা সবচেয়ে বেশি আলোচিত, তা হলো সৌদি নারীদের গাড়ি চালানো। যেহেতু সৌদিতে পুরুষ গাড়িচালকরা এতদিন গাড়ি চালাতো, তাতে করে প্রচুর প্রবাসী শ্রমিক সৌদিতে গাড়ি চালকের কাজ পেত।
প্রবাসীরা শ্রমিক হয়ে সৌদিতে আসে, এতে সৌদির অর্থ বাইরে চলে যায়। নিজেদের অর্থনীতিকে আরো উন্নত করতে বর্তমান যুবরাজ পর্যটন, শিল্প এবং নারী স্বাধীনতাকে প্রধান করে বেশকিছু পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। তারমধ্যে নারী স্বাধীনতার বিষয়টি বেশ চমকপ্রদ। যে দেশে নারী অবহেলিত সেই দেশে নারী স্বাধীনতা বিষয়টি বেশ চাঞ্চল্যকর।

সৌদির এই উদারতা, নারীদের নিয়ে এতো উদার ভাবনা, নারীদের স্বাধীনতার বিষয়ে বিশেষভাবে নজর দেওয়া এই বিষয়গুলো সবাই যেভাবে প্রশংসা করছেন আমি ততটা করতে পারছি না। এর কারণ অবশ্য বিশদ।

বছর তিনেক আগে আমি একটি বিশেষ কাজে কিছু সৌদিআরব ফেরত নারীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম। যে নারীরা আমাদের দেশ থেকে প্রবাসী নারী শ্রমিক হিসেবে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে কেউ অল্প শিক্ষিত, কেউবা একদমই অশিক্ষিত। দুই শ্রেণিই মিলানো মিশানো ছিল। শিক্ষার দিক থেকে এদের দুই শ্রেণিতে আলাদা করা গেলেও একটা বিষয়ে তাদের সবার মধ্যে মিল ছিল। তা হলো, এরা সবাই ভয়ানক নির্যাতনের শিকার। কেউ শারীরিক, কেউ ভয়ানক মানসিক, কেউ আবার পাশবিক নির্যাতনের শিকার।

সৌদি আরবে নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের কথা আমরা কম বেশি সবাই জানি। এই বৈষম্য আসলে কতটা সহনশীল বা সহ্য করার মতো? তাদের গল্প শুনে আমি নিশ্চুপ ছিলাম অনেকক্ষণ। আমি এই গল্প কাউকে বলতে পারবো না। শুধু এইটুকু বলি, একজন ৩৮-৪০ বয়স্ক নারী বাংলাদেশ থেকে গিয়েছিল পরিচারিকার কাজের জন্য। একদিন ভয়ানক অসুস্থাবস্থায় তাকে কয়েকবার জোর করে যৌন নির্যাতন করে একই পরিবারের বাবা, ছেলে এবং চাচা। আমি শুধু এইটুকু শেয়ার করছি। এর বেশিকিছু আমি আর বলতে চাই না। এরচেয়ে জঘন্য ঘটনা আমাকে শুনতে হয়েছে সেইসময়। এই ঘটনা শোনার পর থেকে আমার কয়েক রাত নির্ঘুম কেটেছে ভয়ে। মনে হচ্ছে আমি সেই নারীদের কান্না শুনতে পাচ্ছি। তাদের আর্তনাদ আমাকে তাদের ভেতরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

শুধু নারায়ণগঞ্জের মেয়ে স্বর্ণা’র কঠোর নির্যাতনের বর্ণনা শুনলেই আরও পরিষ্কার হবে সবার ধারণা। স্বর্ণাকে প্রতি মাসে ১০ থেকে ১২ দিন মারধর হজম করতে হতো। নির্যাতন সইতে না পেরে স্বর্ণা তিন মাস আগে পালিয়ে রিত্রুটিং এজেন্টের কাছে চলে যান। তারা তাকে সেখানে ৩ দিন কুকুরের সঙ্গে বেধে রাখে এবং খাবার দেওয়া প্রায় বন্ধ করে দেয়। আর তাকে দিনে মাত্র একবার খাবার দিত।

২.

মানুষ এত বর্বর হতে পারে তা আমি ভাবতেও পারি না। শুধু বর্বরই নয়, নিষ্ঠুরতম বর্বরতা, নির্যাতন সহ্য করে আমাদের মেয়েদের সেখানে টিকে থাকতে হয় এবং হচ্ছে। এর থেকে উত্তরণের পথ হয়তো খোলা আছে, কিন্তু কেন এর থেকে উত্তরণ পাওয়া যাচ্ছে না তা আমি জানি না।

কেন প্রতিবার কাজের কথা বলে আমাদের মেয়েদের নিয়ে শারীরিক, পাশবিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়? কেনইবা এদেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো ভুল তথ্যদিয়ে নারীদের পাঠানোর পরও তাদের লাইসেন্স বহাল থাকে? কেন আমাদের দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় কঠোরভাবে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না? আমি এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই না।

তবে এই কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, তারা নারীদের ভোগবাদী চিন্তা থেকে বের হতে পারে না। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো তাদের চুক্তির শর্ত। একসময় সৌদিতে গৃহকর্মী হিসেবে শ্রমবাজার দখল করে ছিল ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কার নারীরা। কিন্তু উপর্যুপরি ভয়াবহ নির্যাতনের ঘটনার পর একপর্যায়ে সৌদি আরবে নারীশ্রমিক পাঠানো বন্ধ করে দেয় ওইসব দেশ। তখন মহাসংকটে পড়ে সৌদি ধনীরা।

বছর দশেক আগে প্রথম বাংলাদেশ থেকে নারী গৃহকর্মী নিতে চায় সৌদি আরব। সেই সময় সৌদিতে পুরুষকর্মী পাঠানো বন্ধ ছিল, তদবির করা হচ্ছে যাতে আবারো সেখানে পুরুষ শ্রমিকরা যাওয়ার সুযোগ পায়। অপরদিকে সৌদি আরব চাপ দিতে শুরু করে নারী গৃহকর্মী পাঠানোর জন্য।

অবশেষে  ২০১৫ সালে চুক্তি স্বাক্ষর হয়। প্রথমে ১৫০০ রিয়াল বেতনের কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত ৮০০ রিয়ালে, বা বাংলাদেশি মুদ্রায় মাত্র ১৬ হাজার ৮০০ টাকা বেতনে গৃহকর্মী পাঠাতে রাজি হলো বাংলাদেশ। এখন সেই বেতন দাঁড়িয়েছে বিশ হাজারে। এর কিছু দিন পর বাংলাদেশের পুরুষশ্রমিক নিয়োগের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করলো সৌদি আরব। এই সকল তথ্যই প্রমাণ করে দেয় সৌদিদের চিন্তাভাবনা।

সৌদিদের এই ভোগবাদী ভাবনার সুযোগ নেয় আমাদের দেশের কিছু রিক্রুটিং এজেন্সি, দেশীয় দালাল এবং প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ২০১৫ সালের দুর্বল শ্রমচুক্তি, দুই দেশের শক্তিশালী দালালচক্র এবং মন্ত্রণালয়ের সঠিক নজরদারীর অভাব।

বাংলাদেশি নারী শ্রমিকদের বিদেশযাত্রা শুরু হয় ১৯৯১ সালে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ব্যুরো অব ম্যান পাওয়ার এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং-এর সূত্র মতে, ১৯৯১ থেকে ২০১৮ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সৌদি আরবসহ কয়েকটি দেশে ৭ লাখ ২৪ হাজার ৬৩৬ জন নারীকর্মী বাইরে যান। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই গেছেন দুই লাখ ৩৪ হাজার ৮৩১ জন।

৩.

দেশের সঠিক কর্মসংস্থানের অভাব নারীদের এই দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সৌদিতে একদিকে নারী স্বাধীনতার জয়জয়কার আরেকদিকে আমাদের নারী শ্রমিকদের ভয়ানক নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার। তারমধ্যে বড় জটিলতা সৌদি ফেরত নারীদের দায় সরকারিভাবে কেউ নিচ্ছেন না। আমাদের দেশের নারীরা সুস্থসবল ভাবে দেশ থেকে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। দেশ থেকে যাওয়ার সময় তারা যা লোন করেছেন তা পরিশোধ করার আগেই তারা পঙ্গু বিধ্বস্ত এবং অসুস্থ হয়ে দেশে ফিরেছেন।

তারা নিজের অর্থনৈতিক অবস্থান উন্নত সহ দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করতে সৌদিতে গিয়েছেন। তারা যখন দেশে টাকা পাঠাতো তখন অবশ্যই সরকার এর সুবিধা নিয়েছে তাহলে কেন তাদের দুরবস্থায় সরকার তাদের পাশে থাকবে না? কেন সরকার দালালদের শক্তহাতে প্রতিহত করবে না? কেন রিক্রুটিং এজেন্সির প্রতি সরকারের সঠিক নজরদারী থাকবে না?

ব্র্যাকের তথ্য অনুযায়ী, নির্যাতনের কারণে তিন বছরে কমপক্ষে পাঁচ হাজার নারী সৌদি থেকে দেশে ফিরেছেন। চলতি বছরের প্রতি মাসে গড়ে ২০০ নারী শ্রমিক দেশে ফিরেছেন, শুধু নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদ এবং জেদ্দায় সেফ হোমগুলোতে প্রতিমাসে গড়ে ২০০ জন নারী শ্রমিক আশ্রয় নিচ্ছেন।

এই অবস্থা যদি চলতে থাকে এবং আমাদের মন্ত্রণালয়ের যদি জোরালো কোনও পদক্ষেপ না থাকে তবে দেশীর নারীদের আরও ভয়ানক নির্যাতনের শিকার হতে হবে। আর আমরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রুমে বসে গোটা দেশের স্খলন দেখতে থাকবো।

লেখক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক

benoydutta.writer@gmail.com