আমার পশ্চিমাপ্রীতি ও ভীতি

মো. সামসুল ইসলামসম্প্রতি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের নাক গলানো সম্পর্কে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর বক্তব্যের সংবাদ বেশ ভালোভাবে প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন পোস্ট। তথ্যমন্ত্রীর ওই বক্তব্য ছিল নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার পরিপ্রেক্ষিতে। 
আমরা আমজনতা। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এ বক্তব্য বা তথ্যমন্ত্রী ইনুর বক্তব্যের মধ্যে কোনটি যৌক্তিক, তা বিচার করার ক্ষমতা আমাদের নেই। কিন্তু পশ্চিমা মিডিয়ায় বাংলাদেশ নিয়ে এত হৈচৈয়ে আমি কিছুটা ভীত। আমরা চাই, নিজ দেশের মানুষ ও রাজনীতিবিদরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করুক, নিজেরাই শান্তির পথ তৈরি করুক। অন্যকোনও দেশের হস্তক্ষেপ চাই না।    
এটা মনে করার আমার যথেষ্ট কারণ আছে। বিগত বছরগুলোতে ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের কর্মকাণ্ড আমাকে পশ্চিমা বিশ্বের যেকোনও উপদেশ সম্পর্কে আতঙ্কিত করে তোলে। ইরাক লিবিয়ায় কী কারণে লাখ লাখ প্রাণহানি ঘটলো, তার সঠিক জবাব কেউ জানে না। আফগানিস্তানে সতেরো বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি তালেবান জঙ্গিগোষ্ঠী ও তাদের মাদক ব্যবসাকে শক্তিশালী করেছে মাত্র। বিশ্ব জনমতকে উপেক্ষা করে যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি ইসরায়েলে তাদের দূতাবাস জেরুজালেমে নিয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা, খোদ যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

অথচ আমি কিন্তু পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত। তাদের উদারনৈতিক গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ধারণায় দীক্ষিত। তাদের দেশের সাধারণ মানুষের ব্যাপারে আমার কোনও বিরোধিতা নেই। আমরা যেমন রুমির কবিতায় বিমোহিত, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রেও রুমি বেস্টসেলার। অ্যাডওয়ার্ড সাঈদ, নোয়াম চমস্কি বা জন পিলজারও তো আমাদের প্রিয় লেখক-সাংবাদিক। আমরা তো পশ্চিমা সিনেমার মহাভক্ত। আমি অবশ্য হলিউডের বিগ বাজেটের প্রোপাগান্ডা মুভি পছন্দ করি না। অল্প বাজেটের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা নিয়ে তাদের বানানো ছবিই পছন্দ। এ রকম ছবি আমি অনেক দেখেছি।

কিন্তু অপছন্দ করি পশ্চিমাদের পররাষ্ট্রনীতি, তাদের উন্নয়ন ধারণা। আবার অন্য দেশের যাদের তারা পছন্দ করেন, তাদের সম্পর্কে ভীতি জাগে। যেমন সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট, ফিনানসিয়াল টাইমস বিভিন্ন পত্রিকার সংবাদ পড়ে জানলাম, সে দেশের বর্তমান হোম সেক্রেটারি বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ সম্ভবত খুব শিগগিরই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হবেন।

একজন এশিয়ান, পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত আবার মুসলমান কীভাবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন, সেটা আমার আছে বিস্ময়ের ব্যাপার মনে হয়। আরও জানতে আমি উৎসাহিত হয়ে পড়ি। তার যতই যোগ্যতা থাক, তিনি কীভাবে ব্রিটিশ রাজনীতিবিদদের এত পছন্দের লোক হন, তা আমি ভেবেই পাই না। তিনি কি এশিয়ান মূল্যবোধগুলো ধারণ করেন? তবে এটা জানতে বেশি বেগ পেতে হলো না। জানলাম মন্ত্রিসভায় তিনি অত্যন্ত কট্টর ইসরায়েলি সমর্থক। এক্ষেত্রে তিনি অনেক গোঁড়া ব্রিটিশকেও হারিয়ে দিয়েছেন। ইসরায়েল সমর্থকদের এক সভায় তিনি বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যের কোনও দেশে থাকতে হলে তিনি ইসরায়েলকে বেছে নেবেন। কারণ সেখানেই তিনি আর সন্তানেরা ‘স্বাধীনতা আর ন্যায়ের’ উষ্ণতা পাবে।

আবার ধর্ম প্রশ্নে তিনি সবাইকে আশ্বস্ত করেছেন এ বলে যে, তিনি কোনও ধর্ম পালন করেন না এবং তার বাসায় শুধু খ্রিস্ট ধর্মের চর্চা হয় (তার স্ত্রী খ্রিস্টান)। সুতরাং এ ধরনের লোক পশ্চিমাদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় হলেও তার নিজের কমিউনিটিতে কতটুকু জনপ্রিয় হবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

আবার যেমন পশ্চিমাদের কাছে আমাদের ড. ইউনূস ব্যাপক জনপ্রিয় হলেও তার অনেক উন্নয়ন ধারণা আমার মানতে কষ্ট হয়। মনে পড়ে ২০০০ সালে আমি যখন ইংল্যান্ডে মাস্টার্স করছিলাম তখন ব্রিটেনের এক টিভি চ্যানেলে ড. ইউনূসের সাক্ষাৎকার দেখতে বসে দুই তিন মিনিট দেখার পর আমি টিভি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ কীভাবে উন্নয়নের বন্যা বইয়ে দিতে পারে, সে প্রসঙ্গে তিনি বলছিলেন। আমার কাছে তা মারাত্মক রকমের বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছিল। এটাও একটি পশ্চিমা উন্নয়ন ধারণাই মনে হচ্ছিল।

ব্রিটেনের অনেক খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও বইপত্রে সমাজে আইসিটি বা মিডিয়ার ভূমিকা বেশ ক্রিটিকালি দেখা হয়। আমার এক কোর্সে একবার Are ICTs revolutionizing societies? বা আইসিটি সমাজে কী বিপ্লব আনছে, এই ধরনের একটি প্রবন্ধ লিখতে দেওয়া হয়। আমি একমত না হয়ে সম্পূর্ণ উলটো যুক্তি দেই। পশ্চিমাসহ বিভিন্ন দেশের উদাহরণ টেনে আমি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে বিশাল বিনিয়োগ এবং এর সুফল প্রাপ্তিতে ফাঁক বা productivity paradox এর উল্লেখ করি। শিক্ষককে দেখলাম খুব খুশি হয়ে আমাকে ক্লাসে সর্বোচ্চ নম্বর দিয়েছেন।

সুতরাং পশ্চিমা অনেক উন্নয়ন ধারণার সঙ্গে অনেক সুবিখ্যাত পশ্চিমা অধ্যাপক দ্বিমত প্রকাশ করলেও আমরা দেখি আমাদের অনেক বুদ্ধিজীবী এতে গদ্গদ হয়ে পড়েন। বিভিন্ন পশ্চিমা উন্নয়ন সংস্থার পয়সায় করা গবেষণা এদেশের সাধারণ লোকের কতটুকু কাজে আসছে, এটা না বুঝলেও আমি বুঝি যে, তাদের দেওয়া কনসালটেন্সির লোভে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশীয় গবেষণা। আর পশ্চিমা ফান্ডে কৃত গবেষণায় আমাদের দেশীয় মূল্যবোধ, অভিমত কতটুকু প্রতিফলিত হচ্ছে, তাও এক বিশাল গবেষণার ব্যাপার।

পশ্চিমাদের বাকস্বাধীনতার ধারণা নিয়েও বিতর্ক হতে পারে। আমি খুব কাছেরই একটা উদাহরণ দেই। শিশু-কিশোরদের সাম্প্রতিক নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের শুভ্রতায় যদি কোনও কালিমা থাকে, তাহলো স্লোগানে, প্ল্যাকার্ডে তাদের ব্যবহৃত গালি। আর ফেসবুকেই দেখলাম হঠাৎ করে আমাদের এই রক্ষণশীল সমাজে গালিগালাজ জনপ্রিয় হয়ে ওঠার অন্যতম কারণ নাকি পশ্চিমে বসবাসরত আর সেখানকার বাকস্বাধীনতার সুযোগপ্রাপ্ত এক বয়স্ক বাংলাদেশি।

ইউটিউবে সার্চ দিয়েই তাকে পেয়ে গেলাম। অকথ্য অশ্রাব্য ভাষায় তিনি আমাদের দেশের সব রাজনীতিবিদদের গালাগালি করছেন। তার ভিডিওতে ইউটিউব সয়লাব, লাখ লাখ ভিউ। কথায় কথায় সবাইকে মদ খেতে বলছেন। ফেসবুকেই দেখলাম এই আন্দোলনের সময় এক শিশুর হাতে একটি প্ল্যাকার্ড। সেখানে লেখা ‘মদ খা’। কিন্তু এই লোকের বিরুদ্ধে কোনও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। কারণ সেই তথাকথিত বাকস্বাধীনতা। সমস্যা হচ্ছে এ গালাগালি তো এ প্রজন্ম ভুলবে না। সবার বিরুদ্ধে তারা এখন তা ব্যবহার করবে।

অথচ ফেসবুকে দেখলাম, আমাদের অনেক পশ্চিমা শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী ও বিশিষ্ট ব্যক্তি বিভিন্ন দেশের আন্দোলনের ভাষা বা তত্ত্ব দিয়ে এগুলোকে স্বাভাবিক বলার চেষ্টা করেছেন। কিন্ত কিছুদিন আগে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে টাক বলে গালি দেওয়া হলো, তখন দেখা গেলো এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও তাদের সহকর্মীকে দেওয়া গালি মেনে নেননি। পত্রিকার খবর অনুসারে বেশ ঘটা করেই তারা সাতজন শিক্ষার্থীকে গালি ও অশালীন শব্দ ব্যবহারের অভিযোগে বহিষ্কার করেছেন। 

পশ্চিমারা আমাদের দুর্নীতি নিয়ে সরব হলেও তাদের দেশে যখন দুর্নীতির টাকা পাচার হচ্ছে, সেটা নিয়ে বিস্ময়করভাবে নীরব। উল্টো বিনিয়োগের মাধ্যমে নাগরিকত্বসহ বিভিন্ন সুবিধা দেওয়া হয় তৃতীয় বিশ্বের দুর্নীতিবাজদের। একইভাবে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের বন্ধু আরব রাষ্ট্রগুলোর গণতন্ত্র আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে একেবারে নিশ্চুপ। কানাডা মিনমিনে গলায় সৌদি মানবাধিকার নিয়ে দুই একটি কথা বলেছিল। সৌদি আরব এর ফলে কানাডার সঙ্গে কূটনৈতিক ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য হারিয়ে কানাডার এখন ত্রাহী অবস্থা। মিত্রদের কাছে ছুটছে কীভাবে সৌদি আরবকে বুঝিয়ে শুনিয়ে তার রাগ ঠাণ্ডা করা যায়। আমি নিশ্চিত, পশ্চিমারা তাদের কিছু আর বলবে না।  

আমরা পশ্চিমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহায্য আমরা অবশ্যই গ্রহণ করবো, তবে তা আমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী, আমাদের মতো করে। আমরা চাই আমাদের রাজনীতি, আমাদের অর্থনীতি, আমাদের সমাজের নেতৃত্ব দেবেন আমাদের রাজনীতিবিদ, আমাদের বুদ্ধিজীবীরা। তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। অন্যকোনও দেশের প্রেসক্রিপশন আমাদের কাজে তো লাগবেই না বরং বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

ইমেইলঃ shamsulbkk@gmail.com