X
বুধবার, ০৮ মে ২০২৪
২৪ বৈশাখ ১৪৩১

‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে

আমীন আল রশীদ
২৬ এপ্রিল ২০২৪, ২১:১৭আপডেট : ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ২১:১৭

বছরের এই সময়ে, অর্থাৎ এপ্রিল মে মাসে গরম পড়বে—সেটি অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু প্রকৃতি যে মানুষের ওপর বিরূপ হয়েছে; বৈশ্বিক উষ্ণায়ন যে বাড়ছে এবং তার ফলে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ কী হবে, ২০০৪ সালেই সেটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন রোনাল্ড ইমেরিচ তাঁর বিখ্যাত ‘ডে আফটার টুমরো’ সিনেমায়। সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোরও এই সিনেমার নেপথ্যে ছিলেন—যিনি বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর ভয়াবহ সংকট নিয়ে বেশ সোচ্চার।

‘ডে আফটার টুমরো’ বলতে এই সিনেমায় মানুষকে সতর্ক করা হয়েছিল যে উন্নয়ন ও ভোগবাদিতার নামে প্রকৃতির বিরুদ্ধে তার নির্মম কর্মকাণ্ডের প্রতিশোধ প্রকৃতি গ্রহণ করবে। আর সেটি যে অনেক দূরে নয়, বরং আগামীকালই—এই সিনেমার মূল বার্তা এটিই। অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর মানুষ যে ভীষণ বিপদের মধ্যে পড়ে যাবে এবং তার জন্য যে একশ’ বছর অপেক্ষা করতে হবে না, বরং জলবায়ু পরিবর্তনের এই অভিঘাত যে অতি সন্নিকটে, অর্থাৎ আজ ও আগামীকালের দূরত্বেই এই বিপদ অবস্থান করছে, সেই বার্তাটুকু দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে এই সিনেমায়।

যদিও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে গত শতাব্দীর শেষ এবং এই শতাব্দীর শুরুর দিকে যখন বেশ কথাবার্তা শুরু হয়, তখন অনেকেই এটিকে হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন; ইগনোর করেছেন; কেউ কেউ বলেছেন ‘দিল্লি বহু দূর’ এবং যারা এই নিয়ে মানুষকে সচেতন করেছেন— তাদের অনেককে লোকে ‘পাগল’ বলেও অভিহিত করেছেন।

প্রখ্যাত পরিশেবিজ্ঞানী ড. আতিক রহমান ২০০৭ সালে আমাকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারেও একইরকম অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন, ‘আমরা যখন বিষয়টি নিয়ে কথা বলা শুরু করি, তখন অনেকেই এগুলোকে পাত্তা দিতে চাননি। কেউ কেউ পাগলও বলেছেন। অথচ আমরা জানি বিষয়টা মোটেও দূরের নয়। বরং বিপদটা অতি সন্নিকটে।’

কতটা সন্নিকটে সেটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেলো দুবাই। সম্প্রতি ভারী বর্ষণে মরুর দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। এর ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশটির প্রধান শহর দুবাই— যেটি সারা বিশ্বের পর্যটকদের কাছে বিরাট আকর্ষণ। শহরের রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে শপিং মল ও বিমানবন্দরও পানিতে থইথই করে। বিপর্যস্ত হয় বিমানসহ সব পরিবহন পরিষেবা। অথচ ভারী বৃষ্টি তো দূরে থাক, বৃষ্টির অভিজ্ঞতাও এই দেশটির মানুষের খুব কম। কিন্তু কেন?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি স্পষ্টতই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব—যে পরিবর্তনের জন্য দায়ী মূলত শিল্পায়ন ও মানুষের ভোগবাদী জীবন।

এটি জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি অভিঘাত কিনা সেটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণের বিষয়। কিন্তু সাদা চোখেও যতটুকু দেখা গেছে এবং সাধারণ জ্ঞানে যতটুকু বোঝা যাচ্ছে, তাতে এই ঘটনা যে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশের জন্য একেবারেই নতুন ও অস্বাভাবিক ঘটনা—তা নিয়ে দ্বিমতের কোনও সুযোগ নেই। বরং প্রকৃতি যে মানবজাতির ওপর ক্ষুব্ধ—দুবাইয়ের এই ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ অবশ্য বলছেন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে যে ব্যাপক বন্যা হলো তার মূল কারণ ক্লাউড সিডিং। পানির নিরাপত্তা সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য ২০০২ সাল থেকে অর্থাৎ গত প্রায় ২২ বছর ধরে এই ক্লাউড সিডিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে দেশটির সরকার।

পরিবেশবিদদের মতে, ক্লাউড সিডিং পরিবেশের জন্য ভালো নয়। এর নানা ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। যেসব এলাকায় ক্লাউড সিডিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, সেখানে সাধারণত অতিরিক্ত বৃষ্টির জন্য পরিকাঠামো থাকে না। ফলে অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে—যার শিকার হলো মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটি।

তবে আরব আমিরাতের এই অস্বাভাবিক বৃষ্টিজনিত বন্যার পেছনে ক্লাউড সিডিং কতখানি দায়ী, সেটি হয়তো বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় বেরিয়ে আসবে। কিন্তু বিপরীতে এটিও অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে পৃথিবীর জলবায়ু অনেক বেশি অস্বাভাবিক আচরণ করছে। শিল্পায়ন ও মানুষের ভোগবাদী জীবনাচরণের কারণে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বেড়েছে। মেরুর বরফ গলছে অনেক দ্রুতগতিতে। তাতে সাগরের জল স্ফীত হচ্ছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এই গ্রহবাসী মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর জন্য মারাত্মক প্রভাব ডেকে আনছে। সহজ ভাষায় যাকে বলা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন।

জলবায়ুতে নানারকম পরিবর্তন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এটা যেমন ঠিক, তেমনি মানুষের কর্মকাণ্ডও অনেক সময় সেই পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত এবং জীবনের জন্য হুমকি তৈরি করে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় সমুদ্র উপকূলীয় দেশগুলো যে ভয়াবহ বিপদে পড়বে, সেই শঙ্কার কথা গত দুই তিন দশক ধরেই বিজ্ঞানীরা বলে আসছেন। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের গতি স্লথ করতে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন তথা পৃথিবীর তাপমাত্রা যাতে বেশি না বাড়ে, সেজন্য যেসব কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের তরফে দেওয়া হয় এবং প্রতি বছর বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলনে অ্যাক্টিভিস্টদের পক্ষ থেকেও যেসব দাবি জানানো হয়—তার বাস্তবায়নে শিল্পোন্নত ও ধনী দেশগুলোর মধ্যে অনীহাও স্পষ্ট। তাতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে তারা শিল্পায়নের গতি কমাতে চায় না এবং জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর তাদের ভোগবাদী জীবনধারার সঙ্গেও আপস করতে চায় না। তাহলে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ কী?

তবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো ধনী দেশগুলোর পক্ষে যেকোনও পরিস্থিতি মোকাবিলা করে টিকে থাকা যতটা সহজ, বাংলাদেশের মতো সমুদ্র উপকূলীয় এবং অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ও অধিক জনসংখ্যার চাপে ন্যুব্জ দেশগুলোর পক্ষে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলা করে টিকে থাকা খুবই কঠিন। তার ওপর এখানেও আছে পরিবেশবৈরী নানাবিধ কর্মকাণ্ড। আত্মঘাতী উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে বাংলাদেশ নিজেও যে পরিবেশ ও প্রাণপ্রকৃতির বুকে কুড়াল মারছে এবং তার ফলেও উষ্ণায়ন বাড়ছে—সেই উপলব্ধিটাও জরুরি।

দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, বাংলাদেশে যেকোনও উন্নয়ন কাজ করতে গেলে প্রথম চোটেই গাছ কাটা শুরু হয়। কোন গাছটির বয়স কত; ওই জনপদের পরিবেশ ও প্রতিবেশে গাছটির গুরুত্ব কতখানি; গাছটি না কেটেই কাঙ্ক্ষিত অবকাঠামো উন্নয়ন করা যায় কিনা কিংবা যে অবকাঠামো নির্মাণের জন্য গাছগুলো কাটা হচ্ছে, মানুষের জন্য সেই উন্নয়ন আদৌ দরকার কিনা— অনেক সময় এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ভাবনায়ও থাকে না।

অবকাঠামোর উন্নয়ন করতে অনেক গাছ আমাদের কাটতে হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, এই ধরনের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য হাজার হাজার গাছ কাটাই কি সমাধান? গাছ না কেটে বা যথেষ্ট পরিমাণে কম গাছ কেটেও কি অবকাঠামো গড়ে তোলা যায় না? প্রকৌশল জ্ঞানের সঙ্গে পরিবেশ ও প্রাণপ্রকৃতির সমন্বয় করা কি খুব কঠিন কাজ? জ্ঞান বিজ্ঞানের যে অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে, সেখানে কেন গাছ-নদী-খাল-বিল-পাহাড় ও বনের পরিবেশ অক্ষুণ্ন রেখেই কাঙ্ক্ষিত অবকাঠামো গড়ে তোলা যাবে না? অবকাঠামো বানাতে গেলেই কেন গাছের গায়ে কোপ দিতে হবে?

বাস্তবতা হলো, একটি প্রাচীন গাছ কাটার বিনিময়ে একশ’টি গাছ লাগালেও ওই ক্ষতিপূরণ সম্ভব নয়। কেননা, আজ যে গাছটি লাগানো হবে, মানুষকে ছায়া ও পর্যাপ্ত অক্সিজেন দেওয়ার উপযোগী হতে তার অন্তত ২০ বছর সময় লাগবে। সুতরাং মানুষ যে সাময়িক প্রয়োজন ও লোভে পড়ে প্রকৃতির অপার দান যে বৃক্ষরাজি উজাড় করে দিচ্ছে—তার পরিণতি সে টের পায় এপ্রিল-মে-জুন মাসে। তখন সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষেরা তোলপাড় শুরু করে দেয়। আহা উহু করে। গরমে হাঁসফাঁস করে। স্বল্প আয়ের মানুষেরা ধারদেনা করে এসি কেনে। অথচ সেই এসি যে ঘরের গরম বাতাস বাইরে ছেড়ে দিয়ে প্রকৃতি আরও বেশি উত্তপ্ত করে; সেই এসির বিস্ফোরণে যে শত শত মানুষ প্রাণ হারায়—সেটিও মানুষ ভুলে যায়।

যে উন্নয়নের জন্য সে প্রকৃতি ধ্বংস করে, সেই প্রকৃতিই একসময় প্রতিশোধ নেবে—এই সহজ সূত্রটি মানুষ ভুলে যায়। যার ফলে মধ্যপ্রাচ্যের রুক্ষ ও মরুময় দেশ অতি বৃষ্টিজনিত বন্যায় বিপর্যস্ত হলে কিংবা এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের মানুষও ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রা কাবু হয়ে গেলে তখন বৃক্ষের প্রয়োজনীয় উপলব্ধি করে। অথচ যখন তারা পরিবেশ ও প্রকৃতিবিরোধী কর্মকাণ্ড করে, তখন এই বিপদের কথা তাদের মাথায় থাকে না।

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পিএসজিকে হারিয়ে ফাইনালে ডর্টমুন্ড
চ্যাম্পিয়নস লিগপিএসজিকে হারিয়ে ফাইনালে ডর্টমুন্ড
রাজস্থানকে হারিয়ে প্লে অফের আশা বাঁচিয়ে রাখলো দিল্লি
রাজস্থানকে হারিয়ে প্লে অফের আশা বাঁচিয়ে রাখলো দিল্লি
ঢাকা আসছেন মার্কিন অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু
ঢাকা আসছেন মার্কিন অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু
প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচন আজ
প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচন আজ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ